পূর্ব প্রকাশের পর
সাইকোঅ্যানালাইটিকাল সমালোচনাতত্ত্বে আমাদের পূর্বের পর্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ফ্রয়েডিয় সাইকোঅ্যানালাইসিস। কিন্তু ফ্রয়েডের পরে মনোবিজ্ঞানীরা অনেকে সাইকোঅ্যানালাইসিস সম্পর্কে নতুনতর ধারণার অবতারণা করেছেন। তাঁদের হাত ধরে সাইকোঅ্যানালাইলিটিকাল সমালোচনাতত্ত্বেও প্রবেশ করেছে নতুনতর ধারণা ও ভাবনা। পরবর্তী প্রজন্মের সেই সাইকোঅ্যানালাইলিটিকাল সমালোচনাতত্ত্বে সবচেয়ে বড় অবদান দুজনের। তাঁরা হলেন কার্ল ইয়ুঙ (Carl Jung: 1875-1961) ও জ্যাক লাকাঁ (Jacques Lacan : 1901 - 1981)।
কার্ল ইয়ুঙও ফ্রয়েডের মতো মনোচিকিৎসক ছিলেন। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিনি ফ্রয়েডের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। আট বছরের অধিককাল তিনি ফ্রয়েডের সহযোগী হিসেবেই কাজ করেছেন। ১৯১২ সালে ইয়ুঙের ‘সাইকোলজি অব দি আনকনশাস’ নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পরে গুরু-শিষ্যের এ সম্পর্ক চুরমার হয়ে যায়। ফ্রয়েড তাঁর এই গুরুমারা শিষ্যকে তখন থেকে বর্জন করেন।
এই গুরুমারা শিষ্যের হাতেই ফ্রয়েডের মনের মানচিত্র এক নতুন রেখায় নতুনভাবে নির্মিত হয়। ফ্রয়েড বলেছিলেন মনের অচেতন অংশ পুরোটা নির্মিত হয় ব্যক্তির অবদমিত ইদ দ্বারা। অচেতনে জমে থাকা সব কিছুই ব্যক্তির নিজের জীবনের স্মৃতি, ঘটনা ও ভাবনার তলানি। কিন্তু ইয়ুঙ বললেন অচেতনের সবটা ব্যক্তির নিজের জীবন থেকে পাওয়া নয়। এখানে জমে আছে এমন অনেক কিছু যা ব্যক্তির নিজ জীবন থেকে অর্জিত নয়, বরং পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার থেকে পাওয়া। ব্যক্তি শারীরিকভাবে যেমন তাঁর বাবা-মার কাছে ঋণী কারণ তার হাড়-মাংস সব তার বাবা-মার কোষ থেকে তৈরি, তেমনই তার মনের জগতের জন্যও তার বাবা-মা এবং পূর্ববর্তী পুরো মানবসমাজের কাছে ঋণী কারণ তার মনের জগতের অচেতন অংশে তার নিজের জীবনের ঘটনাদি প্রবেশের পূর্বেই সেখানে প্রবিষ্ট হয়ে আছে তার বাবা-মা ও পূর্ববর্তী মানবসমাজের অভিজ্ঞতার অনেক বিষয়। মনের অচেতন অংশে জমে থাকা পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া এইসব বিষয়কে ইয়ুঙ বলেছেন ‘আর্কেটাইপ’।
মনের অচেতনের এই অংশ কারো নিজ জীবনের অভিজ্ঞার ফসল না হয়ে বরং সমগ্র মানবজাতির সমগ্র মানব ইতিহাস থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার ফসল। তাই ইয়ুঙিয় ধারণায় মনের অচেতনের এই অংশ হলো সামগ্রিক অচেতন বা ‘কালেকটিভ আনকনশাস’। কালেকটিভ আনকনশাসের একটি সর্বজনপরিচিত উদাহরণ হলো অন্ধকারের ভয়। অন্ধকারের সাথে ভয়ের সম্পর্ক ব্যক্তির নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি হওয়ার আগেই পূর্বপুরুষ অর্থাৎ সেই গুহামানবের অভিজ্ঞতার ফসল হিসেবে মনে অধিকৃত হয়ে আছে। গুহার জীবন থেকে বের হওয়ার পরেও মানবজাতির অভিজ্ঞতায় কালে কালে জড়ো হতে থাকে এমন অনেক সাধারণ ঘটনা ও চরিত্র-ধারা যেগুলো বিশ্বজুড়ে আর্কেটাইপের একটি ভান্ডার রচনা করেছে। আর সে ভান্ডার বেশিরভাগ স্থান করে নিয়েছে লোকায়ত পুরাণে, ধর্মগ্রন্থে আর মানব মনের গভীর অচেতনে। এসব আর্কেটাইপের মধ্যে যেমন রয়েছে ফাদার ইমেজ। আর্কেটাইপ ফাদার ইমেজ থেকে আমরা জানি ও অনুভব করি যে, পৃথিবীর সর্বকালে সর্বসমাজে পিতা এক শক্তির প্রতীক। এমনই আরেক আর্কেটাইপ ‘পারসোনা ইমেজ’ (persona image)। পারসোনা ইমেজ থেকে আমরা জানি যে, পৃথিবীর সর্বকালে সর্বসমাজে প্রতিটি মানুষ চেয়েছে তার নিজের প্রতিচ্ছবিটি এমনভাবে সমাজে উপস্থাপিত হোক যাতে তা সকলের পছন্দের ও আদরের হয় এবং তার কোনো দোষ কোথাও উচ্চারিত না হোক। ইয়ুঙের মতে এই আর্কেটাইপগুলো প্রতিটি মানুষ পুরো মানবজাতির উত্তরাধিকার রূপে তার মনের গভীর অচেতন অংশে বহন করে।
সাইকোঅ্যানালাইসিস বিষয়ক ধারণায় ইয়ুঙের সংযোজন মাত্র মনের অচেতন অংশে এই আর্কেটাইপের উপস্থিতি শনাক্তকরণ। ইয়ুঙের এই নতুন সংযোজন চিকিৎসাবিজ্ঞানসংক্রান্ত সাইকোঅ্যানালাইসিস বিষয়ে সামান্য একটি ঘটনা হলেও সাইকোঅ্যানালাইটিকাল সাহিত্যতত্ত্বে সেই সামান্য অংশের অবদানই অসামান্য। মনের অচেতন অংশে নিজের অভিজ্ঞতার বাইরের বস্তু আছে—ইয়ুঙের এই কথা মেনে নেয়ার পরে আর ফ্রয়েডের সাথে সম্পূর্ণ একমত হয়ে বলার সুযোগ নেই যে, সাহিত্য হলো সম্পূর্ণভাবে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের অবদমিত ইদের প্রকাশ। ফলে সাহিত্য আর লেখকের ব্যক্তিগত ফ্যান্টাসি বা ডেড্রিমিংয়ের প্রকাশ মাত্র নয়। বরং এখন থেকে বলতে হবে যে, সাহিত্যে ব্যক্তির অবদমিত ইদের প্রকাশও থাকতে পারে এবং একই সাথে কালেকটিভ আনকনশাসে অবস্থিত মানবজাতির সর্বজনীন আর্কেটাইপের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আচরণাদি ও আবেগের প্রকাশও থাকতে পারে। ইয়ুঙ সাইকোঅ্যানালাইটিকাল সাহিত্যতত্ত্বকে এভাবে ব্যক্তিক পর্যায় থেকে সামষ্টিক পর্যায়ে উন্নীত করলেন।
পরোক্ষে ইয়ুঙিয় এই ভাবনা দ্বারা ফ্রয়েডিয় সাইকোঅ্যানালাইটিকাল সাহিত্যতত্ত্বের একটি সীমাবদ্ধতাও দূর হলো। সাইকোঅ্যানালাইটিকাল সাহিত্যতত্ত্বের একটি সীমাবদ্ধতা এই ছিল যে, ফ্রয়েডিয় ভাবনা অনুযায়ী সাহিত্য যদি লেখকের অর্থাৎ কোনো একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির জীবনের অবদমিত ইদের ফসলই হয় তাহলে সেই সাহিত্যকর্মে অন্য একজন মানুষের অর্থাৎ পাঠকের আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার তো কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। লেখকের অবদমনের জগৎ নিয়ে পাঠক ভাবতে যাবেন কোন দুঃখে? এই প্রশ্নের কোনো যুৎসই উত্তর ফ্রয়েডিয় সাইকোঅ্যানালাইসিসে ছিল না। ইয়ুঙিয় ভাবনার বদৌলতে এবার আমরা এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে পারি যে, লেখক তার মনের অচেতনে কালেকটিভ আনকনশাস বহন করেন, সেখানে তিনি সমগ্র মানবজাতির আর্কেটাইপ বহন করেন বিধায় তাঁর সে অচেতনের প্রকাশে দুনিয়ার সকল মানুষের হিস্যা রয়েছে। একারণেই একটি গ্রিক সাহিত্যকর্ম ভারতীয় পাঠকের কাছে, কিংবা ইনকা সমাজের একটি সাহিত্যকর্ম ইউরোপীয় পাঠকের কাছে সমানভবে আবেদন সৃষ্টির যোগ্যতা রাখে।
ফ্রয়েডিয় ও ইয়ুঙিয় উভয় ঘরানার সাইকোঅ্যানালাইটিকাল সাহিত্যতত্ত্বেই এই কথা সমানভাবে প্রযোজ্য যে, সাহিত্যকর্ম হলো ভাষায় তৈরি একটি ন্যারেটিভ যার মধ্যে লুকায়িত থাকে লেখকের মনের অচেতন রাজ্যের বিষয়াদি। সাইকোঅ্যানালাইটিকাল সাহিত্যতত্ত্ব পাঠককে খুঁজে দিতে সাহায্য করে ভাষায় গড়া ন্যারেটিভের মধ্যে লুকায়িত মনের অচেতন রাজ্যের সেইসকল বিষয়াদিকে, হোক সে অচেতন রাজ্য লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার হিমাগার, কিংবা হোক সে অচেতন রাজ্য সমগ্র মানবের আর্কেটাইপাল অভিজ্ঞতার হিমাগার। উভয় ঘরানায়ই ভাষাকে দেখা হয় মনের অচেতন রাজ্যের বিষয়াদিকে উপস্থাপনের হাতিয়ার হিসেবে। কিন্তু আমাদের আলোচনার তৃতীয় তাত্ত্বিক জ্যাক লাকাঁ (Jacques Lacan : 1901 - 1981) ভাষাকে মনের অচেতন রাজ্যের বিষয়াদি উপস্থাপনের হাতিয়ার হিসেবে দেখেন না, বরং তিনি মনে করেন ভাষা নিজেই আমাদের মনের অচেতন রাজ্য। ব্যাপারটা আসলেই একটু তালঘোল পাকানোর মতো। তবে আমরা চেষ্টা করব যতটা সম্ভব সোজা করে তুলতে।
অচেতন সম্পর্কে লাকাঁর এই বিপ্লবী ভাবনা বুঝতে আমাদেরকে প্রথমে জানতে হবে মনের কার্যক্রম বিষয়ে লাকাঁ কী বলেছেন। লাকাঁর মতে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক রাজ্য নিয়ন্ত্রিত হয় মনের তিন ধারার বা তিন পর্যায়ের কার্যক্রম দ্বারা। এই তিনটি ধারা হলো : ক) প্রতিচ্ছবি-সৃষ্ট (imaginary), খ) প্রতীকী (symbolic) ও গ) বাস্তব (real)। এই তিনের পারস্পরিকতায় ও সংশ্লেষে যে ঘটনাজাল তৈরি হয় লাকাঁ তার নাম দিয়েছেন বোরোমিয়ান রিং (Borromean rings)। ইতালির বোরোমিয় বংশের অভিজাত পরিবার এই জটিল রিং তাদের কোট অব আর্মস রূপে ব্যবহার করত বিধায় লাকাঁ মনের তিন ধারার কার্যক্রমে উদ্ভূত ঘটনাজালের জটিলতা বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এছাড়া বোরোমিয়ান রিঙের যেকোনো একটি ভেঙে গেলে পুরো বোরোমিয়ান রিঙের বিন্যাস ভেঙে পড়ত বলে লাকাঁ এই শব্দ ব্যবহার করে একই সাথে বুঝিয়েছেন যে, মনের এই ঘটনাধারার তিনটির যে কোনো একটি ভেঙে পড়লে পুরো মনের কার্যক্রমই ভেঙে পড়বে। এখানে একটি কথা বলে নেয়া জরুরি। দেখা যাচ্ছে আমরা ইংরেজি imaginary শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ লিখেছি ‘প্রতিচ্ছবি-সৃষ্ট’। কেন এর অর্থ ‘কাল্পনিক’ লেখা হলো না সেটি অবশ্যই খটকা লাগার মতো একটা বিষয়। আসলে লাকাঁ কাল্পনিক অর্থে imaginary শব্দ ব্যবহার করেননি। তিনি imaginary বলতে বুঝিয়েছেন রসধমব থেকে উদ্ভূত। লাকাঁর এই উদ্দিষ্ট অর্থের সাথে সম্পর্ক রাখতেই আমরা imaginary শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ লিখেছি প্রতিচ্ছবি-সৃষ্ট বা প্রতিচ্ছবি-উদ্ভূত। ‘প্রতিচ্ছবি-সৃষ্ট’ শব্দটি সাইকোলজির কোনো পরিভাষারূপে বাংলায় স্বীকৃত নয় বিধায় আমরা পরবর্তী আলোচনায় বাংলায় ‘ইমাজিনারি’ শব্দটিই ব্যবহার করবো। সাইকোঅ্যানালাইসিস বিষয়ে লাকাঁর স্বাতন্ত্র্য বুঝতে প্রথমত আমাদেরকে মনের এই তিন ধারার কার্যক্রম বুঝতে হবে। এরপরে আমরা দেখবো মনের কার্যক্রম বিষয়ে তাঁর ভাবনার এই স্বাতন্ত্র্য কীভাবে সাইকোঅ্যানালাইটিকাল সাহিত্যতত্ত্বকে নতুন রূপ দিয়েছে।
মনের ইমাজিনারি কার্যক্রম শিশুর জন্মের পর থেকেই শুরু হয়। লাকাঁ এ কার্যক্রমকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন : অমলেট স্টেজ (hommelette stage) ও মিরর স্টেজ (mirror stage)। ‘homme’ ও ‘omelette’ এই দুই শব্দের অর্থ এক শব্দের মধ্যে ঠেসে আটকানোর লক্ষ্য নিয়ে ‘hommelette’ শব্দটি ঐ দুই শব্দ পেঁচিয়ে বানানো। ফরাসি শব্দ ‘homme’ অর্থ ব্যক্তি, আর ‘omelette’ অর্থ আমরা সবাই জানি ডিম গুলিয়ে ডিমের কুসুম ও লালার আকার নিশ্চিহ্ন করে কড়াইয়ের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে তেলে ভাজা। ফলে ঐ দুই শব্দ পেঁচিয়ে বানানো ‘hommelette’ শব্দের উদ্দিষ্ট অর্থ হলো ব্যক্তির শিশুরূপের সেই পর্যায় যখন পর্যন্ত শিশুটি তার মনের মধ্যে নিজের নির্দিষ্ট কোনো আকার ও রূপ দাঁড় করাতে পারেনি। শিশুর মনে তার নিজের অস্তিত্ব তখন গোলানো ডিমের মতো আকারহীন। এই আকারহীনতা থেকে শিশুর নিজ অস্তিত্ব তার মনে আকার পেতে শুরু করে মিরর স্টেজে। এই স্টেজ শুরু হয় শিশুর ছয় মাস বয়স থেকে এবং তা স্থায়ী হয় আঠারো মাস পর্যন্ত।
মিরর স্টেজে শিশু প্রথম তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে বুঝতে শুরু করে মিররে অর্থাৎ আয়নায় প্রতিফলিত নিজের রূপ দেখে। আয়নায় নিজেকে দেখে সে প্রথম তার পুরো শরীরটাকে একত্রে বুঝতে শুরু করে এবং অনুভব করে যে এই পুরো শরীরটার মালিক সে। সে বুঝতে পারে তার পাশের পুরো দুনিয়া থেকে সে কীভাবে স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ। সে হাত নাড়ালে আয়নার ওপারে গোটা দেহটার হাত নড়ে, সে বসে পড়লে ওপারের দেহটাও বসে পড়ে। আয়নার ওপারের দেহটাকে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার মধ্য দিয়ে সে একধরনের শক্তি ও সম্পূর্ণতা অনুভব করে। সে এক ধরনের আনন্দ অনুভব করে। এই সবটাই সম্ভব হয় আয়নার ওপারের ইমেজটাকে নিজের বলে শনাক্ত করার মধ্য দিয়ে। ইমেজের ওপর ভিত্তি করে অস্তিত্বশীল বিধায় শিশুর এই আনন্দ, এই সম্পূর্ণতা বোধ এবং সর্বোপরি নিজেকে আবিষ্কারের মানসিক প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণই ইমাজিনারি। লাকাঁর মতে আয়নার মধ্যের ছবিই ‘আসল আমি’ (Ideal ‘I’)- এই ভাবনাই হলো ‘ইগো’র উন্মেষ যা অর্জিত হয় মিরর স্টেজে। ব্যক্তির ‘ইগো’ এভাবে অর্জিত হয় বলে ইগো সংক্রান্ত ধারণার মধ্যে দুটি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য এর উৎপত্তি থেকেই অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠে- একটি মিসরিকগনিশন (misrecognition) ও অপরটি এলিয়েনেশন (alienaton)। মিসরিকগনিশন এ কারণে যে, ইগো ব্যক্তির জীবনে অস্তিত্বশীলই হয়েছে নিজের আয়নায় দেখা ছবি থেকে যে ছবিটি বাস্তবতার নিরিখে অলীক এক অস্তিত্ব। নিজের আসল অস্তিত্বকে পাশে ঠেলে আয়নার ছবিতে নিজেকে ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়েছে বিধায় সেই শনাক্তকরণের ওপর দাঁড়ানো ইগোও মিসরিকগনাইজড অর্থাৎ ভুলভাবে শনাক্তকৃত চেতনা হতে বাধ্য। আর এলিয়েনেশন একারণে যে, ইগো অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠার এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি তার নিজ অস্তিত্বকে এলিনিয়েট করে (alienate) অর্থাৎ দূরে ঠেলে দিয়ে আয়নায় প্রতিফলিত অলীক অস্তিত্বকে আপন করে নিয়েছে। ফলে ব্যক্তির সচেতনতার উন্মেষ তথা ইগোর উন্মেষ জন্মগতভাবেই এক অলীক (misrecognised and alienated) অস্তিত্বের ভিত্তিমূলে দাঁড়ানো। আমরা লাকাঁর ইমাজিনারি পর্যায়ের মানসিক কর্মকা- বিশ্লেষণ করে দেখলাম যে, ব্যক্তির সচেতনতা বা ইগো ব্যক্তি যা নয় তার ওপর দাঁড়ানো; লাকাঁর ভাষায় ব্যক্তির (subject) ওপর নয় বরং ‘অন্য’ (other)- এর ওপর দাঁড়ানো।
এবার আসা যাক লাকাঁ-কথিত প্রতীকী বা সিম্বলিক ধারার কর্মকা-ের আলোচনায়। এ আলোচনায় আমাদেরকে স্মরণ করতে হবে কাঠামোবাদীদের প্রদত্ত ধারণা। কাঠামোবাদ থেকেই আমরা জানি সিগনিফায়ার তার অর্থ সিগনিফাইড থেকে গ্রহণ করে না, বরং সিগনিফায়ারগুলো তাদের পারস্পরিক বৈপরীত্যের সম্পর্কের ওপর দাঁড়িয়ে অর্থ সৃষ্টি করে। লাকাঁর মতে সিগনিফায়ারগুলো একটি ভাষার বা লাঙের অভ্যন্তরে যে কাজ করে প্রতিটি মানুষও গোটা মানব সমাজের অভ্যন্তরে বা নেটওয়ার্কে সেই কাজটি করে। কাঠামোগতভাবে প্রতিটি সিগনিফায়ারের সাথে লাঙের যে সম্পর্ক, প্রতিটি মানুষের সাথে পুরো মানব সমাজের সেই সম্পর্ক। সিগনিফায়ারগুলোর যেমন নিজস্ব কোনো অর্থ নেই এবং প্রতিটি সিগনিফায়ারের অর্থ যেমন অপরাপর সিগনিফায়ারের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে তৈরি হয়, তেমনি কোনো ব্যক্তিরই নিজস্ব কোনো অর্থ বা আইডেনটিটি নেই। লাঙ বা ভাষার মাঝে সিগনিফায়ারগুলো যেমন প্রতীক মাত্র, সমাজের কাঠামোতে ব্যক্তিগুলোও তেমনি সম্পর্কের প্রতীক মাত্র। মানুষের সামাজিক ও মনোজাগতিক জীবনের সবকিছুই লাকাঁর মতে এই প্রতীকের কাঠামোর অধীন। কারণ, মানুষের অস্তিত্ব ভাষার কাঠামোর বাইরে অসম্ভব, আর সেই ভাষা কাঠামো দাঁড়িয়েই আছে সাইন/ সিগনিফায়ার বা প্রতীকের ওপর। প্রতিটি মানুষের জীবনই অর্থবহ হয় এই ভাষা কাঠামোর মধ্যে অস্তিত্বশীল হওয়ার মধ্য দিয়ে। ভাষা বা প্রতীকের এই কাঠামো আমাদের অস্তিত্বের স্বরূপ নির্ধারণ করে কারণ ভাষার ওপর না দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের অস্তিত্বের জানান দিতে পারি না। সুতরাং, এই ভাষার প্রতীক বা সিগনিফায়ার ‘আমি’- এর মধ্য দিয়ে আমি যখন আমার নিজেকে চিহ্নিত করি তখন মিরর স্টেজে যেমন নিজেকে চিহ্নিত করতে গিয়ে ছবিকে চিহ্নিত করেছি তেমনি এবার নিজেকে চিহ্নিত করতে গিয়ে একটি প্রতীককে চিহ্নিত করি মাত্র। প্রতীকের বেড়াজাল পার করে সত্যিকার নিজেকে চিহ্নিত করা ভাষার মাধ্যমে সম্ভব হয় না। ফলে মিরর স্টেজে ব্যক্তির নিজের প্রকাশ যেমন ‘অন্য’ (other)- এর ওপর দাঁড়ানো ছিল, আমরা দেখছি মনের সিম্বলিক কার্যক্রম পর্যায়েও ব্যক্তির নিজের (subject) প্রকাশ তেমনি আরেক other- এর ওপর দাঁড়ানো। মিরর স্টেজের other-টি ব্যক্তি সরে গেলে বা ব্যক্তি মরে গেলে সরে যায় বা মরে যায়, কিন্তু ভাষার এই other-টি ব্যক্তি সরে বা মরে গেলেও একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, সরেও না, মরেও না। ফলে লাকাঁর মতে এই other-টি মিরর সেটেজের other-এর চেয়ে অনেক বেশি বুজুর্গ, অনেক বেশি কাবেল। তাই ভাষার মাধ্যমে ব্যক্তির (subject) যে other-রূপ প্রকাশ, সেটিকে লাকাঁ বলেছেন The Big Other। মিরর ইমেজ হচ্ছে ছোট ‘আদার’ এবং ভাষা হচ্ছে বড় ‘আদার’। এই ‘বিগ আদার’ অর্থাৎ ভাষার মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্বের সবটুকু নির্মিত। তার অস্তিত্বের বা ব্যক্তিত্বের সচেতন অংশ (conscious self) এবং অচেতন অংশ (unconscious self) সবটুকুই এই ‘বিগ আদার’ বা ভাষার নির্মাণ। ফলে বলা যায়, ব্যক্তিত্বের সচেতন অংশ (conscious self) এবং অচেতন অংশ (unconscious self) উভয়ের অস্তিত্বই ভাষার মধ্যে নিহিত। এই কথাই একটু ঘুরিয়ে এভাবে বলা যায় যে, লাকাঁর মতে ভাষা মানুষের অচেতন প্রকাশের হাতিয়ার মাত্র নয়, বরং ভাষাই তার অচেতন (The unconscious)।
সাইকোঅ্যানালাইসিস বিষয়ক অন্য দুই চিন্তকের সাথে লাকাঁর পার্থক্যের এই পয়েন্টটি প্রমাণের লক্ষ্য নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম। কিন্তু এটি প্রমাণের মধ্য দিয়ে সাইকোঅ্যানালাইটিকাল সাহিত্যতত্ত্ব বোঝার জন্য সরাসরি কী লাভ হলো অর্থাৎ সাইকোঅ্যানালাইটিকাল সাহিত্যতত্ত্বের সাথে এতক্ষণের আলোচনার কী সম্পর্ক তা এখনো কিছুই বলা হলো না। তবে সে সম্পর্ক বিষয়ে বলার আগে লাকাঁর বর্ণিত মনের তিন ধারার কর্মকাণ্ডের তৃতীয় ধারা অর্থাৎ বাস্তব (real) ধারা সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। লাকাঁর বর্ণনামতে মানুষের মন এই বাস্তবের (real) সাক্ষাৎ কালেভদ্রে পেলেও তার প্রকাশ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, তার অস্তিত্বের সবটুকু প্রকাশযোগ্য নির্মাণ যেহেতু ভাষার, এবং যেহেতু সেই ভাষা হলো তার আদত অস্তিত্ব নয়, বরং আদত অস্তিত্ব থেকে দূরের এক ‘অন্য’ (other), সেহেতু, সেই ভাষা বা ‘বিগ আদার’ তার অনুভবের বাস্তবকে প্রকাশের কোনো যোগ্যতা রাখে না। মানুষ তার আবেগের বা অনুভবের তীব্রতায় যখন এমন অবস্থার শিকার হয় যে সে খুঁজে পায় না কী বলবে, তার অভ্যন্তরকে প্রকাশের অযোগ্যতায় যখন সে নির্বাক হয়ে যায়, তখন সে মূলত তার অস্তিত্বে এই বাস্তবকে (real) অনুভব করে।
এবার আমরা দেখতে চেষ্টা করবো সাইকোএ্যনালাইসিস বিষয়ে লাকাঁর ধারণাসমূহের যেগুলো এতক্ষণ আমরা আলোচনা করলাম সাইকোঅ্যানালাইটিকাল সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ে সেগুলোর অবদান বা প্রভাব কী। ইমাজিনারি আর সিম্বলিক কর্মকাণ্ড বিষয়ে লাকাঁর ধারণার উপরিস্থিত বিশ্লেষণ থেকে আমরা বুঝি যে ফ্রয়েড ও ইয়ুঙের সাইকোঅ্যানালাইসিসের ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো সাহিত্যতত্ত্ব লাকাঁর ক্ষেত্রে আর কাজ করছে না, কারণ একজন লাকানিয়ান ক্রিটিক আর সাহিত্যে সাইকোঅ্যানালাইটিক লক্ষ্মণাদি (যেমন : ইডিপাস কমপ্লেক্স, ফাদার ফিক্সেশন, মাদার ফিক্সেশন, ফ্যান্টাসি, সাবলিমেশন, প্যারাপ্রাক্সিস ইত্যাদি) খুঁজে বের করার মধ্য দিয়ে লেখকের ব্যক্তিজীবনের অচেতন চিহ্নিত করার চেষ্টা করবেন না; কিংবা আর্কেটাইপাল বিষয়াদি খুঁজে বের করার মধ্য দিয়ে মানবজাতির সামগ্রিক অচেতনকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করবেন না। একজন লাকানিয়ান ক্রিটিকের কাছে সাহিত্যে অচেতনের নিয়ন্ত্রণ দেখাতে অত দূরের বস্তু খোঁজার দরকার নেই। তিনি সাহিত্যে অচেতনের নিয়ন্ত্রণ বিশ্লেষণ করতে শুধু সাহিত্যকর্মটির ভাষা বিশ্লেষণকেই সর্বতো যথেষ্ট মনে করবেন। ফ্রয়েডের মতো তিনি ‘কনডেনসেশন’ বা ‘ডিসপ্লেসমেন্ট’ টেকনিক দিয়ে স্বপ্ন বিশ্লেষণ করতে যাবেন না। তিনি বরং ‘মেটাফর’ আর ‘মেটোনিমি’ টেকনিক দিয়ে ভাষা বিশ্লেষণ করবেন, যেহেতু লাকাঁর চিন্তা থেকে তিনি জানেন যে, ফ্রয়েডিয় সাইকোঅ্যানালাইসিসের ‘কনডেনসেশন’ বা ‘ডিসপ্লেসমেন্ট’ই ভাষায় ‘মেটাফর’ আর ‘মেটোনিমি’র মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়ে থাকে। অচেতনকে এভাবে ভাষার মধ্যে খোঁজার সময় লাকানিয়ান ক্রিটিক বরং কাজ করেন টেক্সটের সিগনিফায়ারগুলো নিয়ে আর সে কাজে তার চোখে পড়বে সিগনিফায়ারগুলোর মধ্যকার অর্থের বহুরূপতা, অর্থদ্বৈততা ও অর্থের পারস্পরিক বিরুদ্ধতা। এই দ্বিবিধ বা বহুবিধ অর্থসারির মধ্যে কোন সারি কনশাস সেলফ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আর কোন সারি আনকনশাস সেলফের নির্মাণ সেটিও তার বিশ্লেষণের বিষয়। ফলে একজন লাকানিয়ান ক্রিটিকের কাজ একইসাথে সাইকোঅ্যানলাইটিকাল থিয়রি ও পোস্টস্ট্রাকচারালিজম দ্বারা নির্দেশিত ও নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ লাকানিয়ান সাহিত্য সমালোচনা একইসাথে মনঃসমীক্ষণবাদী ও বিনির্মাণবাদী। চলবে