X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

হাসান সাঘৌরির চূড়ান্ত বিজয়

মূল : জাকারিয়া তামের ।। ভাষান্তর : মাইনুল ইসলাম মানিক
০৫ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৩৪আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৫৩

[জাকারিয়া তামের একজন সিরিয়ান ছোটগল্পকার, কলামিস্ট ও সম্পাদক। জন্ম ১৯৩১ সালে সিরিয়ার দামেস্কে। তিনি আরবি ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী ছোটগল্পকার। তার ছোটগল্প পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায় অনূদিত ও বহুল পঠিত। বর্তমানে আরববিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে ধরা হয় তাঁকে। সহজ সাবলীল ভাষায় তিনি ব্যঙ্গাত্মক ছোটগল্প ও কলাম লিখে থাকেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলোই তাঁর রচনার মূল বিষয়বস্তু। এপর্যন্ত লিখেছেন অসংখ্য শিশুতোষ গল্পও। ‘দশম দিনে বাঘ’ তার অন্যতম ছোটগল্প সংকলন। এটি ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর দুনিয়াজোড়া ব্যাপক সাড়া পড়ে। এপর্যন্ত তাঁর প্রায় পনেরোটি ছোটগল্প সংকলন, দুটি গদ্যগ্রন্থ ও ডজনখানেক শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তামেরের উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থের মধ্যে স্প্রিং ইন দ্য অ্যাশেজ, দ্য থান্ডার, দামেস্কাস ফায়ার, উই শ্যাল লাফ, সাওয়ার গ্রেপ, ইফ, দ্য হেজহগ ও ব্রোকেন নি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যঙ্গাত্মক গদ্যের মধ্যে ‘দ্য ভিকটিমস স্যাটেয়ার অব হিজ কিলার’ অন্যতম। ২০০৯ সালে তিনি ব্লু মেট্রোপলিস মন্ট্রিয়েল ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ লাভ করেন। ২০১৫ সালে তিনি স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার জন্য মাহমুদ দারবিশ পুরস্কারসহ এ পর্যন্ত আরও অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।]



হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি কখনো একটা সাধারণ অপরাধও করেননি। অপরাধ বলতে আমরা দৈনন্দিন যেসব টুকিটাকি অপরাধ করে থাকি, সেসব অপরাধও নয়। তিনি কাউকে হত্যা করেননি, ডাকাতি করেননি, কোনো মেয়েকে ধর্ষণ করেননি এমনকি সরকারি বা সরকারবিরোধী কোনো সমাবেশেও যোগ দেননি কোনো দিন। তিনি কোনো দিন থানায়, জেলখানায় কিংবা আদালতে পা পর্যন্ত ফেলেননি। ধূমপান নিষিদ্ধ কোনো স্থানে কখনোই তিনি ধূমপান করেননি, এমনকি তাকে যদি বর্তমান রাষ্ট্রপতির নাম জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি সেটিও বলতে পারবেন না। লেবু বা তরমুজ কাটা ছাড়া খালিদ-বিন-ওয়ালিদের তরবারিও তার কখনো কোনো কাজে লাগত বলে মনে হয় না।

এতদসত্ত্বেও নিরাপত্তার দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষ সব জেনেশুনেই তাকে আটক করে এবং কোনো রকম অভিযোগ ছাড়াই নয় বছর জেলখানায় বন্দি করে রাখে। জেলখানায় বন্দিত্বের দশম বছরে তাকে আদালতে বিচারকের সামনে হাজির করা হয়। কাঠগড়ায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সতর্ক দৃষ্টি। আড়চোখে চুরি করে বিচারকের দিকে তাকাচ্ছিলেন। বিচারক একজন নারী। তিনি একটা বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে আছেন। ইতালিয়ান পিজ্জা সম্পর্কিত বইটি পড়তে পড়তে তিনি বারবার সাদা টিস্যু পেপারে নাক মুছছিলেন। হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি এই নারীকে দেখে বিমুঢ় হয়ে গেলেন। এই নারীটি তার পুরনো প্রতিবেশী নয় কি? এই নারীটি তো অর্থলোভী হিসেবে কুখ্যাত। তরুণদের প্রতি তার কামভাব ছিল প্রবল। তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্যে তিনি বিভিন্ন সহজ অর্থনৈতিক সুবিধা দিতেন। একাধিক স্বামী ও প্রেমিকের প্রতি কি তিনি আসক্ত ছিলেন না? হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি নারীটিকে প্রায় জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন। ঠোঁট দুটি ফাঁক করে যেই মাত্র কথা বলার জন্যে তিনি গলা খাকরি দিলেন, অমনি প্রহরী তাকে রাইফেলের নল দিয়ে গুঁতো মেরে সতর্ক করে দিলেন। প্রহরী তাকে নীরব থাকতে আদেশ করলেন এবং পরামর্শ দিলেন শুধু তখনই কথা বলার জন্য যখন তাকে কথা বলতে বলা হবে।

হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি পাথরমূর্তি সদৃশ চেহারার প্রহরীটির দিকে তাকালেন এবং হঠাৎ খুব উৎফুল্ল চাপাস্বরে বললেন, ‘তোমার চেহারাটা চেনা লাগছে। তুমি তো মুয়াইয়াতে আমার সহপাঠী ছিলে? তুমি তো সেই ছেলেটা যে নাকি সহপাঠীদের ব্যাগ হতে দুপুরের খাবার চুরি করার জন্যে কুখ্যাত ছিলে, তাই না?’ স্বাভাবিক রুদ্রমূর্তি অটুট রাখার জন্যে প্রহরীটি হাসি চেপে রাখলেন। ‘আমিও তোমাকে চিনতে পেরেছি। তুমি তো মসজিদ থেকে লোকজনের জুতা চুরি করার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলে।’

নারী বিচারকের দিকে ইঙ্গিত করে হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই প্রহরী তাকে থামিয়ে দিলেন। ‘চুপ করো। দুনিয়া অনেক বদলে গেছে। এটা এখন অনেক বিচিত্র। সে এক সময় তোমার অধস্তন ছিল, এখন তোমার ঊর্ধ্বতন।’

বিচারক বইটি বন্ধ করলেন এবং কথা বলার জন্য প্রস্তুত হলেন। তিনি হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরির নাম ধরে সম্বোধন করার পর কক্ষজুড়ে একটা উদ্বেগজনক নীরবতা বিরাজ করতে শুরু করল। কঠোর ভঙ্গিতে তিনি হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরিকে বললেন, তাকে সহসাই মুক্ত করে দেওয়া হবে কারণ সে এই কারাগারে থাকার অযোগ্য। তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। তাই দেশের কোনো কারাগারেই তার আর থাকার সুযোগ নেই। তাকে দেশত্যাগ করতে হবে। হতবিহ্বল হয়ে হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি বিচারককে বললেন, স্রষ্টার এই দুনিয়া সুবিশাল। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে তিনি কোথাও না কোথাও আশ্রয় নিতে পারবেন। তিনি বলেন, পৈতৃক বাড়িটি বিক্রি করতে সমর্থ হলেই তিনি তাদের নিয়ে দূরদেশে কোথাও চলে যাবেন।

বিচারক জানালেন, বাড়িটি এখন আর হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরির দখলে নেই। কর কর্তৃপক্ষ তাদের পাওনা আদায়ের জন্য জরিমানা হিসেবে বাড়িটি নিলাম করে নিয়ে গেছে। হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি ছ্যাবলামি করতে করতে উত্তর দিলেন, বাড়িটি পুরনো এবং বেশি রকমের জীর্ণ ছিল। এটিতে তার বাবার জন্ম ও মৃত্যু হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার পূর্ববর্তী চার প্রজন্মও এই বাড়িটিতেই জীবন যাপন করে গেছে। সেই অর্থে বাড়িটি নিলাম করে কর্তৃপক্ষ তাকে বরং এক দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে। এই বাড়িটির প্রতি তার মোটেও আকর্ষণ নেই। এমনকি পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করে এই বাড়িতে মৃত্যুবরণ করাটা তার জন্যে এক বাজে অভিজ্ঞতার সাক্ষ্যই হতে পারত। এখন তিনি সহজেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে পারবেন।

বিচারক জানালেন, তার স্ত্রী এখন আর আইনত তার স্ত্রী নেই। তিনি হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরিকে তালাক দিয়েছেন এবং হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরির গ্রেফতারের পরপরই তালাকের এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল।

বিচারকের কাছ থেকে এমন খবর শোনার পর হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরিকে মোটেও বিচলিত মনে হলো না। তিনি প্রত্যুত্তর করলেন, তার স্ত্রী এমন কোনো নারী ছিলেন না যাকে নিয়ে তিনি দৃশ্যত খুব সুখী ছিলেন। তার যেটুকু সৌন্দর্য ছিল, সবটুকুই হারিয়ে গেছে। তার সাথে প্রায়ই খুব উচ্চস্বরে বাদানুবাদ হতো এবং তিনি শুধু সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এতদিন তাকে তালাক দেননি। নইলে বহু আগেই তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যেত।

এবার বিচারক জানালেন, ছোট্ট সেই ছেলেমেয়েগুলোও এখন আর তার নিজের ছেলেমেয়ে নেই। আরো বহু বছর আগেই এক নিঃসন্তান নারী তাদেরকে দত্তক নিয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী তাদের এখন আর ফেরত পাবার সুযোগ নেই।

হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি জানালেন, এটাই উচিত কাজ হয়েছে। এই ছেলেমেয়েগুলো ছিল ভীষণ উশৃঙ্খল এবং ঝগড়াটে। এরা এক একজন ভয়ানক রকমের খাদক। এদের তলাহীন পাকস্থলির খাবার জোগাড় করতে করতে তার হৃৎপিণ্ড অঙ্গার হয়ে গেছে।

বিচারক জানালেন, অঙ্গার হয়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ডটিও এখন আর তার নেই। কারণ তিনি একটা অঙ্গ সংযোজনকারী সংস্থাকে তার হৃৎপিণ্ডটি দান করেছেন।

হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি জানালেন, খুব ভালো রকমের অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে তিনি রেহাই পেলেন। তারপর বিচারকের কাছে খুব বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলেন, তার পাকস্থলিটিও যেন দানের সুযোগ করে দেওয়া হয়। তাহলে ক্ষুধা, তৃষ্ণার জ্বালা থেকে তিনি রেহাই পেয়ে যাবেন।

সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রস্তাবটি সাদরে গৃহীত হয়। বিচারক তাকে লম্বা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ার আদেশ দিলেন এবং তার মাথার নিচে একটি বালিশ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কথামতো আদেশ সম্পন্ন হওয়ামাত্রই বিচারক এবং প্রহরীগণ তাদের কাজ শুরু করলেন। তারা হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরির পাকস্থলি, হৃৎপিণ্ড, কিডনি এবং কলিজ্বা খুলে নিলেন। কিন্তু বিচারককে অবাক করে দিয়ে রক্তাক্ত হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি উঠে দাঁড়ালেন এবং সনির্বন্ধ প্রার্থনা জানালেন, এবার তাকে চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। কারণ রাত নামার আগেই তাকে সীমান্তে পৌঁছুতে হবে।

বিচারক এবার হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। যদিও হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি জীবিত দাঁড়িয়ে আছেন, বিচারক তাকে মৃত হিসেবে ঘোষণা করলেন। প্রহরীরা তাকে কামরার বাইরে টেনে নিয়ে গেলেন। মাটিতে একটা সরু গর্ত করে তাকে সেখানে শুইয়ে দিলেন এবং গর্তটিকে সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দিলেন।

গর্তের ভেতর হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি তার প্রতিবেশী নারী বিচারকের প্রশংসা করতে থাকলেন। নারী বিচারকটি এতক্ষণে নির্বাসন দণ্ডের আদেশ দেওয়ার কথা ভুলে গেছেন। তার ভুল আদেশ জারি করার সুবাদেই হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি মাটির অভ্যন্তরে একটি নিরাপদ শান্তিপূর্ণ জীবন উপভোগের সুযোগ পেয়েছেন।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সরকারের সব সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ: সেনাপ্রধান
সরকারের সব সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ: সেনাপ্রধান
মহিলা সমিতি মঞ্চে ‘অভিনেতা’ ও ‘টিনের তলোয়ার’
মহিলা সমিতি মঞ্চে ‘অভিনেতা’ ও ‘টিনের তলোয়ার’
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করলো ইইউ
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করলো ইইউ
মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আ.লীগের, আছে শাস্তির বার্তাও
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আ.লীগের, আছে শাস্তির বার্তাও
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট