X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৃহস্পতি পণ্ডিতসমাচার : সুখচার্বাকের জন্মকথা

শিমুল মাহমুদ
০৩ মে ২০২১, ০০:০০আপডেট : ০৩ মে ২০২১, ০০:০০

[খ্রিষ্টপূর্বাব্দ প্রেক্ষাপটে ভারতীয় দর্শনাশ্রিত সমকাল-উদ্দীপক আখ্যান]

যদিও ক্রোধ-আক্রান্ত আলেকজান্ডার ভারতীয় যোগীদিগের প্রতি অবজ্ঞাবশত আটকাদেশ দিয়েছিলেন তথাপি এক্ষণে আলেকজান্ডারের চোখে কৌতূহলদীপ্তি স্পষ্ট। দীর্ঘ মেরুদণ্ডধারী কৃষ্ণকায়া সুখচার্বাক প্রশান্তচিত্তে শ্বাস গ্রহণের পর অতি ধীরে গ্রহণকৃত সেই ভরাট শ্বাস ত্যাগপূর্বক সরাসরি আলেকজান্ডারের কৌতূহলদীপ্ত চক্ষুদ্বয়ের ওপর তাকালো। ধূসর অথচ ভরাট সেই তাকিয়ে থাকা। অতঃপর সকলের প্রতি মঙ্গলসূচক ধ্বনি ‘জীও ভদ্রে’ উচ্চারণ শেষে মস্তক না নুইয়ে প্রস্থান-উদ্দেশে স্থিরচিত্তে পদসঞ্চালনে আগ্রহী।

আলেকজান্ডার কর্তৃক নির্দেশিত হয়েছিল ভারতীয় যোগীদিগের মধ্যে প্রতিজন নিকৃষ্ট উত্তরদাতা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এক্ষণে আলেকজান্ডার বিচারকের কাছে এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলে বিচারক দ্বিধান্বিত কণ্ঠে, প্রত্যেকেই প্রত্যেক অপেক্ষা নিকৃষ্টতর যুক্তি উপস্থাপন করেছে, এই মর্মে মতামত প্রকাশ করলেন। আলেকজান্ডার নিজ কর্তৃক মনোনীত রক্ষণশীল আত্মজাত অহমানুসারি বিচারকের প্রতি কোপদৃষ্টি ক্ষেপণপূর্বক ভারতীয় দার্শনিকদের জন্য উপহারসামগ্রী প্রদানের নির্দেশ দিলেন। অতঃপর বোধোদয় হলো, অতি শিগ্রই তক্ষশিলায় গিয়ে অধিকসংখ্যক দার্শনিকদের সঙ্গে মিলিত হওয়া আবশ্যক। আপাতত এতদ্বিষয়ে কোনো মতামত প্রকাশ না করে স্থান ত্যাগের উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়াতেই আলেকজান্ডার শুনতে পেলেন সুখচার্বাকের কর্কশ কণ্ঠ, সুখ প্রদায়ক উপহারসামগ্রীর প্রতি আগ্রহ থাকা সমীচীন; তবে, যদি তা পরিশ্রমলব্ধ হয়; জনাব আপাতত আমরা উপহারসামগ্রী গ্রহণে অনিচ্ছুক।

এহেন বাক্যশ্রবণের পাশাপাশি আলেকজান্ডার দার্শনিকগণের প্রস্থানপথে অধিকতর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। ভারতীয় যোগীগণ প্রত্যেকেই উলঙ্গ, শুধু একজন পৃথক, সুখচার্বাক, যার কিনা নিজেকে যোগীপুরুষের অন্তর্ভুক্ত বিবেচনায় অনীহা। সুখচার্বাকের কোমরে খর্বাকৃতির কার্পাসবস্ত্র অতিব্যবহারেও ভারি এবং খসখসে। আলেকজান্ডার দার্শনিকদিগের গমনপথে বিশেষ করে লজ্জাস্থান আবৃত পুরুষ, দীর্ঘকায় ও কর্কশকণ্ঠী সুখচার্বাক বরাবর তাকিয়ে রইলেন। আলেকজান্ডারের চোখে ক্রোধের পরিবর্তে চন্দ্রতুল্য দীপ্তি। প্রকাশ থাকে যে আলেকজান্ডারের নিকট সাহসী ও জ্ঞানী পুরুষ অধিক প্রিয়।

আলেকজান্ডারের নিকট থেকে ফেরার পথে সুখচার্বাক সতীর্থ নবমতম পুরুষের পশ্চাদ্দেশ অনুসরণপূর্বক মন্থর গতিশীল। পদক্রম যেন-বা কিছুটা শ্লথ। গতি নিবারক কাকরপথকে যেন-বা সহজাত উপেক্ষায় নির্ভার। বেশ কিছুদিন হলো সতীর্থগণ সুখচার্বাককে সতীর্থ বিবেচনা করে না। কেননা দীর্ঘদিন যাবত সুখ নিজেকে মন্ত্র থেকে দূরে রাখতে যত্নশীল, অধিকন্তু কার্পাসবস্ত্রের আশ্রয়ে লজ্জাস্থান গোপন-স্পৃহায় যত্নশীল, এমনকি নির্মোহ-নির্লোভ বিবেচনার প্রতি যত্নশীল হবার পরিবর্তে সুখ ও সুখপ্রদায়ক বস্তুপ্রতি অধিক আগ্রহী, মঠ ও মন্দিরবিমুখ।

অনিবার্যতই দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত নয়জন দীগম্বর যোগীপুরুষ সুখকে পিছে রেখে ক্রমশ অগ্রগামী। ক্রমশ উঁচু থেকে আরো উঁচু বরাবর ক্রমশ বর্তুলাকার টিলা। বর্তমান টিলাগাত্রে এলোমেলো পাথর ব্যতিত কোনো গুল্ম অথবা বৃক্ষের ছায়াপাত হয়তো-বা নিরর্থক। রহস্যে নিমজ্জিত প্রকৃতির নিকট ছায়াপাত অযৌক্তিক। সময় হয়তো-বা কাঠিন্যের প্রতি অধিক আগ্রহী। সন্ধ্যা নিমজ্জিত সময়ের এহেন আগ্রহের নিদর্শন এই পথপরম্পরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যুক্তিহীন সুখবিহীন বিশালাকৃতির পাথরপ্রপাত। কাঠিন্যে অবগাহনপূর্বক ক্রমশ সুখচার্বাক পাথরস্পর্শে বস্তুসুখে নিমগ্ন, ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতম প্রদোষপ্রাকৃতের জরায়ুর ভিতর সুখচার্বাক রহস্যাক্রান্ত। তার চোখে প্রশান্তি।

অবশেষে সুখ নভোমণ্ডলের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপণপূর্বক, অতঃপর ধীরে অতি ধীরে পাথরগাত্রে দৃষ্টি নির্দিষ্ট করল। শিলাখণ্ডে শক্তি লুক্কায়িত। আমি শক্তিপূজক নই, অথচ আমি চার্বাক, আমাকেই শক্তির সন্ধান করতে হবে। এক্ষণে শক্তি থেকে সুখপ্রাপ্তি সম্ভব কি না, এহেন জটিল জিজ্ঞাসায় সুখচার্বাকের মন আচ্ছন্ন হলে সহসা নিজেকে একাকী আবিষ্কার; অতঃপর একবিংশ বৎসরের অধিকজীবী খানিকটা দীর্ঘদেহের অধিকারী সুখ নামের পুরুষটি একখানা অপেক্ষাকৃত বৃহৎ শিলাখণ্ডের ওপর পশ্চাদ্দেশ সমর্পণ করল।

টিলার পাদদেশ, যেখান থেকে সংকীর্ণ পরিসর বাঁক নিয়েছে পাথুরে প্রশ্রবণের নির্ঝর প্রপাত বরাবর, সেই পাদদেশের দক্ষিণে বিশালাকৃতির নিকষ অন্ধকার রঙের শিলাদেহ অনুসরণ করে গুহা; সুখচার্বাকের মতো দীর্ঘাকৃতির পুরুষ মস্তক অবনত না করেই গুহাপথে এগিয়ে যেতে থাকে। দক্ষিণ হস্ত বরাবর শতমুষ্ঠি লম্বিত সর্প। চকচকে অন্ধকার প্রাচীন সর্পের দেহচর্ম থেকে গভীর মাদকতা প্রকাশক মস্তক উত্তেজক ঘ্রাণ প্রকাশ পাচ্ছে। সুখচার্বাককে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মস্তক উত্তেজক প্রাচীন সর্প। ক্রমশ ত্রিমুখি গুহাপথ। অতঃপর আবারো দক্ষিণে বাঁক নিতেই ক্রমশ প্রশস্ত, স্তরে স্তরে পাথর, মস্তক-ঊর্ধ্বে বর্তুলাকৃতি লিঙ্গাকৃতি যোনি-আকৃতি কচ্ছপাকৃতি বানরাকৃতি তেলতেলে সর্পাকৃতির শিলাখণ্ডের শরীর চুইয়ে নামছে জল। পূর্বপার্শ্বের গুহাশ্রয় অধিক প্রশস্ত; অতিদীর্ঘ সংকীর্ণ ঊর্ধ্বসীমা যেখান দিয়ে চুইয়ে নামছে চন্দ্রাভা, তীব্র অথচ পেলব। প্রশস্ত গুহাশ্রয়ের তলদেশে প্রশস্ত গোলাকৃতির চন্দ্র-প্রতিবিম্ব কিঞ্চিত দোলায়মান। উত্তরমুখো গুহাপথ থেকে আশঙ্কা-জাগ্রত গোঙানো শব্দসমেত ভেসে আসছে বজ্রবায়ু। আর এহেন বায়ুচন্দ্রালোকে পাথরবেদির ওপর ষড়মস্তক সর্প, পাত্থরপাটাতনের ওপর বিছানো রয়েছে প্রমাণাকৃতির পুস্তক। প্রাচীন ষড়মস্তকধারী সর্প লিখে চলেছে বাণী, ঐশীবাণী, অপৌরুষেয়।

জলের ওপর চন্দ্রালোকের বিপরীত প্রান্তে দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের পাথরদেহ পেঁচিয়ে রেখেছে আরো একটি প্রাচীন সর্প। দক্ষিণে এলোমেলো শিলাপাটাতনের ওপর একেকটি রাজমুকুট, প্রত্যেক রাজমুকুটের নিচে একেকটি ভারতীয় তীব্রধার নাতিদীর্ঘ বর্শা। সূর্যপূজারক আলেকজান্ডারের চোখ থেকে লোভের দীপ্তি গলে গলে পাথর বেয়ে চন্দ্রালোকিত জলদেশে মিলিত হচ্ছে। চন্দ্রপ্রভার সঙ্গে লোভের তরলে পা ভিজিয়ে সুখচার্বাক প্রাচীন গুহাপুস্তকের গাত্র থেকে চোখ সরিয়ে কর্কশচোখে তাকালো আলেকজান্ডারের দিকে; আর তখন আলেকজান্ডারের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, সূর্যাসূর্য পিতা বাহুবল স্নায়ুবল জ্ঞানবল প্রদায়ক পিতা তোমা হতে জীবনরস প্রাপ্ত আমি দেবপুত্র আলেকজান্ডার।

আর তখন প্রার্থনামন্ত্র শেষে সুখচার্বাক শুনতে পেল, ওহে কার্পাসবস্ত্র পরিহিত চার্বাক এসো আমাসঙ্গে সূর্যপূজায় মিলিত হও, এতে তোমার যশ বৃদ্ধি পাবে, এক্ষণে তুমি আমার প্রজ্ঞাপ্রদায়ক সহযোদ্ধা হও, আমি আলেকজান্ডার তোমাকে আদেশ করছি।

অতঃপর সুখচার্বাকের কণ্ঠ গমগম করে উঠলে গুহামধ্যে ধ্বনিত প্রতিব্ধনিত, পৃথিবীতে মৎকৃত কোনো পূজ্যবস্তু নাই, আমি চন্দ্র উপাসক নই, আমি সূর্য উপাসক নই এমনকি বসুন্ধধরায় মনুষ্য পূজনীয় কোনো দেবতা নাই, কোনো গুরু নাই, সুখচার্বাক গুরুবাদে আসক্ত নয়, তবে ওহে আলেকজান্ডার শুনেছি বসুন্ধরায় বৃহস্পতি নামধারী কোনো এক যুক্তিবাদী পুরুষ ছিলেন, দীর্ঘকাল যাবত বিগত হয়েছেন, তার প্রতি আমার বিস্তর আগ্রহ রয়েছে, তবে কখনো তার সাক্ষাৎ সম্ভব নয়, কেননা আমার জন্মান্তরে আস্থা নাই, এমনকি আমি পরজন্মের প্রতি কদাচিৎ বিশ্বাসী নই, এক্ষণে তোমার প্রতি আমার কোনোরূপ আতিশয্য আগ্রহ নাই, শুনেছি তুমি দেবপুত্র, মনুষ্য অস্ত্র তোমার দেহভেদে সক্ষম নয়, শুনেছি তুমি জ্ঞানীপুরুষ তথাপি তুমি ভূমিপিপাসু, রক্তপিপাসু, পরসম্পদলোভি, সমস্ত পৃথিবীর অধীশ্বর হবার আকাঙ্ক্ষা তোমার মজ্জাগত, এহেন আকাঙ্ক্ষাকে জ্ঞান বলা সমীচীন নয়, এহেন জ্ঞান সুখপ্রদায়ক নয়, এক্ষণে তুমি নিস্ক্রান্ত হও।

বৃহৎ শিলাখণ্ডের ওপর পশ্চাদ্দেশ আন্দোলিত হলো। শিলাগাত্র থেকে গাত্রোত্থানপূর্বক সুখচার্বাক স্বপ্নবিভ্রম দৃষ্টিপাতে টিলার ওপর থেকে প্রদোষাকাশে লক্ষ্যহীন। অতঃপর জলস্রোতজনিত শব্দরাশি অতিক্রমপূর্বক অধিক দূরে পাহাড়শ্রেণি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বনাঞ্চল যেখানে সীমাহীন অজস্র জীবনপ্রপাত। ভেসে আসছে কুক্কুটধ্বনি যেন-বা বনমোরগের লাল ডানার বিশ্রামশব্দ, বরাহ হুল্লোড়, হস্তিনীর পিছু পিছু শাবক হস্তিদ্বয়ের ক্রমশ গভীর বনাঞ্চল অভিমুখে যাত্রা। তথায় ঋষিকুঠির।

একদা বনভ্রমণ সমাপ্তে ঋষি কচ্ছপমুনি কুঠির অভ্যন্তরে প্রত্যাবর্তনপূর্বক পিপাষার্ত। জলভান্ড বরাবর অগ্রসর হতেই দেখতে পেলেন অর্ধভঙ্গ কলসির স্বচ্ছ জলের ওপর শায়িত হাস্যোজ্জ্বল মানবশিশু, বিলক্ষণ শুভচন্দ্র লালাটে দীপ্তমান। সহসা শিশুপুত্র নীরব, পরমুহূর্তেই হাস্যোজ্জ্বল হস্ত সঞ্চালনরত। কচ্ছপমুনি অনুধাবন করলেন এই শিশু মৃত্তিকাকলস থেকেই জন্ম নিয়েছে। সদ্য জলাধারজাত শায়িত হাস্যরত মানবশিশু স্বপ্নাবিষ্ট কণ্ঠে গান গাইছে। সঙ্গীতভাষ্যে প্রকৃতির রহস্যমগ্ন ছবি ঝলমলিয়ে উঠলে এক জোড়া সারসপক্ষী অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল শিশুমুখপানে; আর তখন ঋষিকুঠিরবাগানে বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়লে ময়ূরেরা পেখম উঁচিয়ে নৃত্যচঞ্চল। ময়ূরের নৃত্যচঞ্চল আওয়াজ ঋষিহৃদয়ে মূর্চ্ছনার সমাবেশ ঘটালে হাজার সূর্য পর সহস্র চন্দ্র পর ঋষি কচ্ছপমুনির কণ্ঠে জেগে ওঠে সঙ্গীত, ওহো-ও-ও মানবজীবন মায়া পাইছে মায়া-য়া-য়া, সুখ পাইছে, পাইছে অমৃত বচন, ও-ও-ও মায়া পাইছে মোর চারু বচন চারু চারু চারুবাক। ঋষিকচ্ছপমুনি সদ্য কলসিজাত শিশুর অমৃত বচন শ্রবণে যেন-বা দিশাহারা কিঞ্চিত উতলা। অতঃপর সুখসমাবেশের আতিশয্যে শিশুকণ্ঠে চারুবাক শ্রবণে কচ্ছপমুনি মনুষ্যশিশুর নাম প্রদান করলেন, সুখচার্বাক।

অদ্য স্বপ্নাবেশ থেকে জেগে সুখচার্বাকের সহসা কচ্ছপমুনির কথা মনে পড়ল। অদ্যাবধি বনাঞ্চল বেষ্টিত আকাশ অভিমুখে তাকিয়ে সুখচার্বাক ভাবতে থাকে কীভাবে তার জন্ম সম্ভব হয়েছে পানযোগ্য জলের আধারে মৃত্তিকা কলসির ভিতর। একদা কোনো এক পূর্ণিমাপ্রার্থনার রাশতিথির রহস্যাবেশে একান্তে তক্ষশীলার অধ্যক্ষ চার্ণবজিকে নিজ জন্মরহস্য বয়ান করলে চার্ণবজি বলেছিলেন শাস্ত্রানুসারে কলসজন্মও সম্ভব, ওহে ক্ষণজন্মা বৎস তোমালব্ধ প্রজ্ঞা সহস্র সহস্র বৎসর অন্তর ফলবৎ থাকবে, তোমার যুক্তিহীন জন্মরহস্য থেকেই একদা যুক্তিক্রম উন্মোচিত হবে।

সুখচার্বাক শিলাগাত্র থেকে উঠে দাঁড়ায়। আলেকজান্ডার সকাশে দর্শনবাক্য বিনিময় শেষে ওরা ফিরছিল। সতীর্থগণ অগ্রবর্তী। সুখ এখন একা, প্রকৃতি-আশ্রিত, অসময়ে স্বপ্নমুগ্ধ, দিন এবং রাত্রির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নির্জন টিলার ওপর একা। অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল শিলাবস্তুর আশ্রয়ে। আশ্চর্য হতবাক ব্যাকুল স্বপ্নদর্শন থেকে জেগে ওঠার পর সুখচার্বাক স্বপ্নদৃশ্যকে বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে টিলা থেকে ক্রমশ নেমে আসতে শুরু করল। গন্তব্য, টিলার পাদদেশ, যে পাদদেশ অগ্রসর হয়েছে দূরবর্তী ঝরনা অভিমুখে। টিলা-পাদদেশের দক্ষিণে সংকীর্ণ গিরিপথের ভিতরে ভয়সংকুল গিরিগুহা। সুখচার্বাক গিরিগুহা অভিমুখে হাঁটতে থাকে।

টিলাগাত্রে স্বপ্নে দেখা গুহা। সুখচার্বাকের আজন্ম পরিচিত গুহা। এই গুহাতেই রাক্ষসী মৃত্তিকা ঘটকি কর্তৃক সুখচার্বাক লালিত পালিত হয়েছে। ছায়াভরাট অন্ধকার মায়ায় ক্রমাগত এগিয়ে যেতে থাকে সুখ। এখানে শীতলঘন-স্বপ্ন এবং রাত্রিবাস্তব সমান্তরাল। স্বপ্নে প্রতিবিম্বিত বৃহদাকার সর্প। যদিও কোনো দিন এই বহুপ্রকোষ্ঠ গুহার কোথাও কোন সর্প দৃশ্যমান হয়নি। তাহলে স্বপ্নদৃষ্ট সর্প কেনই-বা তাকে যুক্তিহীন মোহগ্রস্ত ক্রমশ চিন্তামগ্ন করে তুলেছে? সুখের খানিকটা অস্বস্তি হয়। মস্তিষ্ককোটরে জাগ্রত হয় আলেকজান্ডারের দেহচ্ছবি। কী চায় এই বীরশ্রেষ্ঠ? প্রজ্ঞা, নাকি প্রভুত্ব?

এহেন মগ্নতার ভিতর অবশেষে দক্ষিণ প্রকোষ্ঠে স্তরীভূত শিলাখণ্ডের প্রাকৃত আয়োজনে শ্রমণ পারাবতকে যথারীতি উপবিষ্ট অবস্থায় দেখতে পেল সুখ। শ্রমণ ঘুম যায় না, যোগাসনে উপবিষ্ট বিরামহীন। শ্রমণ উলঙ্গ হলেও একখানা চওড়াকৃতির হরিণচর্ম দ্বারা ঊর্ধ্বাঙ্গ বেষ্টিত। বিরামহীন বনাঞ্চল-আশ্রিত লতাগুল্মবৃক্ষাদি রহস্যের ঔষধিগুণের সাক্ষাৎপ্রাপ্ত পারাবতের বসবাসহেতু এহেন গুহা তাদের নিকট পারাবতগুহা নামে পরিচিত। সুখচার্বাকের ধারণা প্রিয়সখা পারাবত অবশ্যই ওর নিজের মতো করেই ঘুমবিভোর, স্বপ্নবিভোর। তবে সুখের মতো শায়িত অবস্থায় নয় বরং পদ্মাসনে পারাবত ঘুমপ্রাপ্ত বিশ্রামপ্রাপ্ত স্বপ্নপ্রাপ্ত।

পারাবতের সম্মুখে ছোট কুণ্ডলাকার অগ্নিকুণ্ড। বৃক্ষবিশারদ পারাবত কর্তৃক সংগৃহীত দারুকাষ্ঠের ম্রিয়মান অগ্নি-আলোক থেকে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। শ্রমণ পারাবতের ললাট-প্রলম্বিত কেশরাশি মুখমণ্ডলের ভরাট দাড়িগুচ্ছের ভিড়ে ছড়িয়ে পড়লেও সেখান থেকে বনজ অন্ধকারতুল্য মোহগ্রস্ত দৃঢ়তা প্রকটিত। চক্ষুদ্বয় গোলাকার অথচ ভরাট ভাসাভাসা দীপ্তময় বনজ, যেন-বা কখনো খানিকটা বিষণ্ন মায়া-খসানো ঝিলিক, ঝিলিকদীপ্ত চাতুর্যের ভিতর স্বনির্ভরতা। সখা পারাবত বৃক্ষপরিবার-প্রতি আস্থাশীল, জীবকূল-প্রতি আস্থাশীল, মনুষ্য-প্রতি আস্থাশীল। পারাবত নিজ চক্ষুদ্বয় মেলে ধরল সুখচার্বাকের লালাট বরাবর। সুখচার্বাকের ললাটাঞ্চলে দ্বিধা ও ব্যাকুলতা। কেননা পারাবতের কোলে শায়িত বানরশিশু অচঞ্চল।

—সুখচার্বাক প্রিয়সখা আমার, সিদ্ধার্থ গৌতমের ন্যায় আমরাও অবগত আছি পৃথিবী দুঃখময়, তথাপি এক্ষণে এই বানরশাবকের কষ্ট সহ্যাতীত, সর্পদংশনে মৃত্যু নিকটবর্তী, সখা তুমি অন্তচেষ্টা করো, জীবন-চাঞ্চল্যের প্রত্যাগমন আদৌ সম্ভব কি না চেষ্টা করে দেখো, হতবাক হয়ো না বরং এক্ষণে গমন করো গভীর বনাঞ্চল বরাবর, যে প্রজ্ঞার কিয়দংশ তুমি আমা হতে প্রাপ্ত হয়েছ তা ফলপ্রসূ করার ক্ষণ নিকটবর্তী, অনুসন্ধান করো বিষমোচন গুল্ম।

সুখচার্বাক বানরশাবক বরাবর দক্ষিণহস্ত প্রসারিত করল। অতঃপর নিস্তেজ নিথর বানরশাবকের দেহ নিজ বক্ষের সন্নিকটে এনে বানরশিশুর মুদিত চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, যেন-বা চক্ষুচর্মের আড়ালে ক্ষুদ্রজীবনের চাঞ্চল্য অপেক্ষারত। সুখচার্বাক নিজ মধ্যমার স্পর্শে বানরশাবকের ডান চোখের পাতা উন্মুক্ত করার চেষ্টা করল। ক্রমশ ধীরে চোখের পাতা সরিয়ে ক্ষুদ্র বর্তুলাকার চোখের দৃষ্টি বরাবর তাকিয়ে যেন-বা খানিকটা মোহগ্রস্ত, কথা বলছে চোখ, বস্তুই জীবন।

সুখচার্বাক বানরশাবককে জড়িয়ে নিয়ে ক্রমশ অন্ধকার বরাবর গুহার পশ্চাদ্দেশে ক্রমশ সংকীর্ণ পথ অনুসরণ করতে থাকল। অতঃপর সার্ধশত পদ অতিক্রমণ অন্তর বামহস্ত বরাবর বাঁক ফিরে আরো খানিকটা শিলাকীর্ণ পথ পশ্চাতে পরিত্যাগ করে আসতেই ভেসে এলো জলপতনের শব্দ, বিরামহীন। রাত্রিকালীন। ইতোমধ্যেই চাঁদের আলো ক্ষীণ থেকে ক্রমশ স্ফটিক হয়ে উঠলে সুখচার্বাক নির্ঝর জলের দিকে অগ্রসর হল; হাতের তালুতে তুলে নিল জল। সেই রাত্রিকালীন পাহাড়ের শিখণ্ডি থেকে নেমে আসা শিলাঘর্ষিত জল, চন্দ্রালোকিত জল অতীব প্রযত্নে বানরশাবকের মুখগহ্বরে প্রবেশ করানো শেষে সুখ স্বয়ং জলপান করল। অতঃপর বানরশিশুসমেত নিজ দেহ ধৌত করে নিল। অবশেষে সুখচার্বাক অর্থহীন কোনো কিছু না ভেবেই বানরশিশুসমেত ক্রমশ সন্তরণরত, জলপ্রক্ষালনরত, আবারো সন্তরণরত এবং অবশেষে যেন-বা মোহগ্রস্ত প্রশ্রবণের বিপরীত তীরে জল-আক্রান্ত শিলাখণ্ডের ওপর খানিকটা সময়, খানিকটা চন্দ্রক্ষণ বিশ্রাম প্রাপ্তের পর দৃঢ় পদক্ষেপে বানরশাবকসহ অগ্রসর হলো। পাহাড়ি পাথরমৃত্তিকা কখনো-বা ঘাসমৃত্তিকা অতিক্রমপূর্বক বনাঞ্চল অভিমুখে ভেসজ গুল্মের সন্ধানে এবং অবশেষে কাঙ্ক্ষিত গুল্মের সন্ধান প্রাপ্তির পর সুখচার্বাক প্রয়োজনীয় গুল্মলতা সংগ্রহ করল।

সুখ একখানা বর্তুলাকার বিশাল পাথরের ওপর বানরশাবককে শুইয়ে দিলো। আরেকটি সমতল পাথরের ওপর লতাগুল্মগুলো রেখে পাথরটুকরো দিয়ে কিছু সময় যাবত লতাগুল্মসমূহ থেঁতো করে নিয়ে তৈরি করল প্রগাঢ় সবুজ কাথ। এবারে তৈরিকৃত সবুজ ভেসজ বানরশাবকের মুখে নিজ আঙুল দ্বারা ক্রমাগত প্রবেশ করিয়ে দেবার চেষ্টারত; এক পর্যায়ে বানরশিশুর ছোট্ট মস্তক ধরে মৃদু ঝাঁকানি দিতে থাকল। অবশেষে বানরশিশুর বাম পায়ের ক্ষতের মুখে লতাগুল্মের কাথ লেপনপূর্বক নাতিদীর্ঘ দুখানা লতিকা দ্বারা ক্ষতস্থান বেঁধে দিলো সুখ।

এবংবিধ কর্মাদি সমাপন শেষে রাত্রি প্রথম প্রহরে বানর শিশুর চোখে চোখ রেখে সুখচার্বাক প্রত্যাগমনেচ্ছা প্রকাশ করল। বানরচোখে জীবনচিহ্ন ক্রমশ বিদ্যুৎময়।

—বালক তোমার জীবন ন্যাস্ত রয়েছে প্রকৃতির ঐশ্বর্যে, অনুসন্ধান করো পেয়ে যাবে তাবৎ জীবনরস, এক্ষণে তোমার নাম রাখা হলো পণ্ডিত বৃহস্পতি। বিলক্ষণ বৃহস্পতি পণ্ডিত জেনে রাখো, তারকা-রহস্য না জেনে, সুখ-রহস্য না জেনে, তোমার-আমার মৃত্যু নাই।

এবং এক্ষণে বানরশাবকের প্রতি এহেন বাক্যবর্ষণ শেষে সুখচার্বাক শ্রমণ পারাবতের গুহার সন্ধানে প্রশান্ত চিত্তে প্রত্যাগমন আয়োজনে উদ্যোগী হলো। অবশেষে বানর বৃহস্পতি এবং সুখচার্বাক উভয়েই পারাবত গুহায় প্রত্যাবর্তন পর শ্রমণ পারাবাত পাহাড়ি কাঠাল, পাহাড়ি কদলি, রঙিন করমচাসহ ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের ব্যবস্থা করল। কদলি ভক্ষণরত বানরবৃহস্পতিসহ জীবনপ্রদায়নী রাতটুকু সুখচার্বাক পরাবাত শ্রমণের সান্নিধ্যে গুহাবাসে নিদ্রাকালে ওহম শান্তি, প্রকৃতি মাতার ক্রোড়ে সুসুপ্ত সুখনিদ্রা। যেন-বা সহস্র রাত্রিব্যাপী চন্দ্রনিদ্রা, লক্ষরাত্রিব্যাপী সূর্যনিদ্রা। সেই রাতে গুরুজি বৃহস্পতি সুখচার্বাককে স্বপ্নে দেখা দিলেন।

মধ্যনিদ্রার বিহ্বলতায় সুখচার্বাক স্বপ্নপ্রাপ্ত হলো। বানরশাবক সহসা বৃহদাকার দীপ্তদেহে সুখ সকাশে জ্ঞানলোকে দীপ্তময়। বানরবৃহস্পতি বলছেন, প্রিয় ভারতসন্তান, শুনে রাখো ওহে রাক্ষসপুত্র এই ভূভারত অন্ধকারময়, জগৎ দুঃখক্লান্ত, ওহে অনার্য রাক্ষস জেনে রাখো যাবতীয় দুঃখের নিমিত্ত আর্য, আর্য হতে সাবধান, শতহস্ত দূরে থাকো অপৌরুষেয় পাণ্ডুলিপি থেকে, বেদ বেদান্ত থেকে, এমন একদিন আসবে যখন ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় ধর্মপুস্তক মনুষ্যসন্তানকে কৃতদাস বানাবে, অসুখি করবে, বিনাশসাধন করবে, সুতরাং রাক্ষসজীবনের ভিতরই অনুসন্ধান করো মনুষ্যজীবন।

[সূচনাংশের পর : ট্রায়াল এডিশন : অসমাপ্ত]

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
বিতর্কের মুখে গাজায় ইসরায়েলি কার্যকলাপের নিন্দা জানিয়েছেন মালালা
বিতর্কের মুখে গাজায় ইসরায়েলি কার্যকলাপের নিন্দা জানিয়েছেন মালালা
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না