X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধদেব বসু : অনিরুদ্ধ বাতায়নে নির্মোহ নির্মাতা

অলোক চক্রবর্তী
১৯ মার্চ ২০২১, ১০:৪১আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২১, ১০:৪১

‘চিরন্তনে মুক্তি দাও ক্ষণিকার অম্লান ক্ষমায়

ক্ষণিকেরে করো চিরন্তন।

দেহ হোক মন, মন হোক প্রাণ, প্রাণে হোক মৃত্যুর সংগম,

মৃত্যু হোক দেহ, প্রাণ, মন।’

বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিকতার প্রাণ-প্রবাহ, কীর্তিমান কবি ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করা হলেও তাঁর কবি প্রতিভার নিজস্বতা, স্বরূপ চিহ্নিত করা; স্পষ্ট করে বললে, ‘আধুনিকতার শিক্ষক’ হিসেবে কাল পরিক্রমায় তাঁকে মূল্যায়ন কতখানি সম্ভব হয়েছে, তা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। কবি হিসেবে তিনি কোলরিজের ‘কুবলা খান’ কবিতার ঘটনা প্রবাহের মতো বিস্মৃতি প্রায় হয়ে পড়ছেন না তো?

Then all the charm

Is broken – all the phantom world so fair

Vanishes …

উপর্যুক্ত মন্তব্যের আড়ালে আধুনিক কবিতার ইতিহাসের ধারায় যে শব্দটি সচেতনভাবে উল্লেখ করতে চাই, তাহলো—‘প্রেরণা’। কবিতার ক্ষেত্রে অথবা যদি দশকের স্বরূপ উন্মোচনের ক্ষেত্রেও বিষয়ভাব নির্ণয় করার প্রয়োজন অনুভব করা হয় তবে নির্মাতার ‘প্রেরণা-বিষয়ক’ অনুসন্ধান আবশ্যক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিহারীলাল চক্রবর্তী পর্যন্ত দেখা যায় ‘প্রেরণা’ বিষয়টি অনেক কবিই সচেতন অথবা অবচেতনে এড়িয়ে গেছেন। ‘সরস্বতী-বিরহ’ প্রসঙ্গ বিহারীলাল এড়িয়ে গেছেন (ভয়ে?)। রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রর কোনো কোনো চিঠিতে কিছুটা প্রেরণার অনুষঙ্গ এনেছেন; অবশ্য তাতে পাঠককূলের তৎকালীন মনোভাব কোনোভাবেই সুখকর ছিল না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও প্রেরণা-বিষয়ক মনস্তত্ত্ব বোঝাবার জন্য কেয়ার্ড থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে হয়েছিল। শিল্পের অন্তর্গত যে তাড়না তাই মানবসত্তার সুষমা বিকাশের এক দিগন্তবিস্তৃত পথ। কবি সেই পথের নির্মোহ নির্মাতা। ইমেজিস্ট আন্দোলনের অনন্য কবি এমি লোয়েলের যেমন ধারণা ছিল যে, কবি যেন এক ধারকযন্ত্র, এক রেডিও-এরিয়েল মাত্র। এই ধারণা অন্তর্গত বিষয়ভাবই মূলত ‘প্রেরণা’ হিসেবে চিহ্নিত। বাংলা কবিতার পালাবদলের ক্ষেত্রে প্রেরণারও পালাবদল ঘটেছে তিরিশের কবিদের হাতে। রোমান্টিক প্রেরণার পরিবর্তে বা তাকে অস্বীকার করে প্রেরণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় —বুদ্ধিবাদ। মেধার সংযম কিংবা অন্তঃপ্রেরণার বাইরে এসে সুধীন দত্ত বা বিষ্ণু দে’র মতো বাংলা কবিতায় সচেতনভাবে বুদ্ধদেব বসু যুক্ত করেন কবিতার আঙ্গিক-সমাচার —কবিতা হলো অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের পুরস্কার। বস্তুত তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘সজাগ কবি’। সম্ভবত বুদ্ধদেব বসুই কবিতার পালাবদলের ক্ষেত্রে বিশেষত প্রেরণার ক্ষেত্রে terrible journey-র মতো স্বপ্ন, কল্পনা, বেগ, মনীষাকে প্রবল উপেক্ষা ও সমালোচনা সত্ত্বেও সংযোজন করেছিলেন কবিতা রচনার বিস্তৃত পটে।

শৈশবে মাতৃহীন, স্নেহবঞ্চিত বুদ্ধদেবের মানসলোক বেড়ে উঠেছিল মাতামহের নিবিড় পরিচর্যায়। নিরানন্দ ও নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়েই শুদ্ধ শিল্পচর্চাকে ব্রত হিসেবে বিচ্ছিন্ন মানস ভূগোলকে সুস্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর নৈঃসঙ্গ্যচেতনার অনতিক্রম্য ও অনিবার্য পরিণতির গভীরে ছিলো বিশ্বব্যাপ্ত মূল্যবোধের পরিবর্তন। ফলে, বহমান পরিবেশে সমাজ-বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, আত্মমগ্ন ব্যক্তির মতো আশ্রয় খুঁজলেন কবিতায়। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির আত্মসচেতন ও আত্মচৈতন্যতাড়িত-উপলব্ধিও নতুনভাবে প্রকাশ ঘটতে লাগল কবিতায় ... প্রেরণায়।

ক. বুদ্ধদেব বসুর মানস ভূগোলের সাথে নৈঃসঙ্গ্যের প্রাণবীজ গভীরভাবে প্রোথিত। নৈঃসঙ্গ্যচেতনার অন্তর্মূলীয় Context হলো ব্যক্তির সংবেদনশীলতা ও সমাজ সংগঠনের মধ্যে প্রবহমান বেদনার আন্তঃসম্পর্ক। বিচ্ছিন্নতা, এই চেতনাকে বহন করে নিয়ে যায়। সঙ্গতিশূন্যতা মননবৃত্তিকে এক বিচিত্র দ্বৈরথে স্থাপন করে। জৈব-একাত্মতা থেকে বহির্জাগতিক অসঙ্গতি ও সময়ের জটিলতা মানবমনকে করে তোলে সঙ্কট সংকুল। বুদ্ধদেব বসুর চিত্ত জগৎ তাই নৈঃসঙ্গ্যতাড়িত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালপর্বে সার্বিক যে অবক্ষয় সূচিত হয়েছিল তার মধ্যেই সৃজনশীল সত্তার সঙ্গে সমাজ ও জনজীবনের যে অনন্বয় ঘটেছিল, বুদ্ধদেবও তাকে অস্বীকার করেননি। মর্ম্মবাণী (১৯২৪) তে কবি সময়-পরিবর্তনের বা অস্তিত্বের উন্মূল পরিস্থিতিকে ধরতে না পারলেও বৈনাশিকতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে T. S Eliot, The Complete plays-এ যেমন উচ্চারণ করেছিলেন ‘ফাঁপা মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধের তীব্র যন্ত্রণা, তেমনি বন্দীর বন্দনা (১৯৩০) এ কবি মানস আবিষ্কার করলেন প্রতীকবাদী, পরাবাস্তববাদী অভিব্যক্তিবাদী কবি-শিল্পীদের বিচ্ছিন্নতাবোধে পুড়ে রঙ-রেখা-শব্দের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞান; এক নতুন অনুভূতি। বাংলা কবিতার ভাঙনের ক্ষণেই বিনাশী যুগধর্মের প্রভাবে জীবন ও সৃষ্টিতে অনিরুদ্ধ বাতায়নে দাঁড়িয়ে নির্মাণ করলেন নির্বেদ-নিঃসঙ্গতা ও নতুন প্রেরণালালিত কাব্যভুবন।

‘বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন,/দুর্দম বেদনা তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর।’

খ. পরিবর্তনমনা কালধর্মে বুদ্ধদেবও রবীন্দ্রপ্রবাহে ভেসেছিলেন, কিন্তু মোহকে সচেতনভাবে পাশ কাটিয়েছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্যে নিজস্ব প্রতিরূপ অন্বেষণের মধ্য দিয়ে। বিচলিত মানবিক ধ্রুবস্থিতিকে আত্মদ্বন্দ্বের সমীকরণে নিয়ে আসলেন; উপলব্ধি হলো—নিঃসঙ্গতা পলায়নপর নয়, বস্তুত তা সত্য-অবলোকন ও অসীম সৃষ্টির অন্তহীন প্রেরণা। তাই বুদ্ধদেব বসুর কাছে আধুনিকতা ও চৈতন্যপীড়িত অনুভব হয়ে উঠল আত্ম-উন্মোচনের অনিবার্যতায়। দ্বিধাবিভক্ত সমাজে তিনিই গড়ে তুললেন আনন্দ নির্ভরতা ও নন্দন নির্ভরতার এক অনন্ত শৈল্পিক পটচিত্র। এক পরিশীলিত শিল্প-আত্মার অনন্য অবয়ব।

বুদ্ধদেব বসুকে আমরা চিহ্নিত করি আত্মমগ্ন নির্মাতা হিসেবে যার নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্মূলে রোমান্টিকতার প্রচলিত সংজ্ঞাকে ভেঙে দিয়ে গড়ে তুলছিলেন ক্রিয়াশীল রোমান্টিক চৈতন্য। রোমান্টিকেরা আশ্রয় ও বিষয় হিসেবে যে প্রকৃতি ও দৈব-প্রেরণাতে আস্থা রেখেছিলেন; বুদ্ধদেব বসুর এক অনন্য কৃতিত্ব—তত্ত্বকে একীভূত করেছেন। আধুনিক কবিদের কাছে প্রত্যাখ্যাত প্রকৃতি, নগ্নতা, স্বাভাবিকতা এবং তারা যে যুক্ত করেছিলেন প্রসাধনের, অলঙ্কারের, কৃত্রিমের; শিল্পের চেতনার ক্ষেত্রে পূর্বাপর বোধচৈতন্যকে দুই প্রান্ত থেকে আলাদা না করে সচেতনভাবে তাঁর শিল্প-দর্শনে, সৃষ্টিপ্রকৌশলে গ্রথিত করেছেন সাবলীলভাবে, দৈব ও জড়ের সঙ্গে আত্মচৈতন্যের সংগ্রামে বুদ্ধদেব বসু নিঃসন্দেহে এক অনন্য বিস্ময়। নির্মোহ নির্মাতা হিসেবে রোমান্টিক মানস ও আধুনিকতার মানস সজ্জাকে নতুন ও প্রবলভাবে সৃজনকলায় প্রয়োগ করেছিলেন। একদিকে শেলি, কীটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, বায়রন, এলিয়ট অন্যদিকে রবীন্দ্রের ‘জীবনদেবতা’—এ-সবের মধ্যেই অজ্ঞেয় এবং অনিবার্য প্রেরণাকে অবলম্বন করেছেন। সম্ভবত এ-সব বিবেচনায় তাঁকে নবতর প্রেরণাবাদী শিল্পাদর্শধারণকারী নির্মাতাও বলা যায়। কারণ প্রবণতা হিসেবে ওস্কার ওয়াইল্ড বা সুইনবার্নের সাথে তাত্ত্বিক দিক থেকে আত্মযোগাযোগ থাকলেও বোদলেয়ারের যে আত্মনিমগ্নতা তা বুদ্ধদেবের মানস-মগ্নতায় এক গভীর দিক সংযোজন করেছিল। তবে প্রতীকবাদী আন্দোলনের মূল যে Concept, শিল্পে তার যে কলাকৌশল বিশেষভাবে বিষয়-নিরপেক্ষতা এবং সর্বজনীন আবেদন—এ-দুইয়ের বিষয় আঙ্গিকেও তিনি সচেতনভাবে বাংলা কবিতার ধারায় নিয়ে আসলেন; সমকালীনতাকে শিল্পের যথার্থতা নিরূপনে চিরন্তনে রূপান্তরিত করলেন। বুদ্ধদেব সফল হয়েছিলেন কি না বা তাঁর মতাদর্শের গ্রহণযোগ্যতার ক্রিয়াশীলতা তাৎপর্যবাহী কি না, তা স্বতন্ত্র ও বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। শুধু এটুকু আমরা বলতে পারি, ব্যক্তি বুদ্ধদেব নিজের মধ্যে বিভক্ত করলেও, শিল্পকলায় কলাকৈবল্যবাদী মতাদর্শের তত্ত্বকে গ্রহণ করলেও, মানুষের আত্মার ও অনুভূতির পক্ষে শিল্পের সামাজিক উপযোগিতা না থাকলেও যে তা হয়ে ওঠে আত্মচৈতন্য অনুভবের একান্ত শুশ্রূষা; যা সামগ্রিক সত্তার পক্ষে অবিচ্ছেদী এক নির্মোহ আয়োজন।

...তারপর থেকে সহজেরে/অসহ্য আত্মীয় জেনে কেবল খুঁজেছি ঘুরে-ফিরে

মায়াবনবিহারিণী নিমিত্তচেতন হরিণীরে।/দেয় না সে আশ্রয়, প্রমিতি, প্রজ্ঞা; তাই তো আমার

পৌঁছবার তৃপ্তি নেই, আছে নিত্য-আরদ্ধ যাত্রার

আবর্তন;...  

পথিকৃৎ কবি বুদ্ধদেব বসু আধুনিক বাংলা কবিতার ধারায় সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করেছেন ভিতরের বাধার, প্রলোভন ও দুর্বলতার মধ্য দিয়ে। আধুনিক কবিতার যে অনন্য উপাদান সৃষ্টিশক্তি সম্মন্ধে সচেতনতা, তা কবি বুদ্ধদেব শুধু আয়ত্তেই নেননি ইন্দ্রিয়ঘন অনুভবকে একদিকে যেমন রূপায়িত করেছেন অন্যদিকে অবক্ষয়, মাধুর্যহীন প্রেম, করুণ অথচ হাস্যকর রূপের তিক্ত চিত্রও এঁকেছেন সাবলীলভাবে। শব্দ ও চিত্রের পুনঃপুন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সম্মোহন-জাল বিস্তারেও সর্বাধিক সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। ‘কঙ্কাবতী’ কবিতাই উপর্যুক্ত মন্তব্যের সবচেয়ে বড়ো সহায়ক। প্রির‌্যাফেলাইট কবিদের মতো বুদ্ধদেবকেও আমরা দেখি পৃথিবী ছাড়িয়ে সময়কে অতিক্রম করে চিরআকাঙ্ক্ষিত মিলনের রাজ্যে অভিসারে যেতে। মৌলিক পার্থক্য এটুকুই—বুদ্ধদেব পরিমিত এবং তাঁর কবিতায় সচেতনভাবেই ‘বিভাব’ বর্জিত’; সম্ভোগের আনন্দ তাঁর কাছে আধ্যাত্মিক, দৈহিক নয়। সম্ভোগ সৌন্দর্যপিপাসা চরিতার্থতার এক ঘনীভূত মাধ্যম এবং আনন্দের বিষয়ভাব কান্তিক। প্রকৃতঅর্থে এই সম্ভোগ বা আস্বাদনের মধ্যে যে মিলন ঘটে তা শুধু দেহের মিলন নয়, এই মিলনেই সূচিত হয় দেহ-বুদ্ধি-আত্মার এক উদ্বোধনী সম্মিলন। কবির সম্ভোগ চেতনায় উঠে আসে দ্বৈত জীবনের মিলনের যাত্রাধ্বনি; বীজসন্ধিতে উচ্চারিত হয়—

‘আমি যেন উষ্ণ সুরার মতো ঝ’রে ঝ’রে পড়ি/তোমার প্রাণের নিভৃত পাত্রে/

বিন্দু বিন্দু করে,/নিঃশেষে।’

বোদলেয়ার যেমন ভেবেছিলেন, ‘কবিতা যে স্বরাট কোনো বাহ্যিক প্রয়োজনের উপর নির্ভরশীল নয়, শুধু ব্যক্তিগত আত্মপরীক্ষার নির্যাস’—বুদ্ধদেবও একই আদর্শ লালন করে গেছেন। কবি তো কোনো নীতির প্রবক্তা, সংস্কারক নন; দ্রষ্টা হয়ে জাগতিক সমন্ধের যে সূত্র তারই আবিষ্কারক। তাত্ত্বিক এসব দিক ছেড়ে দিলেও কবিতা সৃজনে যে স্বেচ্ছাকৃত আত্মদহনের প্রয়োজন, বুদ্ধদেব বসু তাঁর সমগ্র জীবনে ঋষিদৃষ্টির মতো তা উদযাপন করেছেন।

১. ‘আমার হাতের স্পর্শ, যেন কোনো অন্ধ অদৃশ্য নদীর/ খরস্রোত; তার মধ্যে এই সমস্ত দুরন্ত পৃথিবীর

চিহ্ন মুছে যায়; শুধু এই বিশাল অন্ধকার নদীর /তীব্র আবর্ত, যেখানে আমরা জয়ী, আমরা এক, আমি

আর তুমি—কী মধুর, কী অপরূপ-মধুর এই কথা—

তুমি-তুমি আর আমি।’

২. মানুষের শ্রমের ফসল মানুষের অন্নে সঞ্চিত হোক/অমৃতের তৃষ্ণার দান আনন্দে উন্মোচিত হোক

এলিয়টিয় যে ধারণা ‘The word within word’, বুদ্ধদেবেও তার কোনো ব্যত্যয় নেই। ভাবের মধ্যে ভাবের অন্তরঙ্গ, বহিরঙ্গকে নিয়ে গেছেন নতুন জগতে। যেখানে প্রেম, ঐতিহ্য বা মিথ, সমাজভাবনা, প্রকৃতিভাবনা, বিজ্ঞানভাবনা, সমালোচনা, মৃত্যুচেতনা, অবচেতন-অনুভব প্রভৃতি বিষয় বহু সৃষ্টির প্রেরণাদাত্রী হিসেবে উপলক্ষ্য হয়েছে। সেই সঙ্গে বহুমাত্রিক জটিলতার আবর্তে সভ্যতা যেখানে সামঞ্জস্য স্থাপনে ব্যর্থ সেখানে কবিভাবনায় উঠে আসে উত্তরণের ধ্বনি—সামঞ্জস্য ও সুরসঙ্গতি স্থাপিত হতে পারে শিল্প-সাহিত্যের যোগ্য সৃজনসামর্থে। বুদ্ধদেব বসুর কবিকৃতি এখানে এসে রঙিন ও বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। বুদ্ধদেব বসু আমাদের শোনান এক অমোঘ সত্য—সাহিত্যের অন্যতম ধর্মই হচ্ছে জীবনের সদর্থকতার প্রতি প্রগাঢ় আস্থা স্থাপন।

বুদ্ধদেব বসুর কবিতাকে নানান আঙ্গিকে বিচার করা যায়। তাঁর কবিতায় বর্ণবৈভব যেমন সত্য তেমনি শিল্পকলার আন্দোলন ও গতি প্রকৃতির প্রতি সাগ্রহ অনুসন্ধিৎসু মনোভাব নিয়েও তাঁর কবিতাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করা যায়। নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনাপ্রবাহে ও সাহিত্যাদর্শে কবি বুদ্ধদেব বসুর যে মৌলিক কবিতা-দৃষ্টি, সৃষ্টির অনিবার্য পরিণতিতে তা কতটা অমোঘভাবে নিষ্কলুষ দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচিত হচ্ছেন, তা সচেতনভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন বৈ কি? তাঁর কবিত্ব নিয়ে যে অভিযোগ—তাঁর কবিতা সাম্প্রতিক নয়। তাঁর রোমান্টিক কবিতা নির্বিবাদে কদর্য দেহলোক-কেন্দ্রিক এবং শূন্য যাত্রাপথে এলোমেলো ছন্দমথিত; আবেগ অন্তরস্থিত নয়, বক্তৃতায় বশীভূত শুধু। এই অভিযোগ বুদ্ধদেব বসুর কবিআত্মা ও কাব্যশিল্পের বহমানতার পথে কি অন্তরায় সৃষ্টি করে? আমরা বলব, না। বসু কবির কবিতার ভাব, ইতিহাস, চিন্তার চতুর্পার্শ্বকে কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে আহরণ সর্বোপরি তাঁর চিন্তার জগতের রোমান্টিক ও প্রতীকবাদী সাহিত্যাদর্শের যে মেলবন্ধন এবং অন্তরঙ্গ অনুভবের যে শাব্দিক প্রকাশ, তা শিল্প-সচেতন নির্মিতির সূত্রে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এবং আগ্রহ অনুসন্ধিৎসা নিয়ে বিচার করলে উপর্যুক্ত অভিযোগ নিমিষেই খণ্ডন করা যায়। তবে আধুনিক বাংলা কবিতার ধারায় বুদ্ধদেব বসুর অবদান যতটা না সাহিত্য-আলোচনা, ‘প্রগতি’ কেন্দ্রিক, কবি হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন ততখানি করা গেছে কি না তা তর্কসাপেক্ষ মন্তব্য। মনে হয়, বুদ্ধদেব বসুর কবিত্ব ‘আধুনিকতার শিক্ষক’ অভিধায় অনেকখানি চাপা পড়ে গেছে। অনিরুদ্ধ বাতায়নে নির্মোহ নির্মাতা হিসেবে চৈতন্যের যে আমোঘ স্পর্শ ও সচেতন সৃজন-প্রক্রিয়ায় যে ধারাপথ নির্মাণ করেছিলেন, আধুনিক চিন্তার পরিপোষক সেই শিল্পাদর্শ কেন জানি মনে হয় প্রায়ই অনুচ্চারিত! ফেলে আসা দূর অতীত!

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা