X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্রলীগ, পুলিশ, প্রশাসন: কার তদন্ত কে করবে?

আমীন আল রশীদ
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৬:০৪আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৬:০৪

প্রথমে রমনা বিভাগ থেকে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) উত্তর বিভাগে বদলি। তার কিছু সময় পরেই আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে। ২৪ ঘণ্টা না যেতেই তাকে ‘জনস্বার্থে’ সাময়িক বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর কিছু পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেকটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয় যে তাকে রংপুর রেঞ্জ উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

যাকে নিয়ে এত ঘটনা, তিনি রাজধানীর রমনা পুলিশের আলোচিত অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন-অর রশীদ। রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচিতে মানুষ পিটিয়ে যিনি একাধিকবার গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। সবশেষ আলোচনায় এসেছেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দুজন নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে বেদম মারধর করে দাঁত ফেলে দেওয়ার ঘটনায়। কিন্তু এই ঘটনার রেশ ধরে তাকে একের পর এক বদলি, সাময়িক বরখাস্ত ও সংযুক্তির ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, সরকার তাকে নিয়ে দারুণ ‘বেকায়দায়’ পড়েছে। সম্ভবত দেশের ইতিহাসে আর কোনও পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে এরকম ঘটনা ঘটেনি।

এই ঘটনায় বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে আসছে। বিশেষ করে পুলিশকে দিয়ে এই ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, নির্মোহ তথা ‘আনবায়াজড’ অর্থাৎ পক্ষপাতমুক্ত তদন্ত হবে কিনা? যদি না হয় তাহলে কে বা কারা এই ঘটনার তদন্ত করবেন? বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রয়োজন? কেন এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রয়োজন? সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সংক্ষেপে ঘটনাটি বলা যাক।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, গত ৯ সেপ্টেম্বর শনিবার রাতে পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন-অর-রশীদ পুলিশের আরেকজন এডিসি সানজিদা আফরিনের সঙ্গে রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় সেখানে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকে নিয়ে উপস্থিত হন ওই পুলিশ কর্মকর্তার স্বামী রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক। সেখানে এডিসি হারুনের সঙ্গে তাদের বাকবিতণ্ডা হয় এবং একপর্যায়ে সেটি হাতাহাতিতে রূপ নেয়। এর জেরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈম এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাবির শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিমকে শাহবাগ থানায় নিয়ে বেদম মারধর করা হয়। যদিও এই ঘটনার বিষয়ে এডিসি সানজিদা আফরিন একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, তার স্বামী আজিজুল হক আগে এডিসি হারুনকে মেরেছেন।

কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। যেমন:

১. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন-অর-রশীদকে জনস্বার্থে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগেও ক্ষমতার অপব্যবহার, মারধরসহ নানারকম অভিযোগ উঠেছে। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তখন এই ‘জনস্বার্থ’ কোথায় ছিল? এতদিন পরে কেন সরকারের মনে হলো যে তাকে ‘জনস্বার্থে সরকারি কর্ম হতে বিরত রাখা আবশ্যক ও সমীচীন’? ছাত্রলীগের দুই নেতাকে মারধরের কারণেই জনস্বার্থ বিঘ্নিত হলো? এর আগে তিনি যাদেরকে মেরেছেন, সেগুলো কি জনস্বার্থে ছিল?

২. সবশেষ মার খাওয়া ব্যক্তিরা যদি ছাত্রলীগের নেতা না হয়ে অন্য কোনও দলের নেতাকর্মী বা সাধারণ নাগরিক হতেন, তাহলে কি এডিসি হারুন বরখাস্ত হতেন বা তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এত তোলপাড় হতো? অন্য কোনও দলের কিংবা পেশার মানুষকে পেটানো বা ক্ষমতার অপব্যবহার কি জনস্বার্থবিরোধী নয়?

৩. জনস্বার্থের কথা বলে এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। অথচ ২৪ ঘণ্টা না যেতেই তাকে কোন জনস্বার্থে বা কার স্বার্থে রংপুর রেঞ্জ উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হলো?

৪. এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেটি স্পষ্টত ফৌজদারি অপরাধ। এই অপরাধে তার বিরুদ্ধে কেন মামলা হবে না? ধরা যাক হাসপাতালের ভেতরে আজিজুল হক কিংবা ছাত্রলীগের নেতারা আগে তার গায়ে হাত তুলেছেন। কিন্তু তারপরও কি ছাত্রলীগ নেতাদের কিংবা অন্য যে কাউকে থানায় নিয়ে মারধর করে দাঁত ফেলে দেওয়ার আইনি অধিকার ও এখতিয়ার পুলিশের আছে? অধিকার ও এখতিয়ার না থাকলেও পুলিশ মূলত তাদের ক্ষমতা দেখিয়েছে।

যদি এই অভিযোগ সত্য হয় তাহলে এটি স্পষ্টত ফৌজদারি অপরাধ এবং এডিসি হারুন এবং মারধরের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনে মামলা হওয়া উচিত।

৫. হাসপাতাল এবং শাহবাগ থানায় আসলেই কী ঘটেছিল, সেটির তদন্ত কে করবে? পুলিশকে দিয়ে পুলিশ বাহিনীর কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতমুক্ত তদন্ত কি আদৌ সম্ভব? এখানে অন্য কোনও পক্ষকে দিয়ে তদন্ত করানো উচিত। তাছাড়া এই ঘটনার সূত্রপাত যে সানজিদা আফরিনকে নিয়ে, তিনি নিজেও পুলিশের একজন এডিসি। উপরন্তু তিনি একজন নারী। অতএব পুলিশ বাহিনীর তদন্তে তার সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই জাতীয় ঘটনায় নারীদের ভিকটিম হওয়ার শঙ্কা যেমন থাকে, তেমনি নারী বলে বিশেষ সুবিধা পাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু নারী বলে তাকে যেমন ভিকটিম করার সুযোগ নেই, তেমনি নারী বলে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়াও ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।  

৬. আজিজুল হক নিজেও যেহেতু রাষ্ট্রপতির এপিএস এবং প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা এবং তার সঙ্গে থাকা লোকজন যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা, ফলে তারাও নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন কিনা কিংবা এমন কোনও পরিস্থিতি সেখানে তারা তৈরি করেছেন কিনা যাতে ঘটনাটি শাহবাগ থানা পর্যন্ত গড়ালো, সেটিরও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। অতএব ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত পুলিশ, প্রশাসন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, এমন কোনও ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বাইরের কাউকে দিয়ে।

৭. জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত করতে পারে। অথবা ঘটনা তদন্তে দলীয় পরিচয় নেই বা নিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত এমন ৩ থেকে ৫ জন ব্যক্তিকে নিয়ে একটি কমিটি করা যেতে পারে, যারা ফৌজদারি আইন সম্পর্কে জানেন। যাদের এই ধরনের ঘটনা তদন্তের অভিজ্ঞতা আছে। এমনকি বিচার বিভাগীয় তদন্তও হতে পারে। তবে যারাই তদন্ত করুন না কেন, এখানে নির্মোহ থাকতে হবে। কেননা এর সঙ্গে দেশের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশের ভাবমূর্তি জড়িত। অতএব প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে কেউ যাতে বিশেষ সুবিধা নিতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি।

৮. এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে এর আগেও নানা অভিযোগ এসেছে। সুতরাং শুধু এবারের ঘটনাটিই নয়, বরং এর আগেও তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মীদের মারধর এমনকি সাংবাদিকদের সঙ্গে অশোভন আচরণেরও যেসব অভিযোগ উঠেছে, তারও তদন্ত হওয়া উচিত।

৯. কোনও একটি অপরাধ ঘটলেই বলা হয়, ব্যক্তির অপরাধের দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না। এবারের ঘটনার পরেও পুলিশ মহাপরিদর্শক একই কথা বলেছেন। কিন্তু এটি নিয়েও ভাববার সময় এসেছে। কারণ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পুরস্কারসহ যাবতীয় বিষয় যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়; দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই সিস্টেমের ভেতরে কেউ যখন অপরাধ করে, তার দায় প্রতিষ্ঠান এড়াতে পারে না। অতএব খারাপ লোকদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা জরুরি। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতিতে যদি দলীয় বিবেচনাটিই মুখ্য হয়, তাহলে সেই বাহিনীকে দিয়ে জনসেবা সম্ভব নয়।

১০. শোনা যায়, ‘ভালো থানায়’ পোস্টিংয়ের জন্য লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। সুতরাং লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে তিনি কী করে জনগণের বন্ধু বা সেবক হবেন? তাকে তো ওই টাকা তুলতে হবে। যে টাকা বিনিয়োগ করেছেন, সেখান থেকে প্রফিট করতে হবে। সুতরাং পুলিশ কেন জনগণের বন্ধু হতে পারছে না, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, পুলিশ কি আদৌ জনগণের বন্ধু হতে চায় বা বিদ্যমান সিস্টেমে তার কি বন্ধু হওয়ার সুযোগ আছে?

১১. পুলিশ বাহিনীতে সংস্কারে নানা উদোগের কথা শোনা যায়। কিন্তু এইসব সংস্কারে পুলিশ বাহিনীতে কি কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে? পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনও ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে? সারা দেশে ‘মডেল থানা’ গড়ে উঠেছে। ওইসব মডেল থানায় গিয়ে মানুষ কি বিনা পয়সায় এবং বিনা হয়রানিতে সেবা পাচ্ছে? ওইসব মডেল থানার ওসি এবং অন্যান্য সদস্যরা কি মডেল মানুষ? তারা কি সত্যি সত্যিই জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করছেন বা করতে পারছেন?

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুবদল সভাপতি কারাগারে, রিজভীর নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিল
যুবদল সভাপতি কারাগারে, রিজভীর নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিল
ইন্ডিয়া আউট কর্মসূচি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে ১২ দলীয় জোট
ইন্ডিয়া আউট কর্মসূচি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে ১২ দলীয় জোট
কানাডার স্টেডিয়ামে রেকর্ড গড়লেন দিলজিৎ
কানাডার স্টেডিয়ামে রেকর্ড গড়লেন দিলজিৎ
এমন গরমেও ক্লাস করেছে শিক্ষার্থীরা (ফটোস্টোরি)
এমন গরমেও ক্লাস করেছে শিক্ষার্থীরা (ফটোস্টোরি)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ