X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

নক্ষত্রগুলো নীল

নাসিমা আনিস
০১ মে ২০২১, ১৫:০৮আপডেট : ০১ মে ২০২১, ১৫:০৮

জানো তো লগারিদম স্কেলে তারকাদের উজ্জ্বল মাপা হয়, আর উজ্জ্বলতার মান যত বেশি হয় তার উজ্জ্বলতা তত কম হয়!

তাহলে লগারিদমে যার উজ্জ্বলতার মান সবচেয়ে কম হবে তেমন একটা নক্ষত্র তোমাকে দিতে চাইলে তার সঙ্গে আর কি দিতে হবে! খেলার কিছু সঙ্গী, সে সেখানে তুমি অজস্র পাবে। তুমি তো কুটি বাচ্চা একটা, হাসলে!

আসলে লুব্ধক তুমি চাইতে পার কিন্তু সেটা কিন্তু উজ্জ্বলতম ৫০টা নক্ষত্রদের দলে নেই, তাদের চেয়ে কম উজ্জ্বল ওটা। আসলে কি বলত, রাতের আঁধারে যাকে উজ্জ্বল দেখায় আমরা তো তাকেই বলি উজ্জ্বলতম। বাস্তব তা নয়। তার মানে চোখ আসলেই সব সময় ঠিক বলে না।

শোন আমি ঠিক করেছি সেই পঞ্চাশটা তারার মধ্যে যে সবচেয়ে দূরতম কিন্ত মিষ্টি একটা নামের অধিকারী আমি তোমাকে সেটাই দিব। আর দিতে গিয়ে বর্ণনা করব সে নক্ষত্রটা কতটা পয়মন্ত। অহ, পয়মন্ত শব্দটা খুব কঠিন হয়ে গেল তো, বেশ, সে খুব ভাগ্যব, ভাগ্যব শব্দটা তুমি আগে শোনোনি! শুনবে কি ভাবে! এই তো প্রথম লিখলাম, বতী বা বান এড়ালাম। সারাক্ষণ এত জেন্ডার ইসু ভালো লাগে না সোনা! এবার তোমায় যখন নক্ষত্রটা দিতে যাব তুমি ভাববে যাহ, নক্ষত্র আবার কেউ কাউকে দিতে পারে নাকি! আমি হয়তো ভাবব যে তুমি ব্যাপারটাকে খুব তাচ্ছিল্য করছ, কিন্তু আসলে তো তা নয়। তুমি আসলে বুঝে নিতে চাইছ ব্যাপারটা আসলে কি।

এখন তোমাকে একটা কথা বলি, আমি কোনো দিন ভোরে ঘুমাতে পারি না, সেই ছোটবেলা থেকে। তুমি কাছে থাকলে তোমাকেও ভোরে টেনে তুলে গান গাইতাম, তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে... ভোরে ঘুমায় খুব ভাগ্যহীনারা। কেন এ কথা বলছি! ভোর হলো দিনের সবচেয়ে সুখীতম সময়। সুখ মানে তো জানো, সুখ মানে হলো তৃপ্তি, মানে তুমি বিমোহিত হয়ে বলবে এত সুন্দর! তো সেই সময়টা যখন তোমার কাছে থাকে তখন তুমি সুখী, যাবতীয় কলহ কি কুৎসা থাকা সত্ত্বেও ভোর সব সময় এগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে তোমার সাথে ফিসফিস করে কথা বলবে, সুখের কথা বলবে আর সুখের জন্যই তো এত কিছু!

হ্যাঁ, সেদিন হঠাৎ আমার মনে হলো রাতে আমার ঘুম পাঁচ ঘণ্টা হয়েছে, পাঁচ ঘণ্টা ঘুমালে আমার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে, এটা যে করোনাকাল সোনা! এখন খাদ্য ঘুম মানসিক বল সব ঠিকঠাক রাখা চাই যাতে যদি সে দুষ্টু শয়তান চলেই আসে তাকে যেন বধ করতে পারি। তো আমার আরো দুই ঘণ্টা ঘুমাতে হবে ঘুমের কোটা পূরণ করতে হলে। ভোর দেখা আমার হয়ে গেছে। জানালায় চড়ুই এসে কিচকিচ করে গেছে, দুটো কবুতর আমার দেওয়া পানি পান করে গেছে কলের নিচে মাটির ভাড়ে, ছাদের বেলির সুবাস আমার হৃৎপিণ্ড ছুঁয়ে মোহনীয় অবকাশ মিশে গেছে অসীমে আর একটা দোয়েলও তীক্ষ্ন চঞ্চু দিয়ে শিষ দিয়ে গেছে আর আমার রান্নাঘরের পাশে যে গভীর সবুজ আশাবাদী লতাটা জড়িয়ে জড়িয়ে উপরে উঠছিল ছাদে, সেও মুচকি হেসে সম্ভাষণ করেছে। জানো ওরা সব সময় আমায় মুক্তির আলো দিয়েছে কখনো শিকল দেখায়নি। এই ভোরটুকুর জন্য আমি রোজ বাঁচি রোজ জাগি, সত্যি!

তো ঘুমাতে গিয়ে দেখি ওমা সে আমার সিথানে ঘাঁপটি মেরে বসে আছে, মানে নিদ্রাদেবী। ঘুমালাম, ঘুমিয়ে পড়তেই এক বাগানবিশারদ আমার কাছে এসে বসে, কি না সে আমার সাথে দেখা করতে চায়, আমি এত খুশি হয়েছি। কারণ কি জানো! সে আমার সাথে ভার্চুয়াল জগতের একজন, তার অনেক বড় বাগান, সব আছে সেথায়, এমনকি জলপাই আর আমলকি গাছও। সে এই সব গাছের ছবি পাঠিয়েছে সারা বছর আমার চিঠির বাক্সে। না, সে সব আমাদের কলোনির সিঁড়িঘরের সেই কাঠের লেটার বক্সের না, সেসব আর নেই সোনা। ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে। তুমি তো আমার সম্পর্কে কিছুই জানার অবকাশ পাওনি, তাই এত কথা বলেই চলেছি। তো আমি সমতটের মেয়ে বলে আমার এলাকায় চালতা খুব থাকলেও জলপাই খুব বিরল গাছ হেথায়, তার বাগানে জলপাই গাছও আছে! জলপাই আমলকি ঝাঁপিয়ে ধরে থাকে, এই ছবি সে পাঠায়। কলাগাছে থোড় এলে তার ছবিও পাঠায়। ওর বাড়িটার পিছনে একটা ক্ষীণতোয়া নদী, নদীর কথা থাক তোমার খুব মন খারাপ হবে। বর্ষায় অবশ্য কিছুটা ভরে ওঠে, তখন সেটারও ছবি পাঠায়, সুন্দর। আমি তাকে অন্তর থেকে আপা আপা করি। তো তাকে পেয়ে আমি এত খুশি হলাম যে তাকে বললাম আপনাকে আমি একটা নক্ষত্র দিতে চাই। সে বলল লুব্ধক! আমি বললাম না, সেটা নয়। এরচেয়ে উজ্জ্বল যে পঞ্চাশটা নক্ষত্র আছে তাদের একটা দেবো। সে খুশি হয়ে বলল নাম বল। আমি বললাম নাম তো এখনো ঠিক করিনি। আজকে রাতে নাম ঠিক করব। দুটো নক্ষত্র খরচ করব, একটা আপনাকে দেবো আর একটা আহনাফকে। সে বলল, কে আহনাফ! আমি বললাম আছে একজন, সে আমায় চেনে অল্প, আমি খুব চিনি। নক্ষত্রগুলোর নাম ঠিক করে নেই, আপনি কাল ভোরে এলেই নিয়ে যেতে পারবেন। আর হ্যাঁ, আসার সময় আপনার বাগান থেকে আমার জন্য একটা ফুল আনবেন, সে লিলি কি সেফালি কি বেলি। আপা খুব খুশি হলো। খুশি হবে না বলো, একটা নক্ষত্র দেবো!

পরদিন ভোরে আপা এলো না, পরদিনও না। আমি ঘুমের কোটা পূরণ না করে অনেক বেলা পর্যন্ত বসে আছি ছাদের বোগেনভেলিয়ার ঝাড়ের কাছে, নামগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, নক্ষত্র দুটো ভীষণ খুশি যে তারা দুজনের কাছে বেড়াতে যাচ্ছে, এই প্রথম তাদের ভ্রমণ। ওরা নিজেদের নাম জানতে চাইছে, বললাম একজন নীলফড়িং আর নীলপ্রজাপতি। কেমন নীল! রঙটা প্যাসিফিকের নীল, প্রশিয়ান ব্লু কিংবা গভীর ভেলভেট নীল। ওরা বলে নীল কেন! বললাম এই পৃথিবীর অনাচারের বদলা নিতে নীল, এখন থেকে যাকে যা দেবো তার রঙ হবে নীল। এটা অনাচারের প্রতিবাদ।

অনেক বছর আগে, মানে আহনাফ পৃথিবীতে আসারও বছর খানেক আগে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। একটা সমুদ্র, যার মাইলখানেক পর্যন্ত হাঁটু কি কোমর পানি, ঐ যে উড়িষ্যার চাঁদিপুরের বে অব বেঙ্গলের মতো, যত গভীরেই যাও কোমরের ওপর পানি নেই, সেবার থাইরয়েড ফেলে দিয়ে বেড়াতে গেলাম সমুদ্রে, সেই দেখা চাদিপুর সৈকত। চাদিপুরই মনে এসেছিল, এর অনেক গল্প শুনেছিলাম, বাঘা যতীনকে নিয়ে, সে গল্প অন্যদিন। তো আমি অনেক কষ্ট করে ঢেউ ভেঙে অনেকদূর গেলাম, কোমর পানি হলো আর ওমনি একটা ঢেউ এনে আমায় তীরে ফেলে দিলো, এমন বারবার হচ্ছিল। কিন্তু তলিয়ে যাওয়ার ভয় না থাকলে কি হবে পায়ের নিচে বারবার কি সব আমায় পেঁচিয়ে ধরছিল, আমি ভয়ে পা তুলে নিলে ভেসে যাওয়ার মতো হচ্ছিল। পরে দেখলাম কয়দিন আগে যে হাজার হাজার দুর্গা ডুবিয়েছে তার খড়, দড়ি আর কাপড় আমাকে পেঁচিয়ে ধরছে কখনো টেনেও নিয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, স্বপ্নের সেই সমুদ্রের পানির রং এই বে অব বেঙ্গলের মতো ঘোলা নয়, নীল আর একদম স্তব্ধ পানি, ঢেউহীন। ঢেউহীন পানির একটা অসহ্য হিংস্রতা থাকে, যেন সে অপেক্ষা করছে কঠিন কিছু বলার জন্য। আমি জনমানবহীন সে পানিতে নেমেছিলাম কোন সাহসে! নেমে হেঁটে হেঁটে বহুদূর গিয়েছিলাম। বলা হয়নি সেটা রাতের সমুদ্র কিংবা ধর সন্ধ্যার একটু পর, ছোটবেলায় এই সময়টা খুব অসহ্য ছিল, খেলা শেষ করে মাঠ থেকে ফিরছি, ফিরতে ফিরতে আজান শেষ হয়ে গেছে, পথে কেউ বলছে বাড়ি যাও মজা বুঝবা! মজা মানে মারধরের মজা, বুঝেছ তো! স্তব্ধ সমুদ্র, আমি নামছি, নেমেই যাচ্ছি। আমার সাথে কেউ ছিল না, কিছুই ছিল না। শুধু নীল, প্রুশিয়ান ব্লু। আমি বহুদিন স্বপ্নের সেই সমুদ্রকে বুকে নিয়ে ছিলাম, আমি জানতাম, বুঝতে পেরেছিলাম স্বপ্নটা কেন আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে না। কোনো একটা সংবাদ এই স্বপ্ন বয়ে আনবে, কঠিন কিছু তাই ঘাপটি মেরে আছে। কয়েক মাস পর হলো সে সংবাদ, আহনাফ এলো আবার চলেও গেল চৌত্রিশ দিনের মাথায় সবাইকে কাঁদিয়ে, মায়ের কোল না, এনআইসিইউ ছেড়ে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বহুদিন আমি সেই সমুদ্রকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছি, বলেছি, তুমি এই বার্তা বয়ে এনেছিলে!

পুরো জানুয়ারির প্রবল শীতের ভোর জাগিয়ে তুলত আমাদের। বারিধারার কোকাকোলার সেই ভাঙা রাস্তা দিয়ে ছোট্ট বোতলে তোমার মায়ের বুকের দুধ যাচ্ছে হাসপাতালে তোমার জন্য, কোনো দিন তোমার বাবা, কোনো দিন তোমার নানা। দিনের পর দিন, চৌত্রিশ দিন। তুমি সুস্থ, সবার চেয়ে সুস্থ এনআইসিইউতে কেউ নাই, তুমি নাকি বাবার আঙুলও ধরেছ, আহারে বাচ্চা! কিন্তু তোমায় ছাড়ে না হাসপাতাল, তোমার ওজন কম তোমায় নাকে খাওয়ায়, ওজন বাড়াতে দুধ আনানো হলো সিঙ্গাপুর থেকে, সেই হলো কাল। বেশি খাইয়ে নাড়িতে ঘা বানিয়ে ফেলল বেকুব নার্সরা, তারপর বেহুদা অস্ত্রপচার, আর কি সামলানো যায় তোমাকে সোনা! সব ভেসে গেল সেই নীলে। চল ছাদে উঠে দুজনে লাফ দেই... তোমার বাবা-মা বলেছিল! স্বপ্ন আর তুমি এইভাবে একই বছরে একটা শীতবসন্ত জুড়ে ঘুরে ঘুরে স্থিত হলে। অনেক কষ্টে তোমার জন্য নক্ষত্র নির্বাচন করেছি, নেবে না!

বাগানবিলাসী আপার নক্ষত্রটাও মজুত আছে, এই অবরুদ্ধতায় কিভাবে যাই উচ্চধারা অম্লজানে বেঁচে থাকা হাসপাতালের শীতল ভিতরে! আমি তো ভূত নই যে ওখানে অবাধে ঢুকে পড়তে পারি। আপার কপালে হাত রেখে বলব আপা আর চিন্তা নাই, আমি জিনিসটা দিতে এসে গেছি, আপনি তো উজ্জ্বল রঙ খুব পছন্দ করেন, ফিরিয়ে দেবেন না দয়া করে। পারি না যেতে, হতাশায় আমি আকণ্ঠ ডুবে থাকি। শুধু ভাবি শ্বাসকষ্ট আর নিঃসঙ্গতায় ডুবে থাকা আপা এখন নক্ষত্রটা পেলে কত না খুশি হতো! জানো তো পৃথিবীর মানুষ এখন ভালোবেসে নক্ষত্র দেয়ানেয়া করে! মানুষের মন বড়ো হচ্ছে!

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া