X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনায় ভারতের গ্রামে গ্রামে ‘অজানা মৃত্যুর‌’ চিত্র

বিদেশ ডেস্ক
০৯ জুন ২০২১, ১০:২১আপডেট : ০৯ জুন ২০২১, ১০:২১

কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারত। হাসপাতালে জায়গা পাননি বহু রোগী। মৃতদের অনেককেই দাহ করার জায়গা মেলেনি শ্মশানে। কোভিডের উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেও মৃত্যুর আগে শত শত রোগীর কোনো চিকিৎসা তো দূরের কথা পরীক্ষা পর্যন্ত হয়নি। ঘরের ভেতরে বসেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। ফলে এসব মৃত্যু সরকারি তালিকাতেও জায়গা পায়নি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এখন নিশ্চিতভাবে বলছেন যে, সরকার কোভিডে মৃত্যুর যে হিসাব দিচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা গেছে।

বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মৃতের সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে ঢের বেশি বলে অভিযোগ উঠেছে। গ্রামের বাস্তব পরিস্থিতি কি, মৃত্যুর সংখ্যা চাপা দেওয়া অভিযোগ সত্য কিনা- সরেজমিনে তা অনুসন্ধানের জন্য দিল্লিতে বিবিসির বিকাশ পাণ্ডে এবং অনশুল বর্মা গিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কয়েকটি গ্রামে।

বিবিসি-র সংবাদদাতারা তাদের অনুসন্ধানের জন্য প্রথম যে গ্রামটিতে যান তার নাম কৌশল্যা। দিল্লি থেকে ১০০ কিলোমিটারের মতো দূরের এই গ্রাম থেকে প্রচুর লোকজনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে।

সংবাদদাতারা গ্রামের অনেক সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন গ্রাম পঞ্চায়েতের নেতাদের সঙ্গেও। কৌশল্যা গ্রামের সমাজকর্মী মুস্তাফিজ খান হাতে লেখা একটি লিস্ট দেখিয়ে বলেন, সরকার যা বলছে তাদের গ্রামে মৃত্যুর সংখ্যা তার কয়েক গুণ বেশি। গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য আবরার বললেন, কোভিডের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর শিকার এসব মানুষের অধিকাংশেরই কোনও পরীক্ষা হয়নি। ওষুধপত্র বা চিকিৎসাও তারা পাননি।

গ্রামের বাসিন্দা শফিক আহমেদ পেশায় একজন আইনজীবী। তিনি জানালেন, ওই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ হয় দিনমজুর না হয় কৃষক বা কৃষি-শ্রমিক। ফলে খুব কম লোকই শহরে গিয়ে কোনও বেসরকারি ল্যাবে কোভিড পরীক্ষা করিয়েছে। গ্রামের একটি সড়কে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কথা বলেন বিবিসির সংবাদদাতারা। জানতে পারেন, প্রতি দুই বাড়ির অন্তত একটিতে এক বা একাধিক মানুষ কোভিডের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। গ্রামের ফারমান, সালমান ও জাহিন তাদের মা ও বড় ভাইকে হারিয়েছে। বাড়ির দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শোকাহত তিন ভাই-বোন বিবিসির সঙ্গে কথা বলেন।

ফারমান বলেন, ‘যেদিন আমার ভাই মারা গেলেন, সেদিন গ্রামে ৯ জন মারা গিয়েছিল। কয়েক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলাম ভাইকে। সব জায়গাতেই বললো বেড নেই, অক্সিজেন নেই। তাদের করার কিছু নেই। ভাই শ্বাস নিতে পারছিলেন না। আতঙ্কে আমরা অক্সিজেনের জন্য নানা জায়গায় ছোটাছুটি করেছি।’ কিন্তু ভাই মেহমুদকে বাঁচাতে পারেননি তারা। একই পরিণতি হয়েছে তাদেরও মায়েরও।

সালমান বললেন, ‘ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ বড় হাসপাতালে তো জায়গাই ছিল না। ভেন্টিলেটর খালি ছিল না। দরজা থেকেই তারা আমাদের পাঠিয়ে দিতো।’ দুই ভাইয়ের কোলে ছিল বড় ভাইয়ের দুই বাচ্চা- একটি ছেলে, একটি মেয়ে। ফারমান বললেন, ‘কে দেখবে এদের? সরকার কি কোনও দায়িত্ব নেবে? আমাদের নিয়ে যে সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই, তারা কি এই দুই শিশুর দায়িত্ব নেবে?’ তাদের বোন জাহিন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘সরকারকে কিছু তো ভাবতে হবে। এই বাচ্চা দুটোর সামনে পুরো জীবন পড়ে রয়েছে।’

কৌশল্যার পরে কানৌজা নামে উত্তরপ্রদেশের আরেকটি গ্রামে গিয়েছিলেন বিবিসির সংবাদদাতারা। একই কাহিনী সেখানেও। বহু মানুষ কোভিডের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। কিন্তু তাদের পরীক্ষা হয়নি, চিকিৎসা হয়নি। কানৌজা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য উমেশ শর্মা একটি খাতা বের করলেন যাতে তার গ্রামের কোভিডে মৃতদের নাম লেখা রয়েছে। বললেন, ‘এদের মধ্যে এক বা বড় জোর দুই জনের নাম সরকারি হিসাবের মধ্যে গেছে। বাকি ৩০-৫৫ জনের কোনও হিসাব নেই।’

দুই গ্রামেরই লোকজন বললেন, এপ্রিল এবং মে মাসে কোভিড সংক্রমণ যখন চূড়ায় ছিল, গ্রামের সরকারি স্বাস্থ্য ক্লিনিক অচল ছিল। প্রতিটি গ্রামে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে একজন ডাক্তার থাকার কথা, নার্স থাকার কথা। কিন্তু কৌশল্যা গ্রামের প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নির্মাণ কাজ চলছে। কোনো ডাক্তার বা নার্স নেই। শুধু কয়েকজন শ্রমিক বসে রয়েছে। গ্রামবাসীরা বলছেন, সরকারি এই চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে শুধু যদি কিছু অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকতো তাহলেও অনেকগুলো প্রাণ হয়তো বাঁচতো।

নদীর ধারে সারি সারি কবর

উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ শহরের কাছে গঙ্গার তীরে শত শত নতুন কবরের সারি। দাহ করার জন্য শ্মশানে জায়গা হয়নি বলে মানুষজন মৃত স্বজনদের এখানে এনে মাটি চাপ দিয়ে চলে গেছে। কবর দেওয়ার এসব ঘটনা ঘটেছে প্রধানত এপ্রিল মাসে। এলাহাবাদে কবর প্রসঙ্গে কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে মৃতদেহ না পুড়িয়ে নদীর পাশে কবর দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে স্থানীয় অনেক মানুষ এবং সাংবাদিকরা বিবিসিকে বলেছেন, এ বছর এই কবর দেওয়ার সংখ্যা অস্বাভাবিক মাত্রায় বেশি। স্থানীয় শ্রীংভেরপুর শ্মশানের পুরোহিত লবকুশ মিশ্র। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘এই একটি জায়গাতেই এ বছর ২৪০০ থেকে ৩০০০ লোককে কবর দেওয়া হয়েছে।’

এলাহাবাদের কাছে মেনডারা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান বিবিসিকে জানান, তার গ্রামে ডজন ডজন মানুষ কোভিডের লক্ষণ নিয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। মহেশ্বর কুমার সোনি বলেন, মৃত এসব রোগীর কখনও কোভিডের পরীক্ষাও হয়নি। গ্রামে এই হারে মৃত্যু আমরা জীবনেও দেখিনি। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মেনডারা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান বলেন, সরকারের উচিৎ তদন্ত করে কোভিডে মৃতদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। গ্রামের মানুষজন বলছেন, বহু মানুষ যে কোভিডের পরীক্ষা বা চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন সরকারের উচিৎ তা অন্তত স্বীকার করা। তাতে অন্তত সেসব মৃত মানুষদের কিছুটা মর্যাদা দেওয়া হবে। সূত্র: বিবিসি।

/এমপি/
সম্পর্কিত
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভোটের ওপর নির্ভর করে না: সাকি
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা