X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মি টু: নারীর যৌন নিপীড়নের জবানবন্দি ও পুরুষালী অস্বীকৃতি

জোবাইদা নাসরীন
২১ নভেম্বর ২০১৮, ১৯:১৮আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০১৮, ১৯:২০

জোবাইদা নাসরীন বাংলা ট্রিবিউনে মি টু নিয়ে এটা আমার দ্বিতীয় লেখা। প্রথম লেখাটিতে লিখেছিলাম বাংলাদেশেও মি টুর আগুন ছড়িয়ে পড়বে এবং অনেকেরই সামাজিক মুখোশ খুলে যাবে। খুবই ইতিবাচক দিক যে  নারীরা বলা শুরু করেছেন অকপটে, ঈর্ষণীয় ভঙ্গিতে। প্রায় প্রতিদিনই আমার কোনও না কোনও ছাত্রী ইনবক্স নক করে বলতে চাচ্ছে। মি টু আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক যে, নারী তার যৌন নিপীড়ন নিয়ে বলার মতো একটা পরিসর খুঁজে পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। যারা প্রশ্ন করছেন এতদিন পর কেন?  প্রশ্নটা নিজেকে করুন। কেন একজন নারী তার জীবনের ঘটনাগুলো বলতে বিশ-ত্রিশ বছর সময় নিয়েছে। যদি আপনি এখন বিশ্বাস না করেন, তাহলে ত্রিশ বছর আগে এই অভিযোগ করলে বিশ্বাস করতেন? নাকি যাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত অভিযোগ সামাজিক পরিসরে দাখিল হয়েছে, তারা ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করলে স্বীকার করে নিতেন? তা না হলে সময় নিয়ে এত আহাজারি কেন?
প্রশ্ন অনেক নারীও তুলছেন, বলছেন আমাদের সঙ্গে তো হয়নি। আপনার সঙ্গে না হলে আর কারও সঙ্গে হতে পারে না? আমার কাছে মনে হয়, বিষয়টি কে কার প্রতি আগ্রহ বোধ করলো, তার চেয়ে বড় বেশি হলো কে কাকে দুর্বল মনে করছে। সবাই নন, যৌন নিপীড়ক পুরুষদের বলছি, আপনি যখন নিপীড়ন করেন কিংবা নিপীড়নে ঝোঁক থাকে, তখন সেই মেয়েদেরই আপনার স্পর্ধা দেখাতে এগিয়ে যান, যারা আপনার বিবেচনায় প্রতিবাদ করবে না কিংবা কাউকে বলবে না। যারা চিৎকার দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আপনার সামাজিক মুখোশটা খুলে দিতে পারে, আপনি হয়তো তাদের প্রতি আগ্রহী হলেও সেই সাহস করছেন না। তাই আপনার বাছাইয়ের ক্ষেত্রও হয় দুর্বল নারী। কারণ ঘটনার সময় পর্যন্ত আপনি নিশ্চিত ছিলেন কিংবা কোনোভাবে বুঝেছিলেন, সেই সময়টিতে আপনি তার চেয়ে ক্ষমতাবান। তবে ক্ষমতা যে সব সময় একরকম নয়, তা নিশ্চিতভাবেই মি টু আন্দোলন বুঝিয়ে দিয়েছে।

তবে পুরুষতন্ত্র এতই শক্তিশালী যে, আমি প্রথম যৌন হয়রানির শিকার হয়ছিলাম একজন ভিক্ষুকের মাধ্যমে। আমি তখন খুব ছোট। মফস্বলে বড় হওয়া আমাকে মা চালসহ পাঠিয়েছেন দরজা খুলে  ভিক্ষুককে ভিক্ষা দিতে। আমার বয়স ৬/৭। দরজা খুলে ভিক্ষা দেওয়ার পর সেই বয়স্ক ভিক্ষুক দোয়া করার উছিলায় আমার গায়ে হাত দিয়ে ঘষতে শুরু করলেন। আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে মার কাছে চলে গেলাম। যৌনহয়রানি কী, আমি তা তখনও জানি না, তবে শিশু মনেই সেই দোয়া করার পদ্ধতিতে খুঁত পেয়েছিলাম। আমার সেই ছোট্ট শরীরটিই বুঝে গিয়েছিল কোনটি কী ধরনের স্পর্শ। মাকে বলায় মা বুঝতে পেরেছিলেন, হয়তো তাই এরপর থেকে আর কোনোদিন ভিক্ষা দিতে পাঠাননি। দরিদ্র ভিক্ষুকও বুঝেছিলেন তিনি ক্ষমতাবান অন্তত একজন কন্যা শিশুর কাছে। সেই ঘটনাটি আমার মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে, আমি এরপর থেকে বয়স্ক পুরুষ ভিক্ষুক দেখলেই দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইতাম।

যে কয়জন নারী মুখ খুলেছেন, তাদের কয়েকজন আমার পরিচিত। দুই-একজনের ঘটনা আগেই শুনেছি। কারও কারও বিষয়ে অভিযোগ তো  অনেকটা পাবলিক মেমোরির মতো। নাম শুনলেই সবাই একবাক্যে বলে। তবু অনেকেই বলছেন, তারা কোনোদিন শোনেননি। আমি এখানে জোর দিয়েই বলতে চাই, আমি কী শুনতে চাই, আর কী শুনতে চাই না, সেটির ক্ষেত্রেও রাজনীতি আছে। যেমন রাজনীতি আছে অভিযুক্ত আমাদের ঘনিষ্ঠ কেউ হলেই আমরা সেটিকে ‘মিথ্যা অভিযোগ’ প্রমাণ করেত ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রের ক্ষেত্রে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি তাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে। স্পষ্টতই বলতে চাই মি টু আন্দোলন কিন্তু আইনি লড়াই নয়, এখানে মুখ খুলে আভিজ্ঞতার মুখোমুখি নারীরা কিন্তু আইনি বিচার কিংবা কারও শাস্তি চাচ্ছেন না। এই আন্দোলনের শক্তি মূলত দুটি দিকে–প্রথমত নারীর কথা বলা এবং নিপীড়ন অভিজ্ঞতা বলার পরিসর তৈরি, আর দ্বিতীয়ত যৌন নিপীড়ককে বা যৌন নিপীড়নকে আজও যারা অপরাধ মানেন না, তাদের সতর্ক করা। যৌন নিপীড়ক কিন্তু এই সাত/আটজনের জন্যই নয়। এই সাত আটজনকে নিয়ে লেখা অভিযোগকারীর পোস্টের নিচে যারা ‘আহা/ এখনি বয়কট করা উচিত’ টাইপের কমেন্ট লিখেছেন, তাদের দুই/চারজনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ শুনেছি। ভাবখানা এমন যে, আমাদের বিরুদ্ধে তো অভিযোগ ওঠেনি, তাই যতদিন পারি প্রতিবাদীর পাটাতনেই থাকি। তাদেরই বলছি, সবে তো শুরু। আবারও বলছি, মি টু আন্দোলন কোনও হুমকি নয়, নারীর অনেকদিনের কষ্টের অনুভূতি, পুষে রাখা অসম্মানের চিহ্ন নিয়ে হাজির হওয়ার সাহস অর্জন করা। আইনের বিচার নয়, সামাজিক বিচারের গুরুত্বকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার আন্দোলনই মি টু। আর নারী যে সাহস করে তার শরীরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এবং এতদিন প্রশ্নহীনভাবে চর্চিত থাকা অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষালী আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছে, এটাই মি টু আন্দোলনের প্রাথমিক অর্জন। যৌন নিপীড়কদের অনেকেই ঢুকেছেন মি টু’র মঞ্চে, তেমনি দুই-চারজন এগিয়ে আসছেন, বলছেন এবং মার্জনাও চেয়েছেন। যেমন চিররঞ্জন সরকার তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন,  ‘আমার বক্তব্য পরিষ্কার, ঠাট্টা-মস্করা করে, টিপ্পনি কেটে, পাল্টা বক্তব্য দিয়ে, (অপ)যুক্তির মালা সাজিয়ে নিজেদের পাপ আড়াল করা যাবে না! #metoo আন্দোলন যত শক্তিশালী হবে পুরুষদের উদ্ধত মুখগুলো তত কালিমালিপ্ত হবে। কে কত হীন, তা-ই শুধু প্রকাশিত হবে। যৌন-লালসা চরিতার্থ করার ব্যাপারে, যৌন হয়রানির ব্যাপারে কম-বেশি আমরা সবাই অপরাধী। আপনি-আমি হুজুর-মজুর কেউ-ই ধোয়া তুলসীপাতা নই! কাজেই বিনীত হোন, তওবা করুন, ক্ষমা চান। অতীতে তো পারেননি, এখন থেকে অন্তত নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার বোধটা জাগ্রত হোক!  মুখোশটাকে প্রতিষ্ঠিত করার মিথ্যে চেষ্টা করে কী লাভ? হ্যাঁ, পুরুষ বলেই কথাগুলো বলছি। 

অনেক যৌন নিপীড়কের চোখেই এখন ঘুম নেই। ভয়ে আছেন, কখন কার মুখাশটি খুলে যায়। নিজেকে শোধরান। নিজেদের পাল্টানোর জন্যই মি টু।

লেখক: নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ