চলতি বছরের কোরবানির ঈদে অন্তত ২১ শতাংশ গরুর চামড়ায় 'ফ্লে কাট' নামক ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে, যার ফলে এসব চামড়া গড়ে ৪৫ শতাংশ কম দামে বিক্রি হয়েছে। মানহীন চামড়া, অনভিজ্ঞ কসাই, সঠিক সংরক্ষণের অভাব এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের দুর্বল ব্যবস্থাপনা—সব মিলিয়ে দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
সোমবার (২৩ জুন) ঢাকায় আয়োজিত এক গবেষণা মূল্যায়ন কর্মশালায় এ তথ্য তুলে ধরে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ‘বাংলাদেশের চামড়ার সাপ্লাই চেইন: কাঁচা চামড়ার গুণগত মান ও মূল্য নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালিত হয় ফেব্রুয়ারি থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত। সহযোগী ছিল বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ও লেদার সেক্টর বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (এলএসবিপিসি)।
সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ জানান, “ফ্লে কাট” হচ্ছে চামড়া ছাড়ানোর সময় অতিরিক্ত চাপ বা ভুলভাবে ধারালো অস্ত্র ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট ক্ষত। এতে চামড়ার গুণগত মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এবার দেশে কোরবানি হয়েছে ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪টি পশু, যার মধ্যে গরু ও মহিষ ছিল ৪৭ লাখ ৫ হাজার ১০৬টি। এই বিপুল সংখ্যক পশু জবাইয়ের তুলনায় দক্ষ কসাইয়ের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত সীমিত। ঢাকা শহরেই প্রায় ২০ লাখ কোরবানির পশু জবাই হলেও পেশাদার কসাই ছিল মাত্র ১১ হাজার ৬০০ জন। সারা দেশে মাত্র ৪.৮ শতাংশ কোরবানি পেশাদার কসাই দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে ৮১.৯ শতাংশ কোরবানি হয়েছে মাদ্রাসা বা মসজিদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে, যাদের অধিকাংশই অদক্ষ।
গবেষণায় উঠে আসে, সঠিক প্রশিক্ষণ ও সংরক্ষণের অভাবে বিপুল পরিমাণ চামড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চামড়া ছাড়ানোর পর লবণ না লাগানোর প্রবণতাও ছিল উদ্বেগজনক। কোরবানিদাতাদের কারও পক্ষেই লবণ ব্যবহার করা হয়নি; মাদ্রাসার ৩৭ শতাংশ এবং মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীর ৮৩ শতাংশই লবণ ছাড়াই চামড়া বাজারে তুলেছেন।
সরকার নির্ধারিত দামে এবারের ঈদে ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ৬০-৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫-৬০ টাকা। তবে বাস্তবে মানভেদে ভালো চামড়ার গড় দাম ছিল ৩৯ টাকা এবং খারাপ মানের চামড়া বিক্রি হয়েছে গড়ে ২৭ টাকায়।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “চামড়া শিল্পে মানহীনতা ও প্রক্রিয়াজাত ব্যবস্থার দুর্বলতা বিদেশি বিনিয়োগ প্রতিহত করছে। বিশেষ করে, হেমায়েতপুর চামড়াশিল্প নগরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জমি কেনার অনুমতি না থাকায় আগ্রহ থাকলেও তারা বিনিয়োগ করতে পারছেন না।”
গবেষণা কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন বিটিএ চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ এবং প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান।
গবেষণা অনুযায়ী, পেশাদার কসাই ও আধুনিক কসাইখানার ঘাটতি এবং সংরক্ষণের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্প প্রতি বছর কোরবানির মৌসুমে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
সিপিডি সুপারিশ করেছে—চামড়া শিল্পের গুণগত মান নিশ্চিত করতে কসাইদের প্রশিক্ষণ, আধুনিক কসাইখানার বিস্তার এবং লবণসহ সংরক্ষণের জন্য সরকারি তদারকি বাড়ানো জরুরি। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে কাঁচা চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে সংস্থাটি।