X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

বব কফম্যানের কবিতা

অনুবাদ : মঈনুস সুলতান
০৩ জুলাই ২০২১, ১১:০৮আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২১, ১১:০৮

কবি বব কফম্যান (১৯২৫-১৯৮৬)-এর জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরল্যন্স নগরীতে। তাঁর পিতা জার্মান বংশোদ্ভূত ইহুদি ও মা ছিলেন রোমান ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বি একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। তরুণ বয়সে কবি সামান্য দিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্চেন্ট মেরিনে কাজ করেন, নিউইয়র্কের নিউস্কুলে সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করেন, তারপর বসবাস করতে শুরু করেন নসিসকো নগরীতে; ওখানে তিনি কবি এলেন গিন্সবার্গ ও লেখক গ্রেগরি করসো, লোরেন্স ফারলিংহেটি প্রমুখের সঙ্গে মিলেঝুলে বিট জেনারেশন নামে খ্যাত সাহিত্য আন্দোলনের নানাবিধ তৎপরতায় যুক্ত হন।
‘বিট পোয়েট’ নামে সমধিক পরিচিত এ কবির কবিতা যুগপৎ জ্যাজ ঘরানার সংগীত ও পরাবাস্তব ধারার স্বপ্নাচ্ছন্ন বাস্তবতাভিত্তিক প্রতীক ও চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ। কবি মূলত কফিহাউস, পানশালা কিংবা রাজপথে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করে লোকপ্রিয় হন। চারণকবিদের মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে কবিতা রচনা করা তাঁর স্বভাব ছিলো, এ কারণে মুখে মুখে তৈরি পদাবলির এক ব্যাপক অংশ লিখিত হয়নি। তবে সিটি লাইটস্ বুকস্টোর তাঁর কিছু কবিতা প্রকাশ করলে বিট জেনারেশনের সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী পাঠক তাঁর কাব্যকলার সমজদার হয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্ট কেনেডি নিহত হওয়ার পরপর কবি কফম্যান ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ না হওয়া অব্দি মৌনব্রত পালন করার প্রতিজ্ঞা করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কলেজ ক্যাম্পাস ও কফিহাউসগুলোতে জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তাঁর দিনযাপনে দারিদ্র্য ছিলো অশেষ, অসক্ত ছিলেন ড্রাগসে, কারাগারেও অন্তরিন থাকেন বেশ কিছুদিন।
মৌনব্রত পালনের সময় থেকেই কবি নিজেকে সব ধরনের সামাজিক সম্পর্ক থেকে দূরে সরিয়ে সম্পূর্ণ একাকী দিনযাপন করতে থাকেন। এ অবস্থা জারি থাকে ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি চুক্তির দিন অব্দি। যুদ্ধ যে দিন শেষ হয়, সেদিন একটি কফিহাউসে হেঁটে গিয়ে আবৃত্তি করেছিলেন ‘অল দোজ শিপস্ দ্যাট নেভার সেইলড্’ নামক বিখ্যাত কবিতাটি।
১৯৭৮ সালে কবি সকলের ধরনের সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। স্বেচ্ছায় আইসোলেশনে যাওয়ার আগে তাঁর কবিতা সম্পর্কে আগ্রহী এক সম্পাদককে রচনা প্রকাশ করে খ্যাতিমান হওয়ার উচ্চাশা থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রবল বাসনা ব্যক্ত করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে বান্ধবী মেরি বিচের সংগৃহীত দুটি পুস্তক যথা ‘ওয়াচ মাই ট্র্যাক (১৯৭১)’ ও ‘গোল্ডেন সার্ডিন (১৯৬৬)’ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কবি বব কফম্যানের তিনটি কবিতার ভাবানুবাদ উপস্থাপিত হচ্ছে। কবিতাগুলো, বায়োবিষয়ক তথ্য ও কবির অলোকচিত্র ইন্ট্যারন্যাট থেকে সংগৃহীত।


বিশ্বাস

বিশ্বাস রাখো—আপেলের তরতাজা বীজ
নীলাকাশে বিকিরণ ছড়ানো নওল স্তনাঞ্চলে,
নীল স্যুট পরা পতঙ্গ সব—ছড়াচ্ছে
সমাজের পোশাক পরিচ্ছদে মড়কের বীজাণু
ভুলো না তাদের কপট ছলে।

জ্যাজ সংগীতের ঊর্মিমুখর শব্দে রাখো বিশ্বাস
যা ভাঙ্গাচোরা কাচের টুকরার মতো ছিঁড়েখুঁড়ে রাত্রি,
যৌক্তিক নকশায় বিন্যস্ত করে—জোড়া লাগায় ফের
লঘু হয় সামাজিক সন্ত্রাস,
কেটে তো গেল সময় ঢের—
যেন-বা অনিশ্চিত পথে হেঁটে যায় কোনো যাত্রী।

সাবধান হও—অসুস্থ সমাজের নিয়ন্ত্রক
নির্মাণ করছে শুধু প্রাণঘাতী বিষ্ফোরক;
তোমার শ্রবণে বেজে যাক
মৃত কবিদের আমোঘ উচ্চারণ,
দৃশ্যকল্পের ঘাসে ঝলসায় শিশিরের মণিহার
অবজ্ঞা করো বাক্যবাগিসের অযথা চিলচিৎকার,
খুলে ফেলো সম্পাদকীয়তে ছাতাপড়া বক্তব্যের বসন।

বইছে চারপাশে দূষিত সমীর
শোনো সংগীত—পুরানো প্রজ্ঞাময় শত শতাব্দীর,
যারা সৃষ্টি করছে ধোঁয়ার অনাবিক ছত্রাক
মেঘ ফুঁড়ে উড়ুক সুচেতনার সুন্দর দাঁড়কাক।


তোমার অক্ষিগোলকে পরবে কী আমার দুচোখ

ছেঁড়াখোড়া তোশকের মতো শরীর আমার
চলছে ক্রমাগত ভালোবাসাহীন সময়ের আনাগোনা
চলছে অনাচার,
আমার সমগ্র সত্তা যেন—কাজ হয়নি সম্পন্ন
এ রকম আধখ্যাচড়াভাবে গড়ে তোলা ঘর
যার জানালা দুয়ার বন্ধ,
দিনযাপন হয়ে ওঠে বিপন্ন,
হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় ভ্যাপসা গন্ধ।

বেঠা মেরে স্রোতজলে যুজে পাই না খেই
আয়নায় নিরাসক্তভাবে নিজেকে করি অবলোকন
কোথাও পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই,
দুচোখের মাঝামাঝি নিজেকে করি গুলিবিদ্ধ
কাতরাই... হয় না মৃত্যু... পারি না ভাঙ্গতে যা কিছু প্রথাসিদ্ধ।

প্রতিরাতে হাঁটি আমি
করোটিতে গড়ে ওঠা বিচিত্র সব নিসর্গ নীলিমায়,
অনিদ্রায় কাটে আমার নিশিরাত
এড়াতে পারি না কোনো দায়,
কমলালেবুর বাকল দিয়ে অতঃপর মাজি দাঁত।

বেসিনের ট্যাপ থেকে ঝরে টুপটাপ
ফোঁটা ফোঁটা রক্ত... তীব্র হিম... ডগমগে লোহিত,
মুখ ঢেকে আছে মৃত জাতিসত্তার মানচিত্রে
শরীর থেকে তিরোহিত হয়েছে উত্তাপ,
নীল ও সবুজে নীরবে মিশে যায় থিকথিকে পীত;
অগোছালো হয়েছে আমার চুল
ধুলোবালি ও আধপোড়া শিকড় বাকড়ে
নাক থেকে বিশ্রীভাবে ঝরছে বনজ লতাপাতার কষ
আহারে আতপ চাল ভরে ওঠে কাঁকড়ে।
রেড ইন্ডিয়ান যেসব গোত্রের কথা মানুষ ভুলে গেছে
যারা চলে গেছে লোকান্তরে
তুমুল যুদ্ধে মাতে তারা আমার পাঁজরে,
আমার পাকস্থলিতে পচে জলমগ্ন জাহাজ
আমার দু’পা সাইপ্রাস বৃক্ষের পোড়া দগ্ধাবশেষ
চরাচরের বৃষ্টিহীনতায় পড়ে বাজ,
আমার দিকে কেউ করে না অভিনিবেশ,
আমার দু’পা আচ্ছাদিত হয় স্যাঁতসেতে সবুজ শ্যাওলায়
কোথাও এগিয়ে যেতে পারি না আমি—
অনুভব করতে পারি না শোক,
পরবে কী তোমার অক্ষিগোলকে আমার দুচোখ?


জ্যাজ মেয়ে

তার স্তনযুগল থেকে উৎসারিত হয় সংগীত
ঝংকারের তীব্রতায় মসৃণ সে মখমল,
কোমরের নীরব মোচড় ধোঁকা দেয়
আহম্মকরা হারায় সম্বিত,
শরীরে ধরে রাখে যে মোহন ছল
ছড়ানদীতে উৎসারিত হয় উন্মাতাল উচ্ছ্বাস
জ্যাজের পুষ্করিণী থেকে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাস,
উত্তপ্ত আত্মায় ধ্বনিপুঞ্জ ছড়ায় সিগ্ধতা শীতল।

চোখ তার হয় আরো বেশি বাঙময়... নীরব
মেডুসার নৃত্যময় শরীর থেকে সহস্র জিহ্বায় ঝরে স্তব,
চোখে চোখে তৈরি হয় সেতু—ঠোঁটে ঝোলে সম্মতিসূচক হাসি,
জানান দেয় তার গীতল অস্তিত্ত্ব—সম্পর্ক এখনো হয়নি তো বাসি;
সুখি বলনাচে তৈরি হয় স্মৃতির দারুণ স্মারক,
সবকিছু দোলে তার সংগীতের সুবাতাসে
পান করি আজ রাতে জ্যাজের ছন্দময় আরক।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
টি. এস. এলিয়টের 'জে. আলফ্রেড প্রুফরকের প্রেমগীতি'
আনা কাস্তিলোর কবিতা
রূপকুমারী নদীর চুম্বন
সর্বশেষ খবর
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
গ্রেনাডাতেও ওয়েবস্টার-ক্যারির ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ালো অস্ট্রেলিয়া
গ্রেনাডাতেও ওয়েবস্টার-ক্যারির ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ালো অস্ট্রেলিয়া
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি