রয় হডসন-ক্লদিও রানিয়েরিরা এখনও ডাগআউটের উত্তেজনা উপভোগ করে যাচ্ছেন। প্রথম জনের বয়স ৭৬ ও পরের জনের ৭২ বছর। বয়সকে সংখ্যা বানিয়ে বিশ্বে হয়তো তাদের মতো অনেকেই আছেন, যারা ফুটবল উত্তেজনা মেতে রয়েছেন। বাংলাদেশেও এমন একজন ব্যতিক্রম আছেন, নাম তার আবু ইউসুফ। ৬৭ বছর বয়সেও মাঠমুখী হওয়া একদম কমেনি। ২১ বছরের খেলোয়াড়ি জীবন শেষে সেই যে ১৯৯৪ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং দিয়ে কোচিং শুরু করেছেন, এখনও মাঠ ছাড়েননি। বর্তমানে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে ডাগআউটে দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। আর যতদিন বেঁচে থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, ততদিন ফুটবল নিয়েই থাকার পণ করেছেন।
ইউসুফের পরিচয়, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ফুটবলে অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার। ৭০-৮০ দশকে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ ডিফেন্ডার’ হিসেবে তার বেশ পরিচিতি ছিল। যে কোনও ফরোয়ার্ডের জন্য তাকে পরাস্ত করা ছিল কঠিনসাধ্য কাজ। মোহামেডান ও আবাহনী ছাড়াও জাতীয় দলে খেলেছেন ১১ বছরের মতো। এরপর কোচিংয়ে এসে জাতীয় দল ছাড়াও বড় দলসহ অন্যগুলোতেও কাজ করে যাচ্ছেন।
বর্তমানে কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে ইউসুফের বেশ পদচারণা। ওয়ান্ডারার্সকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। তার মতো বয়স্ক হাইপ্রোফাইল কোচ পেশাদার লিগের কোনও স্তরে আর নেই। তা মনে করিয়ে দিতে বাংলা ট্রিবিউনকে আবু ইউসুফ বলেছেন, ‘আমি সেভাবে আসলে দেখি না। আমার বয়স যদিও ৬৭ চলছে। আমি বয়সের দিকে তাকাই না। কোচিং করাতে আমার ভালো লাগে। ফুটবল থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। যতক্ষণ শ্বাস থাকবে, সুস্থ থাকবো, ততোদিন মাঠে থাকবো। তাই যে কোনও দল থেকেই আমন্ত্রণ আসুক না কেন, তা যে কোনও বিভাগের হোক না কেন; পছন্দ হলেই কোচিং করাতে চলে যাই।’
খেলোয়াড়ি জীবনে ইউসুফ বড় দলগুলোতে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। তবে কোচিং জীবনে কোনও ক্লাবেই টানা দুই মৌসুম কাজ করতে পারেননি। এমনিতে স্পষ্টবাদী হিসেবে তার বেশ সুনাম রয়েছে। এছাড়া সৎভাবে জীবনযাপন করে থাকেন বলে চাউর আছে। কোচিং ক্যারিয়ারে উত্থান-পতন নিয়ে তার ব্যাখ্যা, ‘আমি সোজাসাপ্টা কথা বলে থাকি। সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে আমার কোনও কার্পণ্য নেই। তাই আমাকে অনেকে পছন্দ করে না। এছাড়া আমি পাতানো ম্যাচে বিশ্বাসী নই, কোনও ম্যাচে হলে সেখানে আমি থাকি না। এমনকি কোচিংও করাই না। তাই ক্লাব যখন পুরো বিষয়টি জেনে যায়, তখন আর আমার সেখানে থাকা হয়ে ওঠে না। এর জন্য কোনও ক্লাবে আমার পুরো মৌসুম কিংবা দীর্ঘদিন কাটে না। কোচিং করে সংসার চালাতে হবে এমন নয়। তাই পিছুটান নেই আমার।’
এএফসি ‘এ’ লাইসেন্সধারী কোচ কোচিং করিয়ে যাচ্ছেন ঠিকই্। তবে আগের মতো সুখ পাচ্ছেন না মনে। এর পেছনে কারণও দাঁড় করিয়েছেন ঢাকার বকশীবাজারে জন্ম নেওয়া ইউসুফ, ‘যখন কোচিং শুরু করেছিলাম, তখন কোয়ালিটি খেলোয়াড়ের অভাব ছিল না। মাঠের খেলাও ভালো ছিল। ফুটবলাররা অতিরিক্ত অনুশীলন করে নিজেদের আরও শাণিত করতো। পরিবেশটাই অন্যরকম ছিল। এখনকার খেলোয়াড়রা আমি বা আমরা যতটকু অনুশীলন করাবো, ততোটুকুই। নিজে উদ্যোগী হয়ে আলাদা অনুশীলন করবে, সেই ফুটবলারের সংখ্যাটা কম বললেই চলে। এছাড়া অন্য সমস্যা তো আছেই। তাই আগের মতো আর মজা পাই না। তবে ফুটবল থেকে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। তাই কোচিংয়ের মাধ্যমে এখন তা দিয়েও যাচ্ছি।’
কোচিং পদ্ধতিতে অনেক বদল এসেছে। আগের চেয়ে এখন কোচিং অনেক সমৃদ্ধ, ইউসুর্ফ তা বলছেন নির্দ্বিধায়। শুরুর ও বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বলেছেন, ‘আগে একধরনের কোচিং হতো, এখন অন্যরকম। আগে হার্ড ট্রেনিংয়ের দিকে বেশি জোর দেওয়া হতো। এখন পুরোপুরি আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। সবকিছু নিয়ম মেনে।’
কোচিং ক্যারিয়ারে এসে কোচদের অনেকের নামে নেতিবাচক কথা শুনে ইউসুফ মর্মাহত হন। বিশেষ করে কোনও কোনও কোচের নৈতিকতার অভাবের কথা শুনে নিজের মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলেছেন, ‘অনেক কোচই আছে যারা খেলোয়াড়দের কাছ থেকে কমিশন নেয়। জার্সি কিংবা অন্য কেনাকাটা নিজেই করে থাকে। এছাড়া অনেক কোচ বলে থাকে ওটা আমার খেলোয়াড়। তখন এসব খবর শুনলে খারাপ লাগে। আসলে কোচের কাজ হলো অনুশীলন করানো। ওমুক আমার খেলোয়াড়। এমনটা কেন বলবে? তখন মনে হয় সিন্ডিকেট নামে কিছু একটা থাকলেও থাকতে পারে। কই আমি তো এখনও বলতে পারলাম না ওমুক আমার খেলোয়াড়!’
নীতি-আদর্শকে ধারণ করে ইউসুফ ফুটবলকে আঁকড়ে ধরেই বাকি জীবন বাঁচতে চাইছেন। জীবদ্দশায় মাঠের কোচিংয়ে থেকে আগের মতো ফুটবলের গৌরব দেখে যাওয়ার বাসনা তার।