বাঁশখালীর গন্ডামারায় এস আলম গ্রুপ ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎপ্লান্টে সংঘর্ষের নেপথ্যে পুলিশের অতি উৎসাহী ভূমিকাকে দায়ী করেছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিক জাহেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘রমজানে আমরা আমরা ১০ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা ডিউটির দাবি জানিয়েছিলাম। ৮ ঘণ্টা ডিউটি করলে আমরা সুন্দরভাবে ইফতার এবং নামাজ পড়তে পারবো। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবি মেনে না নেওয়ায় আমরা শুক্রবার থেকে কাজ না করার ঘোষণা দিই। এরপর শনিবার (১৭ এপ্রিল) পুলিশ জোর করে আমাদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করতে গেলেই সংঘর্ষ হয়।’
জাহেদুল ইসলাম বিদ্যুৎপ্লান্টে রিগার হিসেবে কাজ করছেন। শনিবার সকালে কেন পুলিশের সঙ্গে আপনাদের সংঘর্ষ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মোট ১০টা দাবি জানিয়েছিলাম। রমজানে কর্মঘণ্টা কমাতে হবে। অনেকের দুই মাসের বেতন বাকি ছিল, আবার অনেকে নায্য পাওনা পেতো না। তাদেরকে বেতন, ন্যায্য পাওনা দিতে হবে। এসব দাবিতে শনিবার আমরা কাজ করা থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিই। সকালে কাজে যোগ না দিয়ে শ্রমিকরা এসব দাবি নিয়ে কথা বলছিল। পুলিশ এসে শ্রমিকদের বলে তোমরা কাজে যাও, ডিউটি করো। তোমাদের দাবি পূরণ করা হবে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে পুলিশ একটি প্রাইভেটকারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর কোনও কারণ ছাড়াই পুলিশ আমাদের দিকে রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে। পরে শ্রমিকরা ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করলে পুলিশ অরিজিনাল গুলি করা শুরু করে। আমরা পুলিশকে ইট পাটকেল ছুড়ে মারা ছাড়া আর কিছুই করিনি।’
শনিবার নির্মাণাধীন ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে নিহতরা হলেন আহমদ রেজা (১৮), রনি হোসেন (২২), শুভ (২৪), মো. রাহাত (২৪) ও রায়হান (২৫)। এসময় আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন। এদের মধ্যে পুলিশের তিন সদস্যও রয়েছেন। সংঘর্ষের সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশ কিছু স্থাপনা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়েকশ’ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ।
সংঘর্ষের বিষয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত অস্থায়ী শ্রমিক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, রমজানে আমরা নামাজ পড়বো, রোজা রাখবো, ইফতার করবো। নামাজ আর ইফতারের জন্য আমাদের দুটি টাইম দিতে হবে। নামাজ আর ইফতারের জন্য সময় চাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ সময় দেয়নি। তখন আমরা আন্দোলন শুরু করি। শনিবার আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছিলাম। পুলিশ এসে কোনও কারণ ছাড়াই গুলি করে।’
একই অভিযোগ করেছেন চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ আবু সৈয়দ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘রমজানের ডিউটি আওয়ার কমানোসহ কয়েক দফা দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলন করছিল। আমি তখন ওই পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। কোনও কিছু বুঝে উঠার আগে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হই।’
তবে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের অতিউৎসাহী অবস্থানকে শ্রমিকরা দায়ী করলেও রয়েছে অন্য অভিযোগ। পুলিশের দাবি, বিনা উসকানিতে শ্রমিকরা ইট-পাটকেল ছোড়ায় ঘটনার সূত্রপাত।
এ সর্ম্পকে জানতে চাইলে বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুলিশ কখনও আগে গুলি করে না। সকালে শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ তাদের নিবৃত করার চেষ্টা করে। এ সময় তারা পুলিশের ওপর হামলা করলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। শ্রমিকদের হামলায় আমাদের তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ কখন গুলি করে? একেবারে সর্বশেষ পর্যায়ে। যখন আর কোনও কিছু করার থাকে না, তখন। গন্ডামারার ঘটনায়ও পুলিশ সর্বোচ্চ ধৈর্য দেখিয়েছে। কিন্তু যখন তারা পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালায়, পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রে তাণ্ডব শুরু করে তখন পুলিশ গুলি করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গন্ডামারায় সংঘর্ষের ঘটনায় আমাদের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদেরকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ এক্ষেত্রে পুলিশের কোনও গাফেলতি থাকলে, প্রতিবেদনে তা উঠে আসবে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন:
এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘর্ষ, ৫ জন নিহত
শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় সমাবেশ
‘শ্রমের মূল্য চাইতে গিয়ে গুলি খাওয়া স্বাধীন দেশে কল্পনা করা যায় না’
বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের হতাহতের ঘটনায় বাপার নিন্দা
বাঁশখালীর ঘটনায় শাস্তির দাবি জানিয়েছে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট
বাঁশখালীতে হতাহতের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি