X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
রানা প্লাজা ট্রাজেডির ৮ বছর

সেদিনের স্মৃতি মনে করে আজও আঁতকে ওঠেন রেবেকা

বিপুল সরকার সানি, দিনাজপুর
২৪ এপ্রিল ২০২১, ০৮:০০আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২১, ০৯:১২

‘‘যেদিন রানা প্লাজার ফাটল ধরে, সেদিন আমরা অফিসের ভেতরেই ছিলাম। আমি সেদিন দেখেছিলাম ভবনের বড় ফাটল ধরার অংশটুকু। সেদিন আমরা অনেকেই ছুটির জন্য অনুরোধ করলাম তাদের (রানা প্লাজা কর্তৃপক্ষ) কাছে। সেদিনের মত ছুটি দিলেও বলে দিলেন পরেরদিন অফিসে আসার জন্য। আমিসহ অনেকেই তখন বলে ফেললাম, ‘এত বড় ফাটল ধরেছে যদি কোন দুর্ঘটনা হয় তবে তো আমাদেরই ক্ষতি হবে।’ চাকরি থাকবে না, টাকা দেওয়া হবে না- এমনি ভয় দেখিয়েছিল তারা। আবার অতিরিক্ত সময়ের কাজের টাকাটাও দেওয়ার কথা ছিলো। তারপরেও আমরা অফিসে গেছি। কারণ আমরা গরিব মানুষ। মাস শেষে আমাদের খরচ আছে। ঘর ভাড়া দিতে হয়, খাওয়া খরচ আছে। সেদিন ৯টা বাজার এক মিনিট আগে আমার মা আমাকে খেতে ডাকে, কেননা আমি তো সকালে খেয়ে যেতে পারতাম না। তাই মা আমাকে প্রতিদিনই খাইয়ে দিতো’’।

কথাগুলো বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন রেবেকা খাতুন। অঝোর ধারায় পানি নেমে আসে তার চোখ বেয়ে। চোখের জল মুছে আবার বর্ণনা দেন সাভারে বাসস্ট্যান্ডের পাশে সেই বহুতল রানা প্লাজা ভবন ভেঙে যাওয়ার ঘটনাটির।

রেবেকা খাতুন ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে যাওয়া ‘রানা প্লাজা’ ট্রাজেডির শিকার একজন পোশাক শ্রমিক। সেদিন প্রাণ হারান হাজারেরও বেশি মানুষ। আর যারা বেঁচে গেছেন তাদের কেউ হারিয়েছেন হাত, কেউবা পা, বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব। রেবেকা খাতুন তাদেরই মধ্যে একজন।

রানা প্লাজা তার দুই পা কেড়ে নিয়েছে। এখন হাতে ভর দিয়ে কোনমতে চলাচল করেন তিনি। সংসারের সবটা গোছাতে না পারলেও কিছুটা করেন অনেক কষ্ট করেই। যেমনটা দেখা গেল তার বাড়িতে গিয়ে। বাসন মাজা, তরকারি কাটার পাশাপাশি কোন রকমে রান্নার কাজটাও কষ্ট করে চালিয়ে নেন তিনি।

রেবেকা খাতুনের বাড়ি দিনাজপুরের ফুলবাড়ি উপজেলার ১ নং এলুয়ারি ইউনিয়নের শিবনগর এলাকায়। স্বামী, দুই ছেলে-মেয়েসহ চারজনের সংসার তার। তার বয়ানে উঠে এসেছে সেদিনের ভয়াবহ দুর্ঘটনার ব্যাখ্যা।

স্বামী, দুই ছেলে-মেয়েসহ চারজনের সংসার তার

ছলছল চোখে তিনি বলতে থাকেন, ‘‘তখন হাতে আমার এক পিস কাজ বাকি ছিল। মা সেদিন বললো ‘আসো মা খাইয়ে দিই তোমাকে।’ আমি বললাম, ‘আম্মা তুমি যাও, এক পিস কাজ আছে, শেষ করে আসছি।’ আমার আম্মুও গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনাটি ঘটলো। আর মায়ের সঙ্গে খাওয়া হলো না। মায়ের লাশটিও খুঁজে পাইনি। ওই কারখানায় আমার পরিবারের ৭ জন কাজ করতো। আমাকে দুই রাত দুই দিন পরে উদ্ধার করে। আমি তো বুঝতেই পারিনি কখন রাত, কখন দিন। আমার স্বামী এদিকসেদিক খুঁজে বেড়ায় আমাকে। আমি আর খোঁজ দিতে পারি না তাদের। আমার দু’পায়ের একটা বিমের ভেতর ঢুকে ছিলো, আরেকটা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত। দুই রাত দুই দিন কিছু খাইনি। গায়ের ঘাম খেয়েছি, রক্ত চুষে খেয়েছি। এক ছেলেকে বললাম, ভাই একটু পানি দেন। আপনি আমার ধর্মের ভাই লাগেন, একটু বের করেন ভাই। অনেক মানুষই আমার পা কেটে দিতে বলছিলো। কিন্তু ওই ভাই, যে আমাকে বের করেছিল তিনি কাটতে দেননি। সেই ভাই বলেছিলেন, ‘আমাকে যেহেতু ভাই ডাকছে, যেভাবেই হোক আমার বোনটাকে জীবিত বের করবো।’ কিন্তু আমার পা ধরে যখন টান দিয়েছিল, তাতে করে পায়ের রগ ছিঁড়ে যায়। আমার দু’পায়ে চারবার করে ৮ বার অপারেশন করেছে। খালি ইনফেকশন হয় আর কাটে। আমি পা কাটতে চাইনি, কিন্তু উপায় কী?’’

এ ঘটনা ঘটে যাওয়ার আজ ৮ বছর পূর্ণ। কিন্তু আতংক কাটেনি রেবেকার মনে। এখনও ভাবতে ভাবতে তিনি আনমনে ফুঁপিয়ে কাঁদেন আর আঁতকে ওঠেন। চোখের পানি মুছে আবার তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার আরও অপারেশন করতো। বয়স কম, আবার হাড় বাড়তে পারে তাই অপারেশন করেনি। ডাক্তার বলেছিলো পরে অবস্থা বুঝে অপারেশন করবে। হাড় বাড়লে তখন কাটা যাবে। ১১ মাস ১৭ দিন থেকেছি মেডিক্যালে। বাচ্চাদের নিয়ে একটু খেলতে চাইলেও বাধ সাধে পঙ্গুত্ব।

রেবেকা বলেন, বাচ্চা দুটো বাহিরে গেলে তাদের নিয়ে আসার মত ক্ষমতা নেই। বড় মেয়ে বলে, ‘আম্মু, সবারই মা স্কুলে যায়, তুমি যাও না কেন।’ এটা শুনে আমার খুব কষ্ট হয়। পা দুটো গেছে, পরিবারের সাতজনের মধ্যে আমি আর আমার ফুফু ফেরত এসেছি। বাকি ৫ জনের লাশেরও সন্ধান পাইনি।

রেবেকা বেগমের স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান। দুজনই থাকতেন ঢাকায়। স্ত্রী পোশাক কারখানায় কাজ করার পাশাপাশি তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন সেই সময়। যেদিন ঘটনাটি ঘটে সেদিন তিনি রানা প্লাজার মোটামুটি কাছেই কাজ করছিলেন। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‘ঘটনাটি ঘটার পর যে যার মত দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। বড় ভাই শ্রীপুরে থাকতেন। ফোন করলাম। বড় ভাই এসেও খুঁজতে লাগলেন, কিন্তু নেই! তার দুইদিন পর আমার কাছে একটা কল আসে একজন স্কুলছাত্রের। আমার নাম নিয়ে বলেন, ‘আপনি কি মোস্তাফিজুর?। আপনার স্ত্রী সুস্থ আছে।’ তার মাধ্যমে আমি আমার স্ত্রীর খোঁজ পাই। রেবেকার সঙ্গে আরও একটা মেয়েকে পাওয়া গিয়েছিল সেদিন। সে রেবেকার চেয়েও কম সিরিয়াস ছিলো। কিন্তু সে মারা যায়। সেই মেয়ের লাশ মাঠে রেখে দিয়ে তারপর আমাদেরকে নিয়ে আসে অ্যাম্বুলেন্সটি। অক্সিজেন ছিলো না, আমার স্ত্রী হাঁসফাঁস করছিলো। অনেকের কাছে সেদিন অক্সিজেন চেয়েছিলাম, কে রাখে কার খোঁজ। সেনাবাহিনী আমাদের অনেক উপকার করেছে।’’

পঙ্গুত্ব বরণ করেই দুই সন্তান প্রসব করেছেন রেবেকা বেগম। ‘শ্রেষ্ঠ মনুষ্যত্বের অধিকারী স্বামী মোস্তাফিজুর’ বলে মন্তব্য রেবেকার। রেবেকা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী অনেক ভালো মানুষ। পঙ্গু হলেও আমার স্বামী আমার জন্য অনেক কিছু করছেন। অনেক স্বামী হয়তো ফেলে দেয়। কিন্তু উনি তা করেননি। বাড়ির কাজ করে আবার মানুষের বাড়িতেও কাজ করেন। উনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমাকে উনি চাইলেই হয়তো ছেড়ে দিতে পারতো। তা তিনি করেননি, বরং ৮ বছর হতে চললো এখনও সেবা যত্ন করেন।’

এমন কথায় তার স্বামী মোস্তাফিজুর বলেন, ‘আমি কখনই আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তাই করিনি। আমি ভাবি, এমন ঘটনা আমার বোনের সঙ্গেও হতে পারতো। কিংবা আমার সঙ্গেও হতে পারতো। আমার বোনকে যদি তার স্বামী ছেড়ে দিতো আমার কেমন লাগতো।’

এখন অনেকটা কষ্ট করেই দিনাতিপাত করেন রেবেকা বেগম। বাসন মাজা, তরকারি কাটা, রান্না করার কাজটাও চালান তিনি এই অবস্থাতেই। তারমতো অনেকের জীবনেই হয়তো চলছে অনেক কষ্টে।

রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে যারা দুই অঙ্গ হারিয়েছে তারা পেয়েছেন ১৫ লাখ টাকার সঞ্চয়ী বীমা। আর যারা ডান দিকের একটি অঙ্গ হারিয়েছেন তারা পেয়েছে ১২ লাখ টাকার সঞ্চয়ী বীমা এবং বাম দিকের একটি অঙ্গ হারিয়েছেন তারা পেয়েছেন ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়ী বীমা। তবে দুই অঙ্গ হারিয়েও রেবেকা বেগম পায় ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়ী বীমা। এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিজিএমই’র সহায়তায় এই বীমা পেয়েছেন। কিন্তু বিজিএমই’র লোকজন যখন তথ্য নিয়েছিল তখন তারা একটু ভুল করেছিলেন। তাদের কাগজপত্রে লিখেছিলেন যে শুধু বাম পা কাটা। তাই এই ঘটনায় ১০ লাখ টাকা সঞ্চয় বীমা পেয়েছি। অর্থাৎ তার ভাগ্যে এখনও ৫ লাখ টাকা জোটেনি।

দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকী বলেন, ‘ওই নারীকে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের পক্ষ থেকে একটি ঘর প্রদান করা হচ্ছে। আর তিনি যে বাকি ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাননি তা প্রদানের জন্য বিজিএমইকে জানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’


 
 
/এনএইচ/
সম্পর্কিত
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
দেশে সবুজ কারখানা ২১৪টি
পরিবেশবান্ধব সনদ পেয়েছে ২ পোশাক কারখানা
সর্বশেষ খবর
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি, সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি, সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী