‘আমরা ১৯৬৫ সালে এহানে আইছি। এর থাইকে কষ্ট করতাছি। এই নদীর ওপর এডা ব্রিজ অইলে আমাগো খুব বালা অইতো। আমরা অনেক কষ্ট কইরা নদী পার অই। যেদিন পানি বেশি থাহে, ওই দিন আর বাড়িতে যাবার পাই না। নদীর এপারেই কষ্ট কইরা থাহন নাগে। কত মানুষ আইলো আমাগো ব্রিজ কইরা দেবে। ভোটও দিলাম। কিন্তু ব্রিজ আর অইলো না।’
শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সোমেশ্বরী নদীর পাড়ের খারামুরা গ্রামের ৯৫ বছর বয়সী কৃষক আইজুর রহমান এসব কথা বলছিলেন। আইজুর রহমান ১৯৬৫ সালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসাম থেকে বাংলাদেশে এসে সীমান্ত এলাকা শ্রীবরদীর খারামুরা গ্রামে বসতি গড়েন।
তিনি জানান, সোমেশ্বরী নদীতে একটি সেতুর অভাবে বছরের পর বছর দুর্ভোগ পোহাচ্ছে পাঁচ গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন পার হচ্ছে শিশুসহ স্কুলের শিক্ষার্থীরা। অনেক জনপ্রতিনিধি কথা দিয়েছিলেন সোমেশ্বরী নদীতে সেতু করে দেবেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেননি। শেষ জীবনে সেতু দেখে যেতে চান বৃদ্ধ আইজুর রহমান।
শুধু আইজুর রহমান নন, স্থানীয় সবার একই অভিযোগ। তারা বলছেন, দেশ স্বাধীনের পর থেকে এই নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের দাবি থাকলেও শোনেনি কর্তৃপক্ষ। যদিও বরাবরের মতো আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রকৌশলীরা।
স্থানীয়রা সূত্রে জানা যায়, তিন দিকে ভারত থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরী নদী আর উত্তরপ্রান্তে ভারত সীমানায় বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড়ের খারামোরা, রাঙাজান ও কোচপাড়াসহ পাঁচ গ্রামের বাসিন্দাদের। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে হাঁটুপানি থাকে। বৃষ্টি হলেই পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি থাকে কানায় কানায় পূর্ণ।
এতে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারে না শিক্ষার্থীরা। সীমান্তে টহল দিতে পারেন না বিজিবির সদস্যরা। প্রতিবেশীরা যেতে পারেন না ওসব গ্রামে। চরম ভোগান্তি পোহায় কয়েকশ শিক্ষার্থীসহ ১৫ হাজার মানুষ। নদীর দুই পাশে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিনটি মাদ্রাসা, মসজিদ, গির্জা ও সরকারি-বেসরকারি এনজিও অফিস আছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শমসের আলীর অভিযোগ, দেশ স্বাধীনের পর থেকে সেতুর দাবি থাকলেও আজও বাস্তবায়ন হয়নি। নদীতে পানি বেশি থাকলে অনেক সময় পার হওয়া যায় না। সারা বছর নৌকায় কষ্টে পার হতে হয়। কেউ অসুস্থ হলে সময়মতো চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।
খারামোরা গ্রামের কালাম বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে হাজার হাজার মানুষ কষ্ট করে নদী পার হয়। বর্ষাকালে নদীতে পানি বেড়ে গেলে হাটবাজারে যাওয়া যায় না।
কোচপাড়ার শিক্ষার্থী সানোয়ার হোসেন জানায়, বছরের অধিকাংশ সময় পাহাড়ি ঢলের কারণে নদীতে পানি বেড়ে যায়। এই সময়ে নদী পার হতে না পারায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া যায় না। অনেক সময় নৌকা দিয়ে নদী পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।
তাওয়াকুচার গৃহবধূ সমরিন বেগম বলেন, সেতু না থাকায় সারা বছর খুব কষ্ট করতে হয়। সেতু নির্মাণের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ চাই।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের উপজেলা প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সেতু নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে নকশা ও মাটি পরীক্ষার কাজ চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হবে। দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে কাজের অনুমোদন পেলেই শুরু হবে নির্মাণকাজ।
শুধু আশ্বাস নয়, দ্রুত সময়ের মধ্যে সোমেশ্বরী নদীর ওপর একটি সেতু হবে। বদলে যাবে পাহাড়ি জনপদের জীবন এমনটাই প্রত্যাশা সবার।