X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ সার্জেন্টের ডিভোর্সে জালিয়াতি, আদালতে সিআইডির প্রতিবেদন

আমানুর রহমান রনি
০৬ অক্টোবর ২০২১, ১১:৫৭আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০২১, ১৮:০১

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পুলিশের সার্জেন্ট। পরে স্ত্রীকে ডিভোর্স (তালাক) দেওয়ার কথা জানায় স্বামী। ভুক্তভোগী নারী সার্জেন্টের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই তালাকের বৈধতা অনুসন্ধান করতে গিয়ে সেটিসহ আরও ২৪টি অবৈধ ও জাল তালাকের সন্ধান পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত স্থানীয় পোস্ট অফিসের একজন পিয়ন ও কাজীর সহকারী। ঢাকার আদালতে দেওয়া সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) সিআইডির ঢাকা মেট্রো (পশ্চিম) বিভাগের পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ রাজধানীর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-৬ এর আদালতে ওই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একজন নারী সার্জেন্ট তার স্বামী সার্জেন্ট ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও যৌতুক দাবির অভিযোগে আদালতে নালিশি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি আমলে নিয়ে সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। মামলায় সার্জেন্ট ওমর ফারুক ছাড়াও গাজীপুরের ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের ভবানীপুর বাজারের স্থানীয় বিয়ের কাজী সাখাওয়াত হোসেন এবং ফারুকের ভাই এসআই আল আমিনকেও আসামি করা হয়। 

মামলায় ওই নারী সার্জেন্ট উল্লেখ করেন, ‘২০১৭ সালে রাজশাহীর সারদায় প্রশিক্ষণের সময় ফারুকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ওই নারী ডিএমপিতে এবং ওমর নারায়ণগঞ্জে পদায়ন হয়। এরপর তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। এভাবে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা ২০২০ সালের ১ আগস্ট বিয়ে করেন। তবে বিয়ের পর বিভিন্ন সময় সার্জেন্ট ওমর তাকে নির্যাতন ও যৌতুক দাবি করেছেন। তাকে না জানিয়ে জাল-জালিয়াতি করে ডিভোর্স দিয়েছেন।’

আদালত সিআইডিকে তদন্ত করার নির্দেশ দিলে পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ মামলাটি তদন্ত শুরু করেন। সাত মাস তদন্ত শেষে আদালতে তিনি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে ওই নারী ওমর ফারুককে ফোনে বলেন, ‘তার মা খুব অসুস্থ। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে, তুমি ঢাকায় আসো।’ এরপর ওমর দ্রুত ওই নারী সার্জেন্টের তেজগাঁওয়ের অফিসার্স কোয়ার্টারে আসেন। সেখানে এসে দেখতে পান, নারী সার্জেন্টের মা সেখানে নেই, তিনি অসুস্থ না,  গ্রামের বাড়িতে রয়েছেন। এনিয়ে দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ওই রাতে দুজনের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও বিষয়টি জানানো হয়। তাদের দুজনকে তেজগাঁও থানায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে বসে দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ের। এরপর পুলিশ সহকর্মীদের উপস্থিতিতে ২০২০ সালের ১ আগস্ট পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর সার্জেন্ট ওমর তার নারায়ণগঞ্জের কর্মস্থলে চলে যান। নারী সার্জেন্ট ঢাকাতেই থাকেন।

২০২০ সালের ৬ আগস্ট কাবিননামা তুলতে গিয়ে নারী সার্জেন্ট তার স্বামী ওমরের সঙ্গে তেজগাঁও কাজী অফিসে বসে একটি সেলফি তুলেন। এসময় ওমর তার মোবাইলটি ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলে। পরে দুজনে আবার পল্টন যান। সেখানে ওমর তার স্ত্রীকে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেন।

২০২০ সালে ২০ সেপ্টেম্বর ওমর বদলি হয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে টাঙ্গাইল যান। সেখানে গিয়ে ওমর তার স্ত্রীকে জানায়, সার্ভিস বুকে বিয়ের কাবিননামা সংযুক্ত করতে হবে, দ্রুত কুরিয়ার করে ওই নারীকে কাবিননামা পাঠাতে বলেন। ওই নারী কাবিননামার কপিটি কুরিয়ার করে ওমরকে টাঙ্গাইলের ঠিকানায় পাঠায়।

বিয়ের পর থেকেই ওই নারী সার্জেন্টের ভরণপোষণ ও খোঁজ-খবর নেওয়া বন্ধ করে দেন ওমর। এনিয়ে ওই নারী সার্জেন্ট ওমরের সঙ্গে টাঙ্গাইলে গিয়ে কথা বলেন। তবে ওমর সবাইকে বলতে থাকেন ‑ তিনি ওই নারী সার্জেন্টকে তালাক (ডিভোর্স) দিয়েছেন। এরপর ওই নারী সার্জেন্ট টাঙ্গাইল পুলিশ সুপার, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। সার্জেন্ট ওমরের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে পুলিশ বিভাগ। এদিকে, ওই নারী সার্জেন্ট তার ডিভোর্সের নোটিশ ও ডাক বিভাগের রসিদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে থাকেন। কিন্তু ডিভোর্সের কোন নোটিশ তার স্থায়ী বা অস্থায়ী ঠিকানায় আসেনি।

পরবর্তী সময়ে গাজীপুরের ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের ভবানীপুর কাজী অফিসে গিয়ে তিনি জানতে পারেন ‑ বিয়ের দুদিন পরই সার্জেন্ট ওমর ২০২০ সালের ৩ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ থেকে গাজীপুরের ওই কাজী অফিসে গিয়ে তাকে তালাক দিয়েছেন। কাজী সাখাওয়াত হোসেন গাজীপুর চৌরাস্তার চন্দনা পোস্ট অফিসের দুটি ডাক রসিদ দেখান ‑ যার নম্বর যথাক্রমে ৫৩৮ ও ৫৩৯। অর্থাৎ রেজিস্ট্রিযোগে নারী সার্জেন্টের স্থায়ী ঠিকানার ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে একটি এবং তাকে একটি তালাকের নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। তবে তারা কেউ‌ই এই নোটিশ পাননি। কাজীর কাছ থেকে ওই রসিদ সংগ্রহ করেন ওই নারী সার্জেন্ট। তালাকের বৈধতা যাচাই করতে তিনি গাজীপুর জেলা প্রশাসনের কাছে তিনি একটি লিখিত অভিযোগ করেন। জেলা প্রশাসন তদন্ত করে তালাকের কোন বৈধতা পায়নি।

অপরদিকে, ওই নারী সার্জেন্টের যৌতুক মামলা তদন্ত ও তালাকের বৈধতা যাচাই করতে গাজীপুরে যান সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা। জিজ্ঞাসাবাদে বিয়ের কাজী সাখাওয়াত তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেন, ‘তালাকের নোটিশ ঠিকানা অনুযায়ী পাঠানোর জন্য তার সহকারী সানাহউল্লাহকে তিনি দিয়েছিলেন। পোস্ট অফিসে গিয়ে তিনি এসব নোটিশ রেজিস্ট্রিযোগে উল্লেখিত ঠিকানা অনুযায়ী পাঠিয়েছিলেন।’ তবে কেনো ওই নোটিশ ঠিকানা অনুযায়ী যায়নি তা জানানোর জন্য কাজী সাতদিনের সময় চান তদন্ত কর্মকর্তার কাছে। সাতদিন পর কাজী সাখাওয়াত ও তার সহকারী সানাহউল্লাহ সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন।

সানাহউল্লাহ জানান, ২০২০ সালের ১০ আগস্ট ২৪টি তালাক নোটিশ চন্দনা পোস্ট অফিসের পিয়ন শফিকুল ইসলামের কাছে তিনি দিয়েছিলেন। শফিকুল একটি চায়ের দোকানে বসে পরবর্তী সময়ে ওইসব নোটিশ পাঠানোর ডাক রসিদগুলো তাকে দিয়েছিল।’

২০২০ সালের ১০ আগস্ট কাজী সাখাওয়াত হোসেনের অফিস থেকে ২৪টি নোটিশ ডাক রেজিস্ট্রিযোগে পাঠানোর জন্য সানাহউল্লাকে দিয়ে চন্দনা পোস্ট অফিসে পাঠানো হয়। পোস্ট অফিসের পিয়ন শফিকুল ইসলাম সার্জেন্ট ওমরের তালাক নোটিশ পাঠানো হয়েছে বলে সানাহউল্লাহকে ৫৩৮ ও ৫৩৯ নম্বরের দুটি রসিদসহ ২৪টি রসিদ চায়ের দোকানে বসে দেয়। এগুলোর সবকটিতেই ডাক বিভাগের সিল ছিল অস্পষ্ট।

ডাক রসিদের জট খুলতে সিআইডি চন্দনা পোস্ট অফিসে যায়। সেখানে গিয়ে তারা জানতে পারেন, ওই দিন চন্দনা পোস্ট অফিস থেকে মোট ৭২টি চিঠি রেজিস্ট্রিযোগে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পাঠানো হয়। পোস্ট অফিসে সংরক্ষিত রেজিস্ট্রি বইতে ওই দিন ৭৬২ থেকে ৯১৪ পর্যন্ত ক্রমিক নম্বরের ৭২টি চিঠির রসিদ রয়েছে। তবে ৫৩৮ ও ৫৩৯ নম্বরের কোনও রসিদ নম্বর পাওয়া যায়নি। ২০২০ সালের ১০ আগস্ট এই সিরিয়াল নম্বরের কোনও চিঠি পোস্ট অফিস থেকে ইস্যু হয়নি। কাজী সাখাওয়াত যে ২৪টি নোটিশ পাঠানোর জন্য দিয়েছিলেন তার কোনটিই প্রাপকের ঠিকানা অনুযায়ী পাঠায়নি পিয়ন শফিকুল ইসলাম।

সিআইডি স্পষ্ট জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে বলে উল্লেখ করেছে তাদের প্রতিবেদনে। জালিয়াতি ধরা পরার পর থেকে কাজীর সহকারী সানাহউল্লাহ ও চন্দনা পোস্ট অফিসের পিয়ন শফিকুল ইসলাম পলাতক রয়েছেন। তাদের অভিযুক্ত করে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছেন।

তদন্ত কর্মকর্তা এস এম মিরাজ আল মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওইদিন কাজী সাখাওয়াতের অফিস থেকে ২৪টি নোটিশ পাঠানো হয়েছিল, সেই নোটিশগুলোর মধ্যে সার্জেন্ট ওমরেরটিও ছিল, মামলা অনুযায়ী আমরা কেবল ওমরের ডাক রসিদ দুটির বিষয়ে তদন্ত করেছি। সেই দুটিতে জালিয়াতি করা হয়েছে বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। আদালতে এই দুটির বিষয়েই আমরা উল্লেখ করেছি। বাকিগুলোর বিষয়ে আমরা আর খোঁজ নেইনি।’

ওই পোস্ট অফিস থেকে এর আগে একটি রেজিস্ট্রার বুক চুরি হয়। এই ঘটনায় একটি মামলা হলেও পুলিশ তদন্ত করে কুলকিনারা না করতে পেরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।

এদিকে, সার্জেন্ট ওমরের বিরুদ্ধে ওই নারীর করা যৌতুক মামলা তদন্ত করেছে পিবিআই। সার্জেন্ট ওমর গত ২৬ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের এক নারীকে আট লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে করেছেন। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও প্রক্রিয়াধীন।

ওই নারী সার্জেন্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডিভোর্সের বিষয়ে সার্জেন্ট ওমর জালিয়াতি করেছেন। তার দ্বিতীয় বিয়ের বৈধতা দিতে এই জালিয়াতি করেছেন তিনি। জালিয়াতির বিষয়টি সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে।’

/এমএস/
সম্পর্কিত
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
সর্বশেষ খবর
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা