X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘কাজকাম না থাকলে খাওনও নাই’

রুমিন ফারহানা
০৫ জুলাই ২০২১, ১৭:০৩আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২১, ১৭:০৩
রুমিন ফারহানা আষাঢ় মাস। ক’দিন ধরে চলছে মুষলধারে বৃষ্টি। সেই সঙ্গে চলছে ‘কঠোর’ লকডাউন। সামর্থ্যবান মানুষের সময় কাটছে পরিবারের সঙ্গে, নেটফ্লিক্সের মুভি, ওয়েব সিরিজ দেখে, খিচুড়ি রান্না করে। যাকে বলে পরিবারের সঙ্গে চমৎকার কোয়ালিটি টাইম। তারা ভাগ্যবান। তাদের ভোরে উঠে ভাবতে হয় না আজকে কাজ না পেলে খাবো কী? ভাবতে হয় না, গত দশ দিনে কাজ প্রায় না-ই হয়ে আসায় বাড়িতে স্বজনের কাছে পাঠাবো কী? তাদের মাস শেষে নিশ্চিত আয় আছে, সঞ্চয় আছে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে এমন সৌভাগ্যবান কয়জন, যারা ঘরে বসে নিশ্চিন্তে লকডাউন আর বৃষ্টি উপভোগ করেন?  

বের হয়েছিলাম ওষুধসহ জরুরি কিছু জিনিস কিনতে। রিকশা চালক ছেলেটির সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে সে জানালো, গত দুই দিন বের হয়নি সে ভয়ে, শঙ্কায়। কিন্তু তৃতীয় দিন আর সে বাসায় থাকতে পারলো না। ঘরে আছে মা, দুই বোন, অসুস্থ বাবা। বস্তির এক ঘিঞ্জি ঘরে তার বাসা। মা আর দুই বোন মানুষের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করে, কিন্তু লকডাউনের কারণে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সিদ্ধান্তে সেটা বন্ধ আছে। শুনতে শুনতে ভাবছিলাম এই রিকশাচালক তো তবু দুইদিন বাসায় থাকতে পেরেছিল, সেটাও কি পারে আর সবাই?

লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে হাতে কোদাল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দিনমজুর রমজান আলী। কাউকে সামনে দেখলেই চাতক পাখির মতো ছুটছেন তার কাছে। শুধু রমজান নন, তার মতো আরও ২০-২৫ জন দিনমজুর কাজের আশায় অপেক্ষা করছিলেন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় কাকডাকা ভোরে এমন চিত্র দেখা যায়।

দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পোর্টালে দেখলাম লকডাউনের প্রথম দিনই কাজের খোঁজে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে মানুষ। কাকডাকা ভোরে রামপুরা সুপার মার্কেটের সামনে এসেছেন লাল মিয়া। হাতে কোদাল আর কাস্তে। রিপোর্টার সেখানে দাঁড়াতেই ছুটে এসে বললেন, ‘একটা কাজ দেও বাবা’। হুড়োহুড়ি করে এলেন আরও ৩০-৩৫ জন। তারা সবাই দিনমজুর। দিন এনে দিন খাওয়া এসব মানুষের কপালে নতুন করে চিন্তার রেখা এঁকেছে লকডাউনের বিধিনিষেধ। এদের একজন পটুয়াখালীর বাউফলের মুজিবর তালুকদার ৯-১০ দিন কাজ পাননি জানিয়ে বললেন, ‘ঘরে জমানো টাকা-পয়সা নাই। কোনও খাবার-দাবার নাই। সংসার কীভাবে চলবে বুঝতে পারতেছি না। এভাবে যদি লকডাউন চলতে থাকে তাহলে বউ-বাচ্চা নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে।’

পিরোজপুরের কাজী আলমও খুব সকালেই ঘর ছেড়ে বেরিয়েছেন কাজের আশায়। তিনি বলেন, ‘বেশ কিছু দিন ধরেই কাজ পাই না। হঠাৎ হঠাৎ সুযোগ হলেও মজুরি অল্প হয়, যেখানে আগে ৫০০-৬০০ টাকা পেতাম, এখন ২০০ থেকে ৪০০ টাকার বেশি কেউ দিতে চায় না। তারপরও এখানে আসি কোনও একটা কাজের ব্যবস্থা যদি হয়, ভাগ্য যদি ভালো হয় হয়তো কোনও কাজ পেতেও পারি।’

সোহেল মিয়া সদরঘাটে চা বিক্রি করে। গত তিন দিনে তার চা বিক্রি শূন্য। জানে না সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে। এই গল্পগুলো শুধু এদের নয়। শহরের কয়েক লাখ ছুটা বুয়া, চা বিক্রেতা, মুদি দোকানি, দিনমজুর, বাদাম বিক্রেতা, সিএনজি চালক, রিকশাওয়ালার, যাদের কোনও সঞ্চয় নেই, একদিন রোজগার না হলে পর দিন কী হবে সেই সংস্থান নেই। প্রতিদিনের চিন্তা যাদের প্রতিদিন করতে হয় এই মানুষগুলোর সবারই গল্প মোটামুটি একই।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে সর্বাধিক উচ্চারিত প্রপাগান্ডার নাম উন্নয়ন। বাংলাদেশ সরকারের দাবি মতে এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেশি। শ্রীলঙ্কাকে ধার দিচ্ছে ২০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন দেখছে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার। এই দেশে যখন জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.২ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ২২২৭ ডলার, রিজার্ভ ছাড়িয়ে গেছে ৪৬ বিলিয়ন ডলার, অতি ধনী বৃদ্ধির হারে বিশ্বে প্রথম আর ধনী বৃদ্ধির হারেও বিশ্বে প্রথম, দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে, বিশ্বের সর্বোচ্চ ব্যয়ে নির্মিত হয় রাস্তা-ফ্লাইওভার-ব্রিজ, সে দেশেই দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা (নতুন এবং পুরনো মিলিয়ে) ৭ কোটি মানুষের ঘরে একবেলা খাবার কিংবা দুঃসময়ে টিকে থাকার মতো সামান্য কিছু টাকা পৌঁছাতে সরকারকে নাজেহাল হতে হয়।

হয় উন্নয়নের যে গালভরা গল্প সরকার করে তা সর্বৈব মিথ্যা, না হয় সরকারের প্রায়োরিটি লিস্টে এই প্রান্তিক মানুষগুলো নেই। কয়েকদিন আগেই দেশের নতুন দারিদ্র্য নিয়ে দেওয়া তথ্যের জবাবে অর্থমন্ত্রী কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেছিলেন, তিনি নাকি কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা মানেন না। ব্র্যাক বা সানেমের মতো প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো অপরিণত আচরণের প্রসঙ্গ দূরে সরিয়ে রাখা যাক।

করোনায় গত দেড় বছরের একটা দীর্ঘ সময় দেশে নানা নামের বিধিনিষেধের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়েছিল। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছু দিন আগে সংসদে জানিয়েছিলেন, করোনায় দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ১৭০০ কোটি ডলার। খুব সাধারণ অর্থনীতির জ্ঞান দিয়ে এটা বোঝা যায় দেশে করোনার অভিঘাতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে ইতোপূর্বে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়ে গেছে। তাহলে সরকার কেন নিজে থেকে এই নতুন পরিস্থিতির মূল্যায়ন করলো না? সরকারের হাতে তো এই কাজ করার মতো খুবই সক্ষম দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বিআইডিএস আছে।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি, করোনা যে গত দেড় বছরে বাংলাদেশের সোশ্যাল স্ট্রাকচার পাল্টে দিয়েছে সেটিও চোখ বুজে অস্বীকারের চেষ্টা করছে সরকার। মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত যুক্ত হয়েছে দরিদ্রের কাতারে। ঢাকা ছেড়েছে অসংখ্য মানুষ। তাদের কেউ চিরতরে কাজ হারিয়েছে, কারও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে, কারও হয়তো চাকরি আছে, বেতন নেই, তাদের পক্ষে আর সম্ভব না প্রতি মাসে বাড়িভাড়া গুনে, সবকিছু কিনে নিষ্ঠুর এই শহরে পরিবার নিয়ে জীবন নির্বাহ করা। এদের কারও কারও বাড়িতে চলে যাওয়ার টাকাও ছিল না, দীর্ঘদিনের শ্রমে-ঘামে সাজানো স্বপ্নের সংসারের ঘটি-বাটি বিক্রি করে গাড়িভাড়া জোগাতে হয়েছে তাদের। এই নিষ্ঠুর শহরে হয়তো আর কখনোই ফিরবে না তারা।

শুধু দেশেই না, বিদেশেও কাজ হারিয়েছে বহু শ্রমিক। ব্র্যাকের সমীক্ষা বলছে, ১৪ লাখ প্রবাসী শ্রমিক ইতোমধ্যে ছাঁটাই হয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৫ লাখ মানুষ দেশে পুরোপুরি ফিরে এসেছে। এদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। চরম বিপদে আছে এদের ওপরে নির্ভরশীল আরও অনেক লাখ মানুষ।  

গত বছরের মার্চ থেকে দফায় দফায় বিধিনিষেধ, কঠোর বিধিনিষেধ, লকডাউন, কঠোর লকডাউন, সর্বাত্মক লকডাউন ইত্যাদি নানা ‘ভুগিচগিতে’ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মোটামুটি স্থবির। এ ছাড়াও অনিশ্চয়তা মানুষের ব্যয়ের অভ্যাসকে সংকুচিত করে, যার প্রভাব অর্থনীতিতে খুব খারাপভাবে পড়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষ, যাদের না আছে চাকরির কোনও নিশ্চয়তা, না আছে কর্মঘণ্টার সীমা, না পেয়েছে করোনাকালে কোনও সাহায্য। এদের জন্যও সরকারের তরফ থেকে বরাদ্দ হয়নি কিছুই। গত বছর সরকারি প্রেসনোট অনুযায়ী ২৬ মার্চ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত তিন মাস লকডাউনে সরকার মানুষের জন্য যে বরাদ্দের কথা বলেছে তাতে মাথাপিছু দৈনিক চাল দেওয়া হয়েছে ১৪.৫৫ গ্রাম আর নগদ দেওয়া হয়েছে দৈনিক ১১.৩৮ পয়সা।

এই বছরের ৮ এপ্রিল সরকার লকডাউন শুরুর সময় ৭ দিনের জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ করেছিল। হিসাব করলে দেখা যায় তাতে দৈনিক জনপ্রতি বরাদ্দ হয় ১৩ টাকা। এবারের লকডাউনের আগেও অতি সামান্য টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যাতে মাথাপিছু পড়বে দৈনিক ১৪ টাকা। এপ্রিলে বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল ১ কোটি ২৪ লাখ পরিবারের জন্য, আর এবার সেই বরাদ্দ মাত্র ৪ লাখ ৬০ হাজার পরিবারের জন্য দেওয়ার কথা।

এটা গেলো কাগজ-কলমের হিসাব। এপ্রিলে লকডাউন শুরু হওয়ার পর সেটা বেড়ে ঠেকেছে অনেক দিনে। তার ওপর এই টাকা ছাড় করতে দেরি করা হয়েছিল অনেক। এবারও এর অন্যথা হওয়ার কারণ নেই। সর্বোপরি বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক প্রকৃত দরিদ্রের কাছে যায় না, যায় সরকার দলীয় লোকজন এবং আমলাদের ঘনিষ্ঠ দরিদ্র নয় এমন মানুষের কাছে। এটা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের গবেষণার ফাইন্ডিং। এসবের পর আমরা আশা করছি মানুষ তথাকথিত কঠোর বিধিনিষেধ মেনে ঘরে বসে থাকবে?

চা বানানোর কেটলি, বানানো চা বিক্রির ফ্লাস্ক, পানির জগ বাজেয়াপ্ত করে বেশ বীরের বেশে দুই জন পুলিশ সদস্য পোজ দিয়েছেন নাটোরের নলডাঙ্গা থানার সামনে – এমন একটি ছবি সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। এমন খেটে খাওয়া মানুষদের আপনি ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন তাদের সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে, পিটিয়ে গায়ে ক্ষত তৈরি করে, কিংবা মামলা দিয়ে? পারবেন না। কারণ, শিরোনামে লেখা কথাটি, যেটা একজন খেটে খাওয়া মানুষ বলেছিলেন একজন রিপোর্টারকে, তা এদের সবার জীবনে একেবারে শাশ্বত।
 
 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ