লাল-সবুজ জার্সিধারী যুবাদের টপ অর্ডারের প্রাণ আশিকুর রহমান শিবলি। এশিয়া কাপে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রে দুই ম্যাচে ওপেনার হিসেবে তার দুটি সেঞ্চুরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলাই যায়। এবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দলকে শিরোপা জেতাতে বড় অবদান রাখার প্রত্যয় তার বুকে।
ছোটবেলায় টিভির পাশাপাশি আপন বড় ভাইয়ের খেলা দেখে আশিকুর রহমান শিবলির মনে ক্রিকেটের প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়। বড় ভাই আশরাফুল আলম আসিফ ক্রিকেট খেলতে গেলে শিবলি পেছন পেছন ছুটতেন। অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলে খেলার পর আর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেননি তার বড় ভাই। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেটে গাজী টায়ার্সের হয়ে খেলবেন আসিফ। নিজের খেলার চেয়ে এখন বিশ্বকাপের ময়দানে ছোট ভাইয়ের সাফল্য দেখতে মুখিয়ে তিনি।
বড় ভাই ক্রিকেট খেলেন বলেই পরিবার থেকে বাধার মুখে পড়েননি শিবলি। বড় সন্তানের সুবাদে যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত মো. আবুল বাশার এবং তাহমিনা বেগম দম্পতি ক্রিকেটের ব্যাপারে আগে থেকেই জানতেন। ফলে ছোট ছেলেকে উৎসাহ দিতে কার্পণ্য করেননি তারা।
বড় ভাই এবং বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা নিয়ে এগিয়ে চলা আশিকুর রহমান শিবলি অনুসরণ করেন ভারতের সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিকে। ধোনির মতোই উইকেট রক্ষক হিসেবে খেলেন এই তরুণ। যদিও শুরুতে ব্যাটিং-বোলিং করতেন। পরে উইকেটের পেছনে খেলে মজা পেয়ে যান! তখন ধোনির খেলা, সাক্ষাৎকার ও সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও দেখে উদ্বুদ্ধ হন তিনি।
ফরিদপুরে কোচ মোখলেছুর রহমান বাবুল ও রাজিবের তত্ত্বাবধানে ক্রিকেট বলে হাতেখড়ি হয় শিবলির। ফরিদপুর ক্রিকেট অ্যাকাডেমি থেকে অনূর্ধ্ব-১২ দলের একটি টুর্নামেন্টে সেরা ব্যাটার হন তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বয়সভিত্তিক প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে ইয়ুথ ক্রিকেট লিগে ভালো খেলে সুযোগ পেয়েছেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রাথমিক ক্যাম্পে। মাঝে রান খরায় ভুগছিলেন। তবে দুঃসময় কাটিয়ে তার ব্যাট হয়ে উঠেছে প্রতিপক্ষ বোলারদের শায়েস্তা করার তরবারি। এশিয়া কাপে টুর্নামেন্ট সেরা হওয়া শিবলির ব্যাটে বিশ্বকাপে রান বন্যা দেখার প্রত্যাশা গোটা দলের।
অনূর্ধ্ব-১৯ যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশ স্কোয়াডকে নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের ধারাবাহিক আয়োজনে আজ রইলো ওপেনার ও উইকেট রক্ষক আশিকুর রহমান শিবলির সাক্ষাৎকার।
বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেটে আপনার হাতেখড়ি কীভাবে?
আশিকুর রহমান শিবলি: ছোটবেলা থেকে আমার আশেপাশের সবাইকে ক্রিকেটই খেলতে দেখেছি। তাদের মধ্যে অন্যতম আমার বড় ভাই মোহাম্মদ আশরাফুল আলম আসিফ। তিনি তার ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট খেলেন। তার খেলা দেখেই ক্রিকেটের প্রেমে পড়ে যাওয়া বলতে পারেন। ছোটবেলা থেকে টিভিতে প্রচুর ম্যাচ দেখেছি। আমার ১২-১৩ বছর বয়স থেকে এলাকায় টেপ টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলেছি। একসময় বুঝতে পারি আমাকে ক্রিকেটেই থাকতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার বড় ভাই কোন পর্যায়ের ক্রিকেট খেলছেন?
শিবলি: আসিফ ভাই এখনও ক্রিকেট খেলেন। এবারের মৌসুমে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশনে গাজী টায়ার্সের হয়ে খেলবেন। তার পারফরম্যান্সের সুবাদেই প্রথম বিভাগ থেকে প্রিমিয়ার ডিভিশনে সুযোগ পেয়েছে দলটি।
বাংলা ট্রিবিউন: কোন অ্যাকাডেমিতে আপনার ক্রিকেট দীক্ষা শুরু?
শিবলি: ফরিদপুর ক্রিকেটে অ্যাকাডেমিতে। সেখানে মোখলেছুর রহমান বাবুল স্যার, রাজিব স্যারদের মাধ্যমে ক্রিকেট বলে আমার হাতেখড়ি হয়। ফরিদপুর ক্রিকেটে অ্যাকাডেমি থেকেই অনূর্ধ্ব-১২ খেলা শুরু করি। এরপর অনূর্ধ্ব-১৯ জেলা দলে খেলার পর বিভাগীয় দলে সুযোগ পাই। অতঃপর ইয়ুথ ক্রিকেট লিগে ভালো করে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রাথমিক ক্যাম্পে সুযোগ পেয়েছি।
বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেট খেলার ক্ষেত্রে পরিবারের সমর্থন কেমন ছিল?
শিবলি: আমাকে ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা উৎসাহ দিয়েছেন। বড় ভাই খেলতেন বলে আমাদের পরিবারের কাছে ক্রিকেটের পথ চেনা। তাই আমার ক্রিকেট খেলতে কোনও সমস্যা কিংবা বাধার মুখে পড়তে হয়নি।
বাংলা ট্রিবিউন: শুনেছি মহেন্দ্র সিং ধোনির খেলা দেখে আপনি উইকেট রক্ষক-ব্যাটার হয়ে উঠেছেন?
শিবলি: এটা সত্যি। মহেন্দ্র সিং ধোনিকে অনুসরণ করেই উইকেট রক্ষক-ব্যাটার হয়েছি। কেবল ব্যাটিং কিংবা অধিনায়কত্বই নয়, তার সবকিছুই আমার ভালে লাগে। ধোনির বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও সংবাদ সম্মেলন দেখেছি। তার কথা বলার স্টাইল ও আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে। ক্রিকেটের প্রতি ধোনির প্যাশন অন্যরকম মনে হয়। মাঠে তার শরীরী ভাষা ও মাইন্ডসেট দেখে অনেক অনুপ্রেরণা পাই।
বাংলা ট্রিবিউন: ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই কি আপনি উইকেট রক্ষক-ব্যাটার ছিলেন?
শিবলি: না, উইকেট কিপিং করতাম মাঝে মধ্যে। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিং করতাম। কিন্তু বোলিং করতে ভালো লাগতো না। পরে উইকেট কিপিংয়ে মজা পেয়ে যাই। একসময় মনে হয়েছে, উইকেটের পেছনে ভালো করতে পারবো। তখন ধোনির অনেক ভিডিও দেখেছি। মূলত তাকে দেখেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম।
বাংলা ট্রিবিউন: অনূর্ধ্ব-১৯ ক্যাম্পে নাকি ফর্ম হারিয়েছিলেন, অফ-ফর্ম কাটালেন কীভাবে?
শিবলি: ক্রিকেটারদের ভালোমন্দ দুই ধরনের পরিস্থিতি থাকবেই। সবার জীবনেই এমন হয়েছে। খারাপ সময়ে সঠিক পরিকল্পনায় থেকে সেভাবে কাজের চেষ্টা করেছি। আমার বর্তমান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ স্টুয়ার্ট ল এবং ওয়াসিম জাফর, আমাদের নির্বাচক হান্নান সরকার স্যারসহ সবাই আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এছাড়া আমার জেলা কোচ বাবুল স্যার, রাজিব স্যারও সহায়তা করেছেন। আর আমার ভাই তো কোচ-মেন্টর সব ভূমিকাতেই ছিলেন। ফরিদপুরে থাকলে ভাইয়া আমাকে অনুশীলন করান। ভালো-খারাপ সবসময় পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলা ট্রিবিউন: হুট করেই শ্রীলঙ্কা থেকে বিশ্বকাপ সরে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশন বেশ কঠিন, বিশেষ করে ব্যাটারদের জন্য খানিকটা চ্যালেঞ্জিং। আপনাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি নেই তো?
শিবলি: এখন বিশ্বকাপ নিয়েই আমাদের সব ভাবনা। আমাদের প্রস্তুতি অনেক ভালো। দক্ষিণ আফ্রিকায় আমরা দশ দিনের মতো অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছি। এখানে বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলবো। সব মিলিয়ে কন্ডিশনের ব্যাপারে ভালো ধারণা হয়েছে আমাদের। দল হিসেবে আমরা বিশ্বকাপে ভালো করতে মুখিয়ে আছি।
বাংলা ট্রিবিউন: এশিয়া কাপে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন। দলসহ দর্শকদের প্রত্যাশা আপনার কাছে বেশি। এটা কি চাপ মনে হচ্ছে?
শিবলি: কোনও চাপ অনুভব করছি না। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। এশিয়া কাপের পারফরম্যান্স যদি বিশ্বকাপে অব্যাহত রাখতে পারি, তাহলে দলের জন্য অনেক সুবিধা হবে। আমার ওপর কোনও চাপ নেই। ক্রিকেটারদের এসব মেনে নিতেই হয়। এটাকে চাপ ভাবার সুযোগ নেই। আর সমর্থকদের প্রত্যাশা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করবো। কিন্তু দিন শেষে সাফল্য পাওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা প্রক্রিয়া অনুযায়ী খেলছি কিনা এবং নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছি কিনা।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি ওপেনার। আপনার পক্ষে বেশি বল খেলা সম্ভব। যুব বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক এউইন মরগ্যানের গড়া সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভাঙতে চাইবেন নিশ্চয়ই?
শিবলি: এসব নিয়ে কখনোই ভাবি না। ব্যক্তিগত মাইলফলক আমার কাছে গৌন। সবসময় দলের জন্য খেলতে চাই। দল যদি আমাকে ৯ নম্বরে ব্যাটিং করতে পাঠায়, তাতেও অসুবিধা নেই। নম্বর ধরে ব্যাটিং করতে বললেও প্রস্তুত আছি। মোদ্দা কথা, দল যেটা বলবে সেটাই করবো। রেকর্ড-টেকর্ড নিয়ে আমার মধ্যে ভাবনা নেই। দলের জয়ে যা প্রয়োজন সেটা করতে পারলেই আমি খুশি।
বাংলা ট্রিবিউন: শিবলি নাকি প্রয়োজনীয় কথাটাও বলে না?
শিবলি: (হাসি) আমি বলি কম, শুনি বেশি। কথা বলার চেষ্টা করলেও কেন যেন পারি না!
একনজরে
পুরো নাম: আশিকুর রহমান
ডাক নাম: শিবলি
জন্ম: ১ ডিসেম্বর, ২০০৫
জন্মস্থান: ফরিদপুর
বাবা: মো. আবুল বাশার
মা: তাহমিনা বেগম
উচ্চতা: ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি
পড়াশোনা: এসএসসি
প্রথম ও বর্তমান ক্লাব: ফরিদপুর ক্রিকেট অ্যাকাডেমি
প্রথম কোচ: মোখলেসুর রহমান বাবুল
ব্যাটিং স্টাইল: ডানহাতি
ব্যাটিং পজিশন: ওপেনার
প্রিয় শট: স্ট্রেইট ড্রাইভ
যুব ওয়ানডেতে রান: ১৮ ম্যাচে ৫০৩ রান
লিস্ট ‘এ’ রান: ৩ ম্যাচে ১০৭ রান
প্রিয় মানুষ: বড় ভাই
প্রিয় ক্রিকেটার: মহেন্দ্র সিং ধোনি
ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত: বিশ্বকাপ ফাইনালের সেঞ্চুরি