X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কেন বন্ধ হলো ঐতিহ্যবাহী ওপেক্স কারখানা?

গোলাম মওলা
২৬ অক্টোবর ২০২১, ১৩:০০আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২১, ২০:৫৮

প্রায় ৪০ বছর আগে বাংলাদেশের সেরা ব্র্যান্ড ছিল ওপেক্স। গত কয়েক বছর ধুঁকে ধুঁকে শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেলো কাঁচপুরে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা কমপ্লেক্স । গত ১৮ অক্টোবর ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের কাঁচপুর শাখার কারখানা বন্ধের নোটিশ দেওয়া হয়। গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) কমান্ডার বানিজ আলী (অব.) স্বাক্ষরিত নোটিশে ১৯ অক্টোবর থেকে স্থায়ীভাবে কারখানা বন্ধের ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়। পোশাক পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ এবং বিজিএমইএ সভাপতিকে এই নোটিশের অনুলিপি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর, শ্রম অধিদফতর, নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার, শিল্প পুলিশ ও সোনারগাঁ থানা বরাবর এর অনুলিপি দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) কমান্ডার (অব.) বানিজ আলী বলেছেন,  সার্বিক বিবেচনায় কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

জানা গেছে, বস্ত্র ও পোশাক পণ্য তৈরিতে আশির দশকের শুরুতে যাত্রা করে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপ। এর কর্ণধার উদ্যোক্তা আনিসুর রহমান সিনহা। ১৯৮৪ সালে ওপেক্স গ্রুপের মাধ্যমে পোশাক কারখানা গড়ে তোলেন তিনি।  ঢাকার অদূরে কাঁচপুরে বড় কারখানা গড়ে তুলেছিল গ্রুপটি। ৪৩ একর জমির ওপর তৈরি এই প্রতিষ্ঠানটি বস্ত্র ও পোশাক খাতে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছিল।

শুধু তা-ই নয়, বিদেশেও এর ব্যবসায়িক কার্যালয় খুলেছিলেন আনিসুর রহমান সিনহা। যুক্তরাজ্য, হংকং, চীন, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রেও আছে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইলের কার্যালয়। যুক্তরাজ্যে আছে ওপেক্স ফ্যাশন লিমিটেড নামে লিয়াজোঁ অফিস। ২০১০ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়। বিশ্বের সব নামকরা বড় ক্রেতার কাজগুলো সমন্বয় ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই অফিসটি চালু করেছিলেন তিনি।

সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের মাধ্যমে পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পেও বিনিয়োগ করেন উদ্যোক্তা। এতে অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিমা ক্রেতাদের নজর কেড়েছিলেন আনিসুর রহমান সিনহা।

তবে বেশ কিছু দিন ধরেই নগদ মূলধনের অভাব, ঋণ দায়, শ্রম অসন্তোষসহ নানামুখী সংকটে ভুগছিল কারখানা কমপ্লেক্সটি। করোনা শুরু হওয়ার পর এই সংকট আরও ঘনীভূত হয়।

এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আজ পোশাকশিল্পকে এতদূর নিয়ে আসার জন্য আনিসুর রহমান সিনহা এবং ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের অবদান ব্যাপক। তার মতে, ঐতিহ্যবাহী এই কারখানাটি বন্ধ হওয়া খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তিনি উল্লেখ করেন, কাঁচপুর শাখার শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা ও ক্ষতিপূরণ দিতে ৪৫-৫০ কোটি টাকা প্রয়োজন। জমিজমা বিক্রি করে আনিসুর রহমান সিনহা তাদের পাওনা পরিশোধের চেষ্টা করছেন।

এদিকে ওপেক্স কারখানা বন্ধ হলেও দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে কোনও  প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল। তবে এটি  বন্ধের সিদ্ধান্ত আমাদের শিল্পের জন্য নেতিবাচক বলে মনে করেন তিনি।

মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, কারখানা বন্ধ ও চালু হওয়া স্বাভাবিক বিষয়। অনেকেই চালাতে না পারলে বন্ধ করে দেন। ওপেক্সের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। তবে শুরুর দিকে ওপেক্স ছিল দেশের ব্র্যান্ড। সে কারণে এত আলোচনা। এখন দেশে শত শত ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি হচ্ছে। শত শত গ্রিন ফ্যাক্টরি দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এদিকে নোটিশে স্থায়ীভাবে কারখানা বন্ধের বিষয়টি গ্রুপের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিককে জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ওপেক্স গ্রুপের স্বত্বাধিকারী ২০১২ সাল থেকে কাঁচপুরের সব কারখানায় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এরপরও ঋণ করে ও জমিজমা বিক্রির মাধ্যমে কারখানাটি চালু রাখা হচ্ছিল। কিন্তু করোনার কারণে অর্ডারের অভাব দেখা দেয়। আবার শ্রমিক-কর্মচারীদের বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি নিম্নদক্ষতা ও সময়ে সময়ে কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রাখায় কারখানার পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। এতে মালিকের চরম আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। যার ফলে বর্তমানে কারখানাগুলো চালানো আর সম্ভব হচ্ছে না।

কারখানা চালিয়ে রাখার আর্থিক সামর্থ্য মালিকের নেই উল্লেখ করে নোটিশে বলা হয়, বাধ্য হয়ে শিল্প ও শিল্পসংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ২৮(ক) ধারা অনুযায়ী ওপেক্স গ্রুপ, কাঁচপুর শাখার সব গার্মেন্ট ইউনিট ও ওয়াশিং প্লান্টসহ সংশ্লিষ্ট সব ইউনিট ১৯ অক্টোবর থেকে স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হলো।

নোটিশে আরও বলা হয়, আইনের ভিত্তিতে বেতনসহ বিভিন্ন বকেয়া পরিশোধ করা হবে। সেক্ষেত্রে শ্রম মন্ত্রণালয়, শ্রম অধিদফতর, বিজিএমইএ ও শ্রমিক প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং পাওনা পরিশোধ করা হবে। শিগগিরই পাওনা পরিশোধের তারিখ ও করণীয় সম্পর্কে নেওয়া সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করা হবে।

জানা গেছে, একসময় কাঁচপুরের বিভিন্ন ইউনিটে ৪৫ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করেছেন। এখন এই সংখ্যা ১৩-১৪ হাজারে নেমে এসেছে। বিশেষ করে গত তিন বছরে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে পড়তে হয়েছে গ্রুপটিকে। এতে ছাঁটাই হয়েছেন পুরনো অনেক কর্মী। নিয়মিত কর্মীদের বেতন বকেয়াও পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, কারখানা লে-অফের ঘটনাও ঘটেছে। করোনা পরিস্থিতিতে লে-অফ ঘোষণা করা হয়েছিল গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।  এরপর কিছু ইউনিট চালু হলেও ১০ জুন থেকে আবারও শ্রমিক অসন্তোষে বাধাগ্রস্ত হয় উৎপাদন। এছাড়া গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনাও ঘটে।

মূলত রানা প্লাজা ধস-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে কারখানাগুলো ধুঁকতে শুরু করে।। কারখানা মূল্যায়নে নিয়োজিত জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স অযাচিতভাবেই গ্রুপের কারখানা ইউনিটগুলোর ভবনের ত্রুটি নিয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে। আগে অনেক বড় ক্রেতা ওপেক্স অ্যান্ড সিনহায় কাজ দিতো। গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের অনেকে বলেছেন, আনিসুর রহমান সিনহার ব্যবসা আরও কঠিন করে তুলেছে ব্যাংক ঋণের দায়। রানা প্লাজা ধসের আগে তার বড় আকারের ব্যাংক ঋণ ছিল না। রানা প্লাজা ধস-পরবর্তী ব্যাংকে দেনা বেড়েছে। এ অবস্থায় শ্রেণিকৃত ঋণগুলো পুনর্গঠনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন এ ব্যবসায়ী।
জানা গেছে, কয়েক বছর ধরেই ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের কারখানায় প্রায়ই শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছিল। অনেক ক্ষেত্রে আইনে উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন সুবিধা দিতে বাধ্য হয়েছেন কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত আর্থিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ায় কারখানাটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

/এমআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
‘রানা প্লাজার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ করতে হবে’
রাশিয়ায় তৈরি পোশাক ও পাটজাত পণ্য রফতানি বাড়াতে চায় সরকার
ব্রাজিলকে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি তৈরি পোশাক আমদানির আহ্বান
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা