X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

গার্গয়েল ।। জয়েস ক্যারল ওটস

অনুবাদ : দুলাল আল মনসুর
৩০ এপ্রিল ২০২১, ২০:৩৫আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২১, ২০:৩৫

[আমেরিকার বহুলপ্রজ লেখক জয়েস ক্যারল ওটস উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ও নাটক লেখেন। তবে প্রধানত তিনি কথাসাহিত্যিক হিসেবেই বেশি পরিচিত। ২০০৪ সালে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় বলা হয়, তাঁর লেখার যেকোনো আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করা হয় তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা। তাঁর লেখায় মানবমনের জটিল ও গভীর বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য পায়।] 



একাকিত্ব নিয়ে কী করা যায়? তুমি কি কিছু অনুমান করতে পারো? এখন রাত ৩টা ২৫ মিনিট। তোমার ছোট পরিসরের বিছানায় ঈগলের পাখা ছড়ানোর মতো করে হাত-পা ছড়িয়ে তুমি শুয়ে আছ। তোমার ছোট শরীরটা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। ছোট হলেও ককুনের মতো সেটার ভেতরেও আরেকটা জগৎ আছে। আর আমি? আমি গুঁড়িগুঁড়ি তুষারপাতের মধ্যে গাড়ি চালাচ্ছি। জীবন সম্পর্কে নিজেকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি।

দুপাশে গাছপালা শোভিত জনশূন্য একটা প্রশস্ত রাস্তায় গাড়ি চলাচ্ছি। রাস্তার হালকা পলকা খুঁটির মাথায় হলুদ আলো জ্বলছে। বৃষ্টি, তুষার, কুয়াশা, বাতাস। একাকিত্ব নিয়ে কী করা যায়? রাগ, ক্ষোভ, আত্মহননেচ্ছা এমনকি খুনের ইচ্ছে পর্যন্ত নেই আমার। আমার মধ্যে ওসব স্পৃহা নিঃশেষ হয়ে গেছে। শুধু একাকিত্ব আছে। কুঁড়ে কুঁড়ে খাওয়া একাকিত্ব। কী করব এই একাকিত্ব নিয়ে? এই নিঃসঙ্গতা নিয়ে? আমার কথা শুনতে পাচ্ছ তুমি? কিছু অনুমান করতে পারছ তুমি? না। কখনও না। তুমি এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তুমি আমার প্রেমিকের পাশে নির্ঘুম শুয়ে আছ। শুয়ে থাকতে থাকতে তোমার পিঠ ব্যথা করছে। তোমার পেট ফুলে উঠেছে। তুমি সমুদ্রপৃষ্ঠে আটকেপড়া বিমূঢ় এক স্তন্যপায়ী প্রাণী, দেহের ভেতরে হা করে বাতাস নিচ্ছ।

তুমি কি আমার সম্পর্কে কিছু অনুমান করতে পারো? না। কখনও না।

তুমি কি আমার অস্তিত্ব টের পাও? আমাকে ভয় পাও?

এখন ৩টা ১৬ মিনিট। শুক্রবার সকাল, নাকি বৃহষ্পতিবার রাতও বলা যায়। বেশ দ্রুতই চালাচ্ছি। আবার একটু কমিয়ে আনছি গতি। তুষারের ওপরে গাড়ি পিছলে গেছে একটু। এই তো তোমার বিছানা থেকে মাত্র সিকি মাইল দূরে আমার অবস্থান এখন।

আমার একাকিত্ব এবার বেয়াড়া ধরনের অশুভ হয়ে উঠেছে।

আমাকে বিশ্বাস করা যায় না।

তোমার পাশে শুয়ে আছে তোমার স্বামী। মাঝেমধ্যে ঘুম ভেঙে গেলে সে ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছে না, তার পাশে কাঁথার নিচে কোন নারী শুয়ে আছে।

ধরো রক্তের মিষ্টি-বাসি গন্ধ লাগল তার নাকে। তখন কী হবে? বিরক্তিতে, এমনকি ঘৃণায় তার মুখ শক্ত হয়ে উঠতে পারে। তবু সে বুঝতে পারবে না কোন নারী তার পাশে গা ঘেঁষে শুয়ে আছে।

তোমার স্বামী।

আমার প্রেমিক।

নীলাভ গোধূলি রঙা নাগরিক রাতে ধীর গতিতে তুষার পতনের মাঝে একাকিত্ব নিয়ে কী করা যায়? তোমার বাড়ি আমি চিনি। তোমার শোবার ঘর, তোমার বিছানাও আমি চিনি। আমি বিচরণ করেছি এসব জায়গা। তুমি কেমন করে জেগে শুয়ে খাকো তা-ও আমি জানি—তোমার চোখ জ্বালা করে; আমার কথা তুমি ভাবতেই পারো না। এই বিছানায় তোমার এ অবস্থায় আরাম করে শোয়ার মতো জায়গা নেই। তোমার পেট স্ফীত হয়ে উঠেছে, ফুলে উঠেছে। তোমার তো আট মাস চলছে। এর ওপরে তোশকটার মাঝখানে চাপা খাওয়া। তোমার স্বামীর গায়ের সাথে পেট ঠেকিয়ে একটু আরামের ব্যবস্থাও করতে চাও না। স্বামীর ঘুম ভাঙাতে চাও না। তার ব্যক্তিত্বকে রাতের মাঝে জাগিয়ে দিতে চাও না। জেগে উঠলে তার ঘুম, তার ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস কর্কশ শব্দ তুলছে। দম আটকে যাওয়ার মতো শব্দ হচ্ছে, খলখল শব্দ হচ্ছে। তার ঘুম আরামের ঘুম নয়। প্রশান্তির ঘুম নয়।

সে তোমার কাছে কখনও মিথ্যে কথা বলেনি।

কখনও না।

তোমার তিনজন সন্তান আছে। আরেকজন আসন্ন। তোমার মাথা বোঝাই কত কত স্বপ্ন। তুমি কখনও একা নও। কখনও নও। আমি রাত তিনটে বিশ মিনিটে মেইডস্টোন এভিনিউয়ে একা একা গাড়ি চালাচ্ছি; সিগারেট টানতে টানতে একা একা কথা বলে যাচ্ছি আর অর্ধেক মনে আসা গানের একটু আধটু গুনগুন করে গাওয়ার চেষ্টা করছি—এ অবস্থায় আমাকে তুমি দেখলে আমার জন্য তোমার শুধু করুণা হতো। যদি তুমি মনে করতে আমি নিজের অবস্থা নিয়ে নাটক করার চেষ্টা করছি, আমার অবস্থার একটা আকষর্ণীয় পর্ব তৈরি করছি, তাহলে কোনো একদিন আমি আমার প্রেমিককে বলতে পারতাম, তুমি কীভাবে ঘৃণা প্রকাশ করে কিছুটা খেপাটে আচরণে আমাকে নিয়ে হাসার চেষ্টা করেছ।

এক রাতে আমার অবস্থা যখন আসলেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আমি আর অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে পারিনি। আমার রাতের গাউনের ওপর কোট চাপিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম; খালি পা বুটের মধ্যে ঢুকিয়ে কোনো রকমে বের হলাম। বাইরে তুষার পড়ছে, দেখতে কী চমৎকার! বড় মায়াবী! আমি নেশা করিনি, মাতাল হইনি। আমি শুধু দেখতে চেয়েছি, একাকিত্ব নিয়ে কী করা যায়।

মনে করো আমি ওকে কথাগুলো বলেই ফেললাম। তখন কী হতো? সে হয়তো বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনল। তারপর বিব্রত একটা ভাব তার মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। এরপর বিরক্তির ছাপও। আর এদিকে আমার সুরেলা হাসি। আমার হালকা পলকা বেপরোয়া তন্বী মুখ।

আমি কি সত্যিই সুরূপা?

তোমাকে ইদানীং কিছুটা কুৎসিতই মনে হয়—তোমার ত্বক ফ্যাকাশে, ত্বকের ওপরে ফোস্কার মতো কালো কালো দাগ পড়েছে। চতুর্থ বারের মতো তোমার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরিকল্পনাটা কার ছিল? নিশ্চয় তোমার স্বামীর না। এবারের অবস্থাটাও ঠিক প্রথম বারের মতোই কঠিন। তবু তোমার ভয় বলে কিছু নেই। এটা আসলে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত কি না সেটাও জেনে দেখার কোনো আগ্রহ তোমার নেই। তিন সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা, তারপর দুমাসের, তারপর পাঁচ মাসের, তারপর ছয় মাসের, সাত মাসের এবং এরপর আট মাসের। তুমি এক প্রশস্ত কালো নদী বয়ে বেড়াচ্ছ। সিঁড়ির ওপরের ধাপে বসে হাঁ করে নিশ্বাস ফেলার সময় তোমার মুখের সাথে হাতের উল্টোপিঠ ঠেকিয়ে রাখো; তবু তুমি নিজের অবস্থা সম্পর্কে কাউকে কিছু বলো না। সন্তান জন্মদানের আসন্ন ভীতি সম্পর্কেও কাউকে কিছু বলো না। কোনো নারী স্বপ্নের ভেতর যেভাবে ভয়কে লালন করে বয়ে বেড়ায় তোমার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার প্রথম দিকে স্বাভাবিক গর্ভপাত কিংবা ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত সম্পর্কিত ভীতি তোমার মধ্যে সেভাবে বয়ে বেড়িয়েছ। অনেক দিন ধরেই তোমার আর একাকিত্ব নেই। একেবারে বিয়ের সময় থেকেই নেই।

তোমার স্বামীর কাছ থেকে এতকিছু গোপন রাখো কেন? গুটিয়ে রাখো কেন? তাকে বিশ্বাস করো না? সে তোমাকে ভালোবাসে না—ঠিক। কিন্তু সে তো তোমার ভক্ত। তোমার চেহারার প্রতি তার এক ধরনের কোমল সায় আছে : তোমার শক্তপোক্ত হাড়ের শরীরে মাংসের গাঁথুনি, ফ্লেমিশ চাষির মতো সুন্দর মুখ। সে তোমার দিকে তাকালেই তুমি মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো যাতে সে তোমার চোখের নিচের কালো দাগ বা মৃত্যুর ছায়া না দেখে ফেলে; তোমার কিছুটা ফোলা গোমড়া আর বাঁকানো মুখটা ঘুরিয়ে রাখো। তোমার স্বামী একদিন বলেছে, আমি ওকে ভালোবাসি না। তবে আমি ওর খুব ভক্ত। ওর প্রতি আমার জোরালো দায়বদ্ধতা আছে।

আমার কোটের নিচে যে রাত-গাউনটা পরে আছি সেটাতে রক্তের কোনো দাগ নেই। অনেক দিন আগে, বছরখানেক আগে সেরকম অভিজ্ঞতা হতো। এখন আর আমার ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই।

আমি ভাবছি তোমার কথা; তোমার বিছানায় কী অবস্থায় শুয়ে আছ। আর এদিকে আমি ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে সত্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে যাচ্ছি। হয়তো কোনো অভিযানও হতে পারে এটা। আচ্ছা, তুমি কখনও ওর গায়ে আমার গন্ধ পাওনি? আমার চুল, আমার ত্বক, আমার শরীরের গন্ধ? এমন অনেক সময় গেছে আমরা দুজন গায়ে গা লাগিয়ে লেপ্টে শুয়ে থেকেছি; আমাদের ত্বক হালকা ঘামে পিচ্ছিল হয়েছে; আমাদের চোখের পাতা একাকার হয়ে লেগে আছে। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে আদুরে কণ্ঠে সে বলেছে, ক্ষুদে বেশ্যা, তুমি একটা খুদে বেশ্যা না!    

একবার তুমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভীত অসুস্থ ভালোবাসা দেখতে পেয়েছিলে। তার চিন্তার জাল জড়িয়েছিল তার ত্বকের সাথে। তুমি যা ভাবছ তা অস্বস্তির সাথে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারতে। নিশ্চয় পারতে। কী ভেবে মুখ ভেংচাচ্ছ! 

সে তোমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছিল; তার চোখে অপরাধবোধ। তোমার চোখে লজ্জা।

কয়েক মাস আগেই রক্ত জড়ানো গাউনটা ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আমার আরো গাউন আছে। কাপড়চোপড়ের যত্ন নেই আমি; কমপক্ষে তখন তো নিতামই। আমার ক্ষমতার চেয়েও বেশি পয়সা খরচ করতাম পোশাক-আশাক কিনতে। তাতে কী? সঠিক আলোর নিচে আমার চেহারা আসলেই আকর্ষণীয় দেখা যায়। তোমার স্বামীর তেমনই বিশ্বাস ছিল। তোমার বিশ্বাস না হলে তোমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো। এখনই ঘুম থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো।

একটু একটু বুঝতে পারছ আমি কে?

ফ্ল্যাট রক এভিনিউ ধরে পূর্বদিকে চলাচ্ছি এখন। তিনটে পঁচিশ বাজে। মানুষের শরীরে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে সেটার মধ্যে থেকেই জেগে ওঠে এই বড়ির প্রতিক্রিয়া। ওষুধের শক্তি অচেতনতার দিকে নিয়ে যেতে চায়; কিন্তু চেতনা ঠিকই জেগে থাকে। ছায়া ছায়া বাহু আমাকে ওপরে তুলে নিতে চাচ্ছে; কিন্তু আমি ঠেকিয়ে রাখছি। এখনও নিতে পারেনি, এখনও না। রাস্তার একপাশে অন্য সব জায়গার চেয়ে বেশি ঘন হয়ে তুষার পড়েছে; গাড়ির চাকাগুলো নিজেদের ইচ্ছাশক্তির বলে ওই পাশে উঠে যাচ্ছে।

কী করতে পারি একাকিত্ব নিয়ে। নিঃসঙ্গতা নিয়ে!

নারীদের ম্যাগাজিনে তুমি পড়েছ, আমিও পড়েছি, স্বাধীনতা হলো আজকের দিনের ফ্যাশন। একাকী জীবন যাপনের আনন্দ। শায়ত্বশাসন। কিংবা বলা যায় পরিবারের মধ্যে, এমনকি বিয়ের মধ্যেও বিক্ষিপ্ত একাকিত্বের ভেতর ডুবে থাকার চিন্তা ভাবনা।

বাজে চিন্তা একটা!

মোহসৃষ্টিকারী একটা বাজে চিন্তা ছাড়া আর কী!

আমি বাস্তবের কথা বলছি। এ বাস্তব সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। তোমার তিনজন আদরের সন্তান আছে। আরেকজনকে নিয়ে তোমার পেট স্ফীত হয়ে উঠেছে; সে তোমার পেটের ভেতর লাথি মারছে। পাশে তোমার স্বামী নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।

একাকিত্ব ফ্যাশনের কিছু নয়। আলোচনা করার মতো কোনো বিষয় নয় একাকিত্ব। একা থাকা নিয়ে অনেকে গর্ব করেও থাকে। আরো কিছু লোক আছে যারা জনসমক্ষে একাকিত্বের আনন্দ নিয়ে কথা বলে। কিন্তু কেউ তাদেরকে একাকিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা চুপ মেরে যায়।

একাকিত্বের কূপ।

কূপ একাকিত্বের।

উপন্যাসটি আমি পড়িনি। হাইস্কুলে থাকতে পাতা উল্টিয়ে দেখেছি। অনেক বছর আগে। শিরোনামটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল : কূপ একাকিত্বের।

তোমার কাছে আকর্ষণের মনে না-ও হতে পারে। কারণ তুমি কখনও ওই কুয়ায় পড়োনি।

ওই কূপ সম্পর্কে তোমার জানা নাও থাকতে পারে। কারণ প্যাকেটের ভেতরে সস যেমন ভরা থাকে, টিপ লাগলেই বের হয়ে যায়, তুমিও তেমনি পরিপূর্ণ, জীবন দ্বারা পরিপূর্ণ।    

তোমার জানা নাও থাকতে পারে। কারণ তুমি অনেক মিথ্যে কথা বলো, তোমার নিজের কাছেও মিথ্যে বলো তুমি।

আমি ওই কুয়ার কানায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সম্ভবত আমার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেকারণেই হয়তো ভেতরে পড়ে গেছি। অতল কুয়ার ভেতরে কালির মতো কালো জল। পচা দুর্গন্ধ। আমি আর ওপরে উঠে আসতে পারছি না। বারবার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই পারছি না। আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি, শক্তি হারিয়ে ফেলছি। আমি কান্না শুরু করছি। হাসা শুরু করছি। কেউ আমাকে ফোন করলে নিজের অজান্তেই আমি আমার পুরনো কণ্ঠে জবাব দিতে থাকি। আমার কণ্ঠ তখন বেশ চমৎকার, মনোমুগ্ধকর মনে হয়। মনে হয় কিছুই ঘটেনি।

তোমার স্বামীর সাথে আমার সম্পর্ক শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে একদিন আমি বলেছিলাম, কী ঘটেছে আমি বুঝতে পারছি না। আমার ওয়ালেট থেকে সব টাকা পয়সা শেষ হয়ে গেছে। কে যেন ইচ্ছে করে এরকম করেছে; কিন্তু আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। কী করব বুঝতে পারছি না।

তখনও সে আমার জন্য কত ভাবত! কীভাবে কীভাবে সে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছে! তুমি তো জানো, তোমার স্বামী কতটা কিপটে; তার মতো কিপটে মানুষ আর নেই। তবু সে আমাকে বলেছে, আমি যেন তার কাছ থেকে টাকা নেই। ধারকর্জ নয়, একবারে নিয়ে নেওয়া। সত্যিই আমি বিস্ময় আর হতাশায় পতিত হয়েছিলাম। আমার আশপাশের কেউ সব টাকা মেরে দিয়েছে। প্রায় ষাট ডলার। আর সেসময় তোমার স্বামী আমার হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছে, নিজের দুহাত দিয়ে আমার হাতটা ধরে টাকা গুঁজে দিয়েছে। টাকা দিতে দিতে সে বলেছে, ভেঙে পড়ো না। তোমাকে সাহায্য করতে পারলে খুশিই হব। কেঁদো না।

সুতরাং, আমি কাঁদা বাদ দিয়েছি। অনিচ্ছা থাকলেও আমি টাকাগুলো নিয়েছি। কেন নিলাম? একটা ভুল হয়ে গেল : সে টাকা দিয়ে আমাকে কিনে নিল। কয়েক দিন পরে আমার সেরকমই মনে হয়েছে।

তুষার কাঁকরের সাথে মিশে যাচ্ছে। কেন মিশে যাচ্ছে জানি না। উইন্ডশিল্ড ওয়াইপার চকচকে ফেনিল ময়লা তৈরি করছে।

হাঁ করে নিশ্বাস নিতে নিতে তুমি নিজেকে এদিক ওদিক দোলাচ্ছ। আমার প্রেমিক বিড়বিড় করে কী যেন বলছে; তবে জেগে ওঠেনি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! তার ঘড়ঘড়ে নিশ্বাস আবার যথারীতি শুরু হয়েছে। জানালা দিয়ে আসা ক্ষীণ আলোর নিচে বিছানার পাশে অস্বস্তির সাথে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছ তুমি। তুমি তো আমাকে দেখতে পাচ্ছ না। একদিন তোমার স্বামীর মুখের দিকে, তার ধূর্ত বিষণ্ন চাপা চোখের দিকে তাকিয়ে আরেকজনের ভুতুড়ে মুখের ছাপ দেখতে পেয়েছিলে। তবে পরের মুহূর্তে সে মুখের ছবিটা মিলিয়ে গিয়েছিল। গোমড়া মুখে তুমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, কী এত ভাবছ? তখনই ভয় শুরু হয়েছিল। কিন্তু তুমি সেটা কখনও স্বীকার করোনি।

আমি এখন উত্তর দিকে গাড়ি চালাচ্ছি। এই সরু রাস্তাটার নাম রেইলওয়ে। তুমি জানো, এ রাস্তাটা তোমার রাস্তার ওপর দিয়ে চলে গেছে। আমি নেশা করিনি। আমি মাতাল হইনি। আমি পুরোপুরি সচেতনেই আছি। দ্বিতীয় রাতের মতো আমি পুরোপুরি জাগ্রত অবস্থায় আছি। পুরোপুরি জেগে আছি। পানশালাগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই তোমার সাথে কথা বলা ছাড়া, ফিসফিস করে ডাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তোমার পেটের ভেতর প্রচণ্ড রকমের কাঁপুনি হচ্ছে; আমি টের পাচ্ছি তুমি বিশ্বাস করো? তোমার ভেতরে যে ব্যথা জেগে উঠছে আমি টের পাচ্ছি। ভেতরে এক ধরনের গোপন পচা গন্ধ হচ্ছে। আমি টের পাচ্ছি বলে কি তোমার মনে হয় না? এখন তিনটে উনত্রিশ বাজে। গ্রেহাউন্ড বাস-স্টেশনে সারা রাত ডিনার পাওয়া যায় এমন কোনো জায়গা খুঁজে দেখতে পারি। তুমি অবশ্য এ সম্পর্কে কিছু জানো না। রাতের নগরী সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই। এক রাতে আমি এরকম একটা জায়গায় থেমেছিলাম। সব পানশালা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি একাকী ছিলাম। বিস্ময়বোধ হয়েছিল; তবে সময়টাকে সানন্দে গ্রহণ করেছিলাম। কিছুটা পছন্দও হয়েছিল আমার। হলুদ কটকটে আলোয় বেশি পরিষ্কার মনে হচ্ছিল না জায়গাটা। তবু আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল। নিজের অজান্তেই স্মিত হাসতে হাসতে আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমার মুখে হাসি লেগেই রইল বেশ কিছুক্ষণ। শুধু কাউন্টারম্যান আর ইউনিফরম পরা অফ ডিউটি বাসচালক ছিল দুজন। আমার ঢোকার সাথে সাথে একজন কালো লোক ঢুকল; তার দুহাতের কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত উল্কি আঁকা। আমার সামনের বুথে সুরুৎ করে ঢুকতে ঢুকতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটা। তার নাম বিলি। আমার দিকে তাকিয়ে লোকটা এমন একটা হাসি দিল যেন আমরা কতকালের পুরনো বন্ধু। তার একটা উল্কিতে দেখা গেল একটা সাপ একটা চাকুর নিচে প্যাঁচ মেরে পড়ে আছে। আরেক উল্কিতে মৃত্যুকে স্টাইল দেওয়া হয়েছে। মখমলের মতো, মদের মতো রঙের ত্বক তার; তবে ললাটের দিকে আর ঠোঁটের পাশে কালো কালো দাগ। বালসুলভ লাজুক হাসি। আমরা পুরনো বন্ধু? লোকটা বকবক করা শুরু করে দিলো। আমি শুধু শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে যাচ্ছিলাম। মানুষের যা ইচ্ছে বকবক করে যায়; অন্য কেউ শোনে। আমিও তা-ই করলাম। আমি কোনো তাচ্ছিল্যের ভাব দেখাইনি। ‘কী পাগলের কথা’ জাতীয় কিছু বলিনি। শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে বেপরোয়া রকমের হাসি হেসে গেলাম।

এরকম কিছু তোমার পছন্দ না, তাই না? ঘামে ভেজা ললাটে তোমার হাত আড়াআড়ি করে রাখা; দুপা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছ তুমি; তোমার পায়ের আঙুলগুলো মেঝেতে কুঁকড়ে আছে।

কথা বলার সময় বিলি আর আমি বারবার হেসে যাচ্ছিলাম। আমার হাসি যতটা স্বতঃস্ফূর্ত আর অবাধ, বিলির হাসি ঠিক ততটাই বুনো। আমি কি বিপদে পড়েছিলাম? বিলি কি আমাকে ডিনারের ওখান থেকে ফুঁসলিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়ার ফন্দি করছিল? ওখান থেকে কোনো গলির মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে টান দিয়ে আমার অন্তর্বাস ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল? আমার দুপা ফাঁক করে আমার মুখের ওপর তার হাতের আস্ত কর্কশ তালু ঠেসে ধরতে চেয়েছিল? সে কি আমাকে অজ্ঞান করে সামান্যতম দয়ামায়া না দেখিয়ে আমার সব নিয়ে নিতে চেয়েছিল? ঠিক তখন ওই এলাকার দায়িত্বে নিয়োজিত একজন পুলিশ কফি খেতে এলেন। তিনি আমাদের পেছনের বুথেই বসলেন। আরো একজন এসে তার সাথে যোগ দিলেন। তারপর আরো একজন। গল্পে বিলির আগ্রহ মিইয়ে গেল। বাড়ি যাওয়ার কথা বলে কী যেন বিড়বিড় করে বলল। তারপর চলেই গেল। আমি নিজেরটা এবং বিলির টাকাটাও পরিশোধ করে দিলাম। যতটা নিরাপত্তার কথা ভেবে তার বেশি কৌতূহলের বশে কাউন্টারম্যান জিজ্ঞেস করল, ওই কালো লোকটা আপনাকে কিছু বলছিল নাকি, মিস?

আমার ঘুমহীন দ্বিতীয় রাত। নাকি তৃতীয়!

বিলিকে আমার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, একাকিত্ব নিয়ে কী করা যায়। একাকিত্ব জিনিসটা আসলে কী?

তুমি জানো?

কয়েক সপ্তাহ আগে তোমার ভেতর এক ধরনের বাধ্যবাধকতা চলে আসে। তুমি গোপনে একাকী রান্নাঘরে বসেছিলে। ওখানে বসে একটার পর একটা রুটির টুকরো খেয়ে যাচ্ছিলে। তুমি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিলে। জ্যাম কিংবা মাখন ছাড়াই তুমি একটার পর একটা রুটির টুকরো সাবাড় করছিলে। তোমার চোয়াল তোমার ওপরে কর্তৃত্ব করে যাচ্ছিল। চোয়াল তোমার কাছ থেকে তাৎক্ষণিক পুষ্টি চাচ্ছিল। ওই অদ্ভুত পঁয়তাল্লিশ মিনিট তোমার কাছ থেকে সবকিছু দূরে ছিল। তোমার সন্তানেরা, তোমার স্বামী, তোমার ব্যক্তিগত জীবন—সবকিছু। তোমার সঙ্গী ছিল শুধু তোমার আসন্ন সন্তান। তোমার সেই একাকী মুহূর্তে তোমার সঙ্গী ছিল তোমার পেটের সন্তানের ক্ষুধা।

আমার এরকম পরিস্থিতি হলে আমি মনে হয় ভয়ই পেতাম। আমার ভেতর এমন একটা বোধ জেগে উঠত—আমার শিরা উপশিরার মাধ্যমে আরেক জীব-সত্তা স্পন্দিত হচ্ছে; আমি তার অধীন হয়ে পড়েছি। আমার যেমনটি মনে হয়েছে, সে রকম কিছু আমার হতেই পারত না।

সে একগুঁয়ে রক্তপিণ্ডকে আমার শরীর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

আমি ওর কাছে নতি স্বীকার করিনি।

তুমি ভাবছ, কত বছরের ভালোবাসা।

ধীরে ধীরে সতর্কতার সাথে নিচু হয়ে সিঁড়ি বেয়ে এক পা এক পা করে নেমে আসছ তুমি। সিঁড়িতে যেন শব্দ না হয় সেদিকেও তোমার সতর্ক দৃষ্টি। তুমি কি আবারো ক্ষুধার্ত? আবারো রেফ্রিজারেটরের দিকে যাচ্ছ? ফ্যাকাশে, অসুস্থ, কম্পমান পিশাচ মহিলা!                              

কার যেন হাত তোমাকে টেনে নামানোর চেষ্টা করছে। প্রতিহত করার জন্য তুমি কাঁপতে কাঁপতে পিঠ বাঁকা করতে চেষ্টা করছ। না। না, এখনও নয়। মস্তিষ্কের আলোগুলো একটা একটা করে নিভে যাচ্ছে। রাতের জন্য নিভে যাচ্ছে। আর তোমার কৌশলটা হলো, কাত হয়ে পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা। 

তাহলে একাকিত্ব নিয়ে কী করা যায়? পুরনো কাপড় কিংবা পুরনো জুতার মতো পরাও যায় না। আবার ফেলে দেওয়াও যায় না। এক সময় সেগুলোর অনেক দাম ছিল, অনেক প্রিয়ও ছিল। কিন্তু এখন আর পরা যাচ্ছে না। পোশাক এমন খাটো হয়ে গেছে যে, গ্রামার স্কুলের মেয়েদের পোশাকের মতো কিংবা হ্যাট চেক মেয়েদের মতো। কয়েক দিন আগে এক রাতে আমি পোশাকের একটা র‌্যাকের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম। হাসতে হাসতে আমার শরীর কাঁপছিল। কী কুৎসিত! কী করুণ! অতিরিক্ত মূল্যের কয়েক গজ জিনিস আমার কাছে কী মূল্যের হতে পারে? আমার জীবন কি চিরতরে বদলে দিতে পারে? সব সময় সেই আশাটাই ছিল। প্রথম দিকে বেশ চমৎকার দেখালেও নকল সোয়েড স্কার্ট খুব তাড়াতাড়িই নষ্ট হয়ে যেত। বাচ্চাদের জন্য উপযুক্ত করে কাটা কাপড়ের ফালিসহ সবুজ আর নীলের ডোরাকাটা পোশাক আর খুব খাটো স্কার্টও সেরকমই ছিল। পারস্যের ভেড়ার লোম দিয়ে তৈরি কলারঅলা সাদা পশমি পোশাক আধাখেঁচড়া আর পরতে মোটেও আরামদায়ক ছিল না। তোমার স্বামী অবশ্য পছন্দ করত সেটা : আমার মুখটা ধরে শীত সম্পর্কে কাল্পনিক কথাবার্তা বলত সে। আমরা দুজন একসাথে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে চলে গেলাম এক জায়গায়। সেখান থেকে দূরের নেকড়েদের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। দূর আকাশে একাকী বাঁকা চাঁদ। ব্যর্থ চুমুর বেদনা, অপ্রাপ্তির মায়া। পোশাকটা আমি খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম, স্কার্টটার ভেতরের পাশে দাগ লেগে আছে। খুব শক্ত হয়ে যাওয়া দুধের মতো দাগ। বুঝতে পারলাম, ধোয়ামোছা না করেই কাপড় রাখার ছোট রুমটাতে স্কার্টটা ফেলে দিতে হবে। মনে হলো, আমি জানতাম, এটা আর কোনো দিন পরব না। 

নাইট গাউনের নিচে তোমার বড় বড় স্তন ঝুলে পড়েছে। অস্বস্তিকর রকমের বড়। তোমার বাদামি রঙের স্তনাগ্র বেশ নরম কোমল মনে হচ্ছে। তোমার পা ব্যথা করছে। আবছা অন্ধকার রুমটাতে তুমি সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছ; তোমার চোখদুটো কোটর থেকে বের হয়ে আসবে মনে হচ্ছে। নিশ্চয় তুমি আমার বিষয়ে ভীত নও!

আমার অবশ্য জানার আগ্রহ, তুমি যে কেন এত বছর ধরে অনুমান করতে পারোনি। আমার শরীরের গন্ধ অনেকবার তোমার কাছে পৌঁছে গেছে। যদিও তোমার স্বামী সপ্তাহে দুএকবার গোসল করে, তবু সে তো খুব একটা সূচিবায়ুগ্রস্ত কিংবা পরিপাটি নয়, অসাধারণ পরিচ্ছন্ন নয়। কাজেই আমার বেপরোয়া মুহূর্তের গন্ধ তার মাধ্যমে তোমার কাছে নিশ্চয় পৌঁছে গিয়ে থাকবে। নাকি কোনো কিছু বোঝার ব্যাপারে তুমি একেবারেই উদাসীন?  

আমার মনে হয়, তুমি মোটেও উদাসীন নও। আমি জানি, তুমি অনেক কিছু বুঝতে পারো।

তোমার স্বামীর গাড়ির মধ্যে আমাদের রতিমিলনের মুহূর্তগুলো : নদীর পাশে, নদীর অনেক ওপরে। বেশ কয়েক মাস পরে আমি স্বপ্ন দেখতাম, একাশো ফুট ওপর থেকে পড়ে যাচ্ছি। নদীর চাপা শব্দ, বাতাসের কৌতূহলী আর্তনাদ শুনতে পাই। বিশাল প্রশস্ত নদী, খাড়া ঢাল। নদীর পাশে পায়েচলা পথ বরাবর গাছপালাঘেরা খাড়া কূল। তার বাহুর বেষ্টনীতে থেকে আমি কাঁদছি। জানি সে আমার পতন ঠেকাবে না; জানি আমাকে ঠেকানোর শক্তি তার নেই। পড়ে যাচ্ছি, পড়ে যাচ্ছি উষ্ণ ঘন তরলের মধ্যে। আমরা দুজনই পড়ন্ত অবস্থায় সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রান্ত ভেঙে হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছি, বাতাসে নিক্ষিপ্ত হচ্ছি, শূন্যে নিক্ষিপ্ত হচ্ছি। উষ্ণ দমবন্ধ হয়ে আসা ভয়ংকর তরলের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। এরপর আমি জেগে উঠি। একটা চাপা ব্যথা অনুভব করতে থাকি আমার নিতম্বে, যৌনব্যথা। মাঝে মাঝে মনে হয়, অসাড় হয়ে আসছে, কী যেন নাই হয়ে গেছে। তুমিও কি স্বপ্নে এরকম পড়ে যাও? তোমার কি মনে হয় তোমার স্বামীর বাহু তোমাকে ধরে রাখতে পারবে না, ঠেকাতে পারবে না? গত সপ্তাহে এক বিকেলে আমি গাড়ি চালিয়ে ওখানে গিয়েছিলাম। কোনো কারণ ছাড়াই। অহেতুক। দেখলাম, আমার প্রেমিক আর আমি যেখানে পার্ক করতাম সেখানে কে যেন গাড়ি পার্ক করে রেখেছে। ইচ্ছে হলো, দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করি : আরে, আপনারা দুজন এখানে পার্ক করেছেন! ঠিক ভেবেচিন্তে কাজ করেছেন তো? জানেন এখানে কত বড় বিপদ হতে পারে? এত ওপরে, একদম পাশেই নিচে নদী, ঝড়ো বাতাস আর একাকিত্ব।

তোমার স্বামী মিথ্যে বলেনি। সে মনে করত এগুলো আসলে মিথ্যে নয়। আমার মনে হয়, সে ওই রকমই বিশ্বাস করত। সে বলত, আমি নাকি রাজকুমারী। আমার চেহারা সুন্দর ছিল। সে আমার প্রেমে পড়েছিল। আর তুমি হলে তৃতীয় পক্ষ। বাইরের একজন। করুণা পাওয়ার যোগ্য, ঘৃণা পাওয়ার যোগ্য। তবে তোমাকে গুরুত্বের সাথেই নেওয়া হয়েছে। তোমার স্বামীর দাবি, তুমি আত্মঘাতী। আর আমার প্রতিদ্বন্দ্বীর আচরণ সম্পর্কে জানার পরে আমি বলেছিলাম, কী বোকা মহিলা! তোমার একটা ছবি কিছুটা অনিচ্ছায় তোমার স্বামী আমাকে দেখিয়েছিল। আমি মোটেও কোনো মন্তব্য করিনি। ঘৃণায় আমার চোখ কুঁচকে আসছিল। ওই রকম চোখ! ওই রকম একটা মুখ! আর সে কিনা এরকম সুদর্শন একজন পুরুষকে পেয়েছে! সে তোমার দোষের ফিরিস্তি দিয়েছে গুনে গুনে : তোমার মনের ভাব, তোমার চড়া মেজাজ, তোমার অপরিচ্ছন্নতা, তোমার ঈর্ষা—সব। তোমার স্নায়বিক দুর্বলতা, ছেলেমেয়েদের সাথে তোমার ব্যবহার সম্পর্কেও শুনেছি। তোমার ছোট বাচ্চা ডনিকে একদিন এমনভাবে মুখ চেপে ধরেছিলে, তার নাক দিয়ে রক্ত ঝরা শুরু হয়েছিল। পর মুহূর্তেই তাকে বুকে টেনে নিয়েছিলে, ছিটগ্রস্ত মহিলার মতো রান্নাঘরের মেঝেতে বসে তাকে দোলাতে শুরু করলে। তোমার কাপড়ে রক্ত, মেঝের লিনোলিয়ামে রক্ত। বাচ্চা শিশুর মতো কাঁদছিলে তুমি, তোমার বাচ্চা যত জোরে কাঁদছিল তুমিও তত জোরে কাঁদছিলে। মনে পড়ে না?

আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তুমি এক শয়তানি, তুমি এক বেকুব মহিলা!

লোয়ার মেইন স্ট্রিটের পুরনো গহনা আর প্রাচীন জিনিসের দোকানে একদিন তোমার স্বামী আর আমি পালিশ করা মোমদানি, ১৯০০ সালের দিককার ওপরে প্রলেপ দেওয়া সিডারের ট্রাঙ্ক, আলমারি, পুরনো চেয়ার-টেবিল, বাতি, ফুলদানি, চীনামাটির বাসন ইত্যাদির সন্ধানে ঘুরঘুর করছিলাম। বাসনগুলোর কয়েকটা ভাঙা হলেও দেখতে সুন্দর। একটা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আলোর দিকে তুলে ধরে দেখলাম, চুলের মতো একটা দাগ রয়েছে। তখন নেভি ব্লু রঙের সুতি কাপড়ের বেঢপ টুপি (তোমার উপহার ছিল মনে হয়) পরা আমার প্রেমিক একটা চীনা মাটির হাতি খুঁজে পেল। হাতিটা ভিক্টরীয় যুগের একটা প্রাচীন চিহ্ন। জিনিসটা বেশ দামি : ৩৪০ ডলার। সে আমাকে হাতিটা কিনে দিতে চাইল। না হলে হলুদ চ্যাপটা মুখের একটা পুতুল নিতে হবে। কিংবা ছেলেমানুষি আর কিছুটা চাপা খাওয়া ছোট আকারের কিউপিড মূর্তি নিতে হবে। কিছুটা নেশা হয়েছিল তার। হয়তো মদ পানের কারণে, কিংবা দুপুরের খাবারের কারণে, অথবা এসবসহ আমার সাথে ভালোবাসা বিনিময়ের কারণে তার একটু নেশা হয়েছিল। আবার হতে পারে, তোমাকে ঠকানোর আনন্দেও নেশা হয়ে থাকতে পারে।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এটা গার্গয়েল নাকি?

তোমার স্বামী বলল, এটা একটা কিউপিড। বিপদগ্রস্ত কিউপিড। দ্যাখো এর ডানা নেই। ভেঙে ফেলা হয়েছে।

আমরা দুজনই হেসে ফেললাম কিউপিডের ভাঙা ডানা নিয়ে। ভালোবাসা বিনিময় আমাদের খানিকটা মাথা আউলা করে দিয়েছে। খানিকটা বেপরোয়া করে দিয়েছে। কিংবা বলা যায় অনেকটা নিষ্ঠুর করে দিয়েছে। কারণ, সেলসম্যান ধৈর্যের সাথে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু আমরা তার উপস্থিতিকে যেন পাত্তাই দিলাম না। জিনিসটাকে আমি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখলাম। দেখতে ব্যাঙের মতো, মুখে ভেংচিকাটা হাসি। প্রায় তিন ফুট লম্বা। গোপন চাহনির ভেতরেও কামুক ভাব; আবার বালসুলভ একটা মিশ্রণ লেগে আছে। হঠাৎ আমি জানতে চাইলাম, জিনিসটা আসলে কী। এত বড় অতিকায় জিনিসটা তৈরি করার পরিশ্রম কে করেছে।

তোমার স্বামী বলল, দেখেই বোঝা যাচ্ছে, শিল্পী খুব সিরিয়াস ছিলেন। চোখের এখানে ডিটেইলের দিকে খেয়াল করে দ্যাখো।

আমি বললাম, মোটেই সিরিয়াস ছিলেন না। 

একটা চোখে তেরসা স্থূল প্রফুল্ল চাহনি, আরেকটা চোখ অবারিত খোলা যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে। আমার জানতে ইচ্ছে হলো, দুচোখে এরকম আলাদা চাহনির মানে কী। কিউপিডের ওজন আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হলো। কিউপিডের প্রকাশভঙ্গিতে এক ধরনের ঠান্ডা কুটিল ভাব ফুটে উঠেছে। তারপরও সেটা একটা শিশুরই অবয়ব রয়ে গেছে। কিউপিড শিশুসুলভই; তার দৈত্যাকৃতির চেহারা তার কোনো দোষ নয়।

আমি ফিসফিস করে বললাম, আমি এটা ঘৃণা করি।

তোমার স্বামী সেদিন বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল। সে তখন শুধু স্বামী নয়, প্রেমিকও। তার প্রেমিকা রাজকুমারী। তার প্রেমিকা অপরূপ সুন্দরী। সে তোমার মতো গর্ভধারণ করার মতো নয়; তার চেহারা হালকা পাতলা যেটা তোমার নেই। সে বলা যায় প্রায় কুমারীই, আর তুমি সেরকম নও। তার স্তনযুগল শক্ত আর আকারে ছোট; তার স্তনাগ্র ছোট। তার পেট মসৃণ, সমান। খুব মসৃণ। তার পা লম্বা। তার চোখে প্রায়ই আলোর ঝিলিক খেলে যায়। তার মতো আর কেউ নেই। সে লক্ষণীয় রকমের কচি।

তোমার স্বামী প্রফুল্ল স্বরে বলল, তোমার জন্য এটা কিনব। আরেকটা বাচ্চাদের গাড়ি। গাড়িটাতে করে কিউপিডের মূর্তিটা তোমার বাড়ি পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যেতে পারি আমরা।

আমি তাড়াতাড়ি দোকানটার আরেক পাশে চলে এলাম। কিউপিড আমার কাছে ভালো লাগেনি।

আমার প্রেমিক আমাকে অনুসরণ করে পেছন থেকে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমার গালের একপাশে চুমু দিল। তার নিশ্বাসে মদের গন্ধ পেলাম। কাচের একটা প্রদর্শনী পাত্রের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই টের পেলাম গার্গয়েলটা আমার কাঁধের ওপরে লাফিয়ে পড়ছে। আমি দাঁত বের করে খানিক হাসি ছড়িয়ে দিলাম।

আমার প্রেমিক ফিসফিস করে বলল, তুমি তো আমাকে ভালোবাসো, বাসো না?

তোমার অনালোকিত বাড়ির সিঁড়িতে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছ তুমি। তোমার বিশাল পেটের ওপর হাত রেখেছ তুমি। বারান্দার একটা আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তা পর্যন্ত। থেকে থেকে থোকা থোকা তুষার পড়ছে। আমার প্রেমিককে নিয়ে তোমার মাথায় কোনো চিন্তা ঢুকতে দিতে চাও না তুমি। সে তো আমার বাহুবন্ধনে প্রচণ্ড আবেগের উত্তেজনায় গোঙানির মধ্যে মনে হয়েছে মৃত্যুবরণ করবে। তার উত্তেজনা দেখে মনে হয়েছে তার আগে যেন আর কেউ এমন উত্তেজনার অভিজ্ঞতালাভ করেনি। আমার বিষয়ে নিজেকে কোনো চিন্তার মধ্যেই ফেলতে চাও না তুমি। আমি এখন তোমার বাড়ির রাস্তা দিয়েই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। খুব আস্তে চালাচ্ছি যাতে তুষারের ওপরে চাকা পিছলে না যায়।

ভালোবাসার স্বস্তি পুরোপুরি পরিপূর্ণ হয়েছে! আবেগের গোঙানি, বিমূঢ় বিড়বিড়ানি, হাইতোলা—সব।

আমরা কি তাকে নিয়ে দুই সিংহীর মতো লড়াইয়ে জড়াব? আমাদের চোয়াল থেকে তার মতো শিকারের শরীরের তাজা রক্ত টপটপ করে ঝরবে?

তোমার পেট এমনভাবে স্ফীত হয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে যেন ফেটে যাবে। রং হয়েছে নীলাভ সাদা। নিজের ভারী ওজনের কারণে তুমি খুঁড়িয়ে হাঁটছ। এক পাশ থেকে তোমাকে দেখতে বেশ মহান লাগছে। তোমার ত্বক খসখসে হয়ে গেছে। আমার ভেতরটা একদম খালি। একদম চেঁছে পরিষ্কার করার মতো খালি। এ কারণে অবশ্য আমি তোমার প্রতি মোটেও ঈর্ষান্বিত নই। আসলে তোমার অবস্থায় পড়তে আমার বরং ভয়ই লাগবে। তোমার স্বামী ঠান্ডা স্বরে বলে থাকে, আমি কখনও অবিশ্বস্ত হইনি। সে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে, দেখতে চায় তুমি কিছু অনুমান করতে পারো কি না। সে তোমাকে ঘৃণা করে, ভয় পায়।

একদিন সে আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে তোমার অসুখী হওয়ার জন্য আমাকে দায়ী করেছে। খুদে বেশ্যা, তুমি আমার কাছ থেকে কী চাও?

আমি গাড়ি থামালাম। তুষারের ওপরে যেন পড়ে না যাই—সতর্ক হয়ে গাড়ি থেকে নামছি। দরজায় কে দাঁড়িয়ে? কে আমার দিকে তাকিয়ে আছে? তুমি এত চুপচাপ কেন, এত ভৌতিক লাগছে কেন তোমাকে?

রাস্তার আলোয় আমি তোমার কাছে এগিয়ে আসছি। লম্বা কালো কোট আর পায়ে বুটজুতো পরা এক নারী আমি। তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছি।

তুমি কি আমাকে ভেতরে যেতে দেবে? তুমি কি শেষে আমাকে চিনতে পেরেছ?

তোমার সদর দরজার দিকে সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। দরজার বেল বাজানোর মতো করে হাত এগিয়ে দিয়েছি। তবে আমি বেল বাজাচ্ছি না। আমি শুধু জানালার সাথে আমার আঙুলের ডগা চেপে ধরেছি।

আর তুমি ঘুমঘুম আবহের উষ্ণ বাড়ির ভেতরে, তোমার আঙুল যাতে আমার আঙুল ছুঁতে পারে সেজন্য হাত বাড়াতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করছ। জানালার কাচে আমাদের আঙুল মিলে যাবে।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ট্রাকের ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেলের ৩ আরোহী নিহত
ট্রাকের ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেলের ৩ আরোহী নিহত
প্রাণ জুড়াবে কাঁচা আমের শরবত
প্রাণ জুড়াবে কাঁচা আমের শরবত
কামালের ২৯ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারলেন না সবুজ!
কামালের ২৯ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারলেন না সবুজ!
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!