বিশ্বের অন্যতম ভূরাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য আবারও অস্থিরতার মুখে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘাত শুরুর পর গোটা অঞ্চলজুড়ে আতঙ্ক ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাসও হতে পারে। এই সংঘাতের সামরিক অভিঘাত বাংলাদেশে না পড়লেও অর্থনৈতিক অভিঘাত হবে গভীর, ব্যাপক ও বহুমুখী।
এই সংঘাত যদি সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নেয় এবং হরমুজ প্রণালীতে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয় কিংবা ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা হয়, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ওপরও সরাসরি এবং বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এমনটাই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা ও শিল্পপতিরা।
জ্বালানি নিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকি
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বজুড়ে অপরিশোধিত তেল সরবরাহের কেন্দ্রবিন্দু। যুদ্ধের ফলে হরমুজ প্রণালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ রফতানি রুট বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বিপর্যয়করভাবে বাড়তে পারে। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ইতোমধ্যে ১২০ ডলার ছুঁয়েছে, যা শিগগিরই ১৩০ ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রতিবছর ৬০-৭০ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দামের উল্লম্ফন সরাসরি আমদানি ব্যয় বাড়াবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ, পরিবহন ব্যয় ও শিল্প উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। সরকারকে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হতে পারে, বাড়বে বাজেট ঘাটতি। এর ফল হিসেবে জ্বালানিভিত্তিক মুদ্রাস্ফীতি ও রাজস্ব ঘাটতির শঙ্কা তৈরি হবে।
জ্বালানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য সরাসরি ধাক্কা
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হরমুজ প্রণালী দিয়ে বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জ্বালানি পরিবাহিত হয়। যদি এই প্রণালী সাময়িক সময়ের জন্যও বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেল ও এলএনজির দাম দ্রুতগতিতে বেড়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি জ্বালানিনির্ভর দেশ এবং আমদানি করা জ্বালানি—বিশেষ করে এলএনজি ও পরিশোধিত তেল—এর ওপর আমাদের নির্ভরতা বেশি। ফলে তেলের দাম বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও বাড়বে, যার প্রভাব শিল্প, কৃষি, পরিবহন ও ভোক্তা পর্যায়ে ব্যাপকভাবে পড়বে। ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা চাপে পড়বে।’
ড. রায়হান আরও বলেন, ‘জ্বালানি আমদানির ব্যয় বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়বে, টাকার মান দুর্বল হতে পারে, যার ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি আরও ত্বরান্বিত হবে।’
তার মতে, ‘হরমুজ প্রণালী বন্ধ থাকলে আমদানি-রফতানিতে বিলম্ব ও খরচ বাড়বে। তৈরি পোশাক খাত, যেটি বাংলাদেশের রফতানির প্রধান উৎস, সেখানে ক্রয়াদেশ বাতিলের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’
‘মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন। যুদ্ধের কারণে তাদের কর্মসংস্থান অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে, রেমিট্যান্স কমে যেতে পারে’, বলেন তিনি।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিকল্প জ্বালানি উৎস খোঁজা, এলএনজি সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ ও রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা জরুরি হয়ে পড়েছে।’
রফতানি ও সরবরাহ চেইনে বড় ধাক্কা
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তা চাহিদা কমবে, যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’ তিনি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও শিপিং ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বিজিএমইএর সদ্য নির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে, যা আমাদের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাকে ব্যাহত করবে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়বেন ছোট ও মাঝারি রফতানিকারকরা।’
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, যেন জ্বালানি আমদানিতে কৌশলগত পরিকল্পনা ও খাতভিত্তিক প্রণোদনা নেওয়া হয়।
বিশ্ব বাজারে অস্থিরতা: জাহাজ চলাচল ও বিনিয়োগে প্রভাব
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে জাহাজগুলোকে আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপ হয়ে যেতে হবে, এতে ১৫ দিন বেশি সময় লাগবে এবং শিপিং খরচ ৩০–৪০ শতাংশ বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলার ছাড়ালে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাবে। এর ফলে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং বাজারে চাহিদা কমে যেতে পারে।’
শিপিং খরচ ও পণ্যের সরবরাহে বিঘ্ন
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১২ শতাংশ বাণিজ্য পণ্য সুয়েজ খাল ও রেড সি (লোহিত সাগর) রুট দিয়ে পরিবাহিত হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এসব রুট ব্যবহার অনিরাপদ হয়ে পড়লে জাহাজগুলোকে আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপ ঘুরে আসতে হবে, যা ১০-১৫ দিন সময় ও বিপুল খরচ বাড়িয়ে দেবে।
বাংলাদেশের জন্য এর অর্থ হচ্ছে—আমদানিকৃত কাঁচামাল, সার, খাদ্যপণ্য ও যন্ত্রাংশের দাম বেড়ে যাবে এবং রফতানি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে। পোশাক খাতের মতো সময়-নির্ভর খাতে সময়মতো চালান পৌঁছানো কঠিন হয়ে উঠবে।
রেমিট্যান্স প্রবাহে ধাক্কার শঙ্কা
বাংলাদেশের প্রধান রেমিট্যান্স উৎস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। সেখানে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে প্রবাসীদের কর্মস্থল ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। অনেকে নিরাপত্তার কারণে ফিরে আসতে বাধ্য হতে পারেন। এর ফলে রেমিট্যান্স আয় হঠাৎ কমে যেতে পারে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ তৈরি করবে এবং টাকার মান দুর্বল হতে পারে।
মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে
তেল ও শিপিং খরচ বৃদ্ধি পণ্যের দাম বাড়াবে। খাদ্যপণ্য, গৃহস্থালি দ্রব্য, শিল্পের কাঁচামালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে খাদ্য ও জ্বালানি মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তা আরও বাড়তে পারে।
বিনিয়োগ ও উৎপাদনে অনিশ্চয়তা
অস্থির আন্তর্জাতিক পরিবেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন প্রকল্প স্থগিত রাখতে পারেন। দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সংকুচিত হতে পারেন। শিল্প খাতে কাঁচামাল আমদানির জটিলতা উৎপাদন ব্যাহত করবে, ফলে চাকরি হারানোর ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।
সময়োপযোগী প্রস্তুতি জরুরি
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুধুমাত্র ভূরাজনৈতিক সংঘাত নয়—এটি একটি গভীর অর্থনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত বহন করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল, রফতানিনির্ভর ও জ্বালানিনির্ভর দেশগুলোর জন্য এই পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটজনক হয়ে উঠতে পারে। তাই এখনই সরকার ও ব্যবসায়ীদের সমন্বিত প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি, যাতে সম্ভাব্য অভিঘাতের ঝুঁকি কমানো যায়।