X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘বাংলাদেশে হোম আইসোলেশন অবাস্তব, অসম্ভব’

জাকিয়া আহমেদ
১৩ মে ২০২১, ১১:০০আপডেট : ১৩ মে ২০২১, ১১:০০

গত ১৮ মার্চ করোনাতে আক্রান্ত হন অতনু হায়দার। তিনমাস আগে আসা চাররুমের নতুন বাসাতে তার জন্য আইসোলেশন সহজ হয়েছে মন্তব্য করে অতনু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমার আগের বাসাতেও এটা সম্ভব হতো না। সেখানে তিনটা বেডরুম থাকলেও দুটো অ্যাটাচ বাথ ছিল বাবা মা এবং বোনের রুমে। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে সে বাসায় আমার পূর্ণ আইসোলেশন সম্ভব হতো না।

গত পাঁচ বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছেন সায়মা আক্তার । ৩৫ বছর বয়সী এই নারীর অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি শেষে সায়মা এখন কিছুটা সুস্থ। দুই সন্তানকে নিয়ে আরেকটি পরিবারের সঙ্গে সাবলেটে মালিবাগ বাজার রোডের এক বাসাতে থাকেন। তিনি করোনাতে আক্রান্ত হলে যখন তাকে আইসোলেশনে থাকার জন্য বলা হয় আসল বিপদটা তখন টের পান সায়মা আক্তার।

সায়মার বাবা আব্দুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আইসোলেশনে থাকার কথা বলে তো হাসপাতাল তার দায়িত্ব শেষ করলো কিন্তু মেয়েটা আইসোলেশনে কোথায় থাকবে সে চিন্তা কে করবে? ওরা থাকে দুই রুমের সাবলেটে। এদিকে, ওর সঙ্গে থাকা ছোট ছেলেকেও কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে। তার প্রশ্ন, এখন মা আইসোলেশনে কোথায় থাকবে আর ছেলেই বা কোয়ারেন্টিনে কোনখানে থাকবে?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লক্ষণ উপসর্গ গুরুতর না হলে করোনা আক্রান্ত রোগীকে হোম আইসোলেশনে রাখার কথা গাইডলাইনে বলা হয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষ, হোস্টেলে থাকা মানুষদের জন্য গাইডলাইনের এ কথা বাংলাদেশের মতো দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা বাস্তবসম্মত সেটা আমলে নেওয়ার দরকার ছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, কোভিড-১৯ রোগীদের শতকরা ৮০ শতাংশের হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তারা বাসায় থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চিকিৎসা নিলে সুস্থ হয়ে যায়। বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য হোম এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এবং প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে শুরু থেকেই জানিয়ে এসেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতর শুরু থেকেই হোম এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থার কথা জানিয়ে এসেছে, ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ান্টিনের সংখ্যা বেড়েছে বলেও জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে হোম আইসোলেশন এবং হোম কোয়ারেন্টিন কোনটাই কার্যকর নয় বলে মন্তব্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। একইসঙ্গে তারা বলছেন, দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য এই হোম আইসোলেশন এবং হোম কোয়ারেন্টিনের সঠিক ম্যানেজমেন্ট না থাকাও অন্যতম দায়ী।

রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আইসোলেশনের জন্য টাকা বরাদ্দ করতে হবে, জনবল দিতে হবে।

হাসপাতালে চিকিৎসক লাগবে, তবে এখানে চিকিৎসক লাগবে তার দ্বিগুণ মন্তব্য করে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, চিকিৎসক, হেলথ ওয়ার্কার এবং স্বেচ্ছাসেবকদের এখানে কাজে লাগাতে হবে।

আর স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যদি তাদেরকে সরকারিভাবে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব না হয়। যেমনটা করা হয়েছিল মিরপুরের টোলারবাগে, ওয়ারি বা পূর্বরাজারে যখন লকডাউন করা হয়েছিল। কারও লক্ষণ উপসর্গ দেখা দিয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের তথ্য সংশ্লিষ্টদের জানালে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা হবে পজিটিভ শনাক্ত হলে।

যারা বাসায় থাকবেন তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে, ছিন্নমূলদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন সেন্টারে নিয়ে আসতে হবে।

উপজেলাগুলোতে খুব ভালোভাবে এটা হয় জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ছিন্নমূলদের হাসপাতালেই নিয়ে আসা হচ্ছে কারণ সেখানে বেড শূন্য থাকে।

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, নিম্নমধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের হোম আইসোলেশনের অবস্থা নেই এবং এটা খুবই প্রাকটিক্যাল কথা। এসব মানুষের তো আলাদা রান্নাঘরই নেই, একই ঘরে তারা থাকেন এবং গ্যাসের চুলায় রান্না করে। তারা তো ঘরের ভেতরেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো অবস্থাতে নেই, তারা হোম কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন কীভাবে করবেন।

তিনি বলেন, স্বল্প আয়ের, অনিশ্চিত আয়ের মানুষ, যারা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতে থাকেন তাদের জন্য এটা কোনওভাবেই সম্ভব নয়।

যাদের লক্ষণ মৃদু তাদের হাসপাতালে না রাখার জন্য আমরা বলছি, কিন্তু তারা যাবেন কোথায় একই প্রশ্ন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরও। মুশতাক হোসেন বলেন, তাদের জন্য ঘরটা কই?

স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য ও জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সালের মতে, বাংলাদেশের মতো দেশে হোম আইসোলেশন অবাস্তব ও অসম্ভব। হোম আইসোলেশন সম্ভবপর না।

কেন সম্ভব না প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দুই রুমের ভাড়া বাসায় ছয় সদস্যের পরিবারে একজন যদি করোনাতে আক্রান্ত হয় তাহলে তাদের পক্ষে কোনওভাবেই আইসোলেশন সম্ভব নয়, এটা অসম্ভব।

বাথরুম একটা, বাকি কোথায় যাবে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, আইসোলেশনে বলা হচ্ছে বাথরুম আলাদা করবেন, থাকবেন আলাদা, আলাদা খাবেন। কিন্তু এটা কি বাংলাদেশের মতো দেশে সম্ভব? কেবল সবকিছু তাত্ত্বিকভাবে বলে দিলেই হয় না, তার বাস্তবায়ন কী করে হবে সে সর্ম্পকে বাস্তবজ্ঞান থাকতে হবে।

এই দেশে আইসোলেশন সম্ভব না এমনকী কোয়ারেন্টিনও সম্ভব  না জানিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে বারবার মতামত দিয়ে এসেছেন প্রাতিষ্ঠানিক হোম আইসোলেশনের জন্য। কিন্তু সে মতামত আমলে নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ আবু জামিল ফয়সালের।

তিনি বলেন,  প্রথম দিকে এটাও মতামত দিয়েছিলাম, হাজার হাজার স্কুল-কলেজ বন্ধ রয়েছে। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু আমাদের কথা শোনা হয়নি, বিশেষজ্ঞ মতামত আমলে নেওয়া হয়না।

এর জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করার দরকার ছিল, যেখানে কেউ মনোযোগ দেয়নি, কেউ খুঁজেনি। কিন্তু এই যে কাজটা করতে হবে, খুঁজতে হবে-এটা করা হয়নি। আর তখনই এটা শিথিল হয়ে গেছে। এর তদারকি কেউ করেননি।

তিনি আরও বলেন, সমস্যা স্তরে স্তরে। কেবল একটি স্তরে না। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়, যখন কোনও জবাবদিহিতা না থাকে-এটাই আমাদের সবচেয়ে জটিল এক দূর্বলতার জায়গা। সারাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরার পেছনে হোম আইসোলেশন সঠিকভাবে না হওয়া অনেকাংশেই দায় বলে দাবি করেন তিনি।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সবাই বলছিল, প্রথম ঢেউয়ের সময় আমরা শিক্ষা পেয়েছি সেটা পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিকল্পনা করা হবে, ভালো কিছু করা হবে। কিন্তু সেই সময় আর এলো না যে পরিকল্পনা করা হবে, কল্পনার জায়গাতে কল্পনা রয়ে গেল, পরী তার মতো উড়ে চলে গেল, বলেন।

প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এমনও দেখেছি যে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষ বেড়াতে গেছে, পিকনিকে গেছে এমনকি বিয়েও করেছে। এককথায় হোম কোয়ারেন্টিন কোনও কাজের জিনিস না।’

 

/এফএএন/
সম্পর্কিত
আইসোলেশনে নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী
করোনা সন্দেহভাজনদের ধাতব বাক্সে রাখছে চীন (ভিডিও)
কোয়ারেন্টিন থেকে পালিয়েছেন ইতালি-ভারত ফ্লাইটের ১৩ যাত্রী
সর্বশেষ খবর
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা