X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ও এনজিও বিদ্বেষ এবং আমার দুটো কথা

আরিফ জেবতিক
২৭ আগস্ট ২০১৯, ১৫:৪০আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০১৯, ১৫:৪২

আরিফ জেবতিক রোহিঙ্গা নিয়ে আমাদের স্টেরিওটাইপ চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে, এরা আমাদের বাড়িতে থাকা গ্রামের গরিব আত্মীয়-স্বজনের মতোই, দু’বেলা দুটো খেতে দেবো আর লাথি-ঝাঁটা মারবো, ওরা চুপ করে থাকবে। রোহিঙ্গাদের লাখো মানুষের সমাবেশ দেখে তাই বাংলাদেশ চমকে উঠেছে। একটি আশ্রিত জনগোষ্ঠীর এমন সাংগঠনিক শক্তি থাকতে পারে, তা সাধারণ লোকজনের কাছে অবিশ্বাস্য। সুতরাং শুরু হয়েছে রোহিঙ্গা বিদ্বেষ।
এ প্রসঙ্গে আমার কিছু মতামত বলে রাখি।
১. রোহিঙ্গাদের এই সমাবেশের ভালো দিক আছে। একটা নির্যাতিত জনগোষ্ঠী যদি ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ প্রতিরোধের সূচনা করতে পারে, তাহলে আমাদের সেটা স্বাগত জানানো উচিত। মানুন আর না মানুন, বাস্তবতা হচ্ছে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছুক না। তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই তাদের স্বভূমে এই গণহত‌্যা চালানো হয়েছে। সুতরাং এর পাল্টা হিসেবে রাজনৈতিক প্রতিরোধ রোহিঙ্গাদের একমাত্র মাধ্যম। বড় ধরনের সমাবেশ আন্তর্জাতিক মহলকে এই ইস্যুতে সচেতন রাখবে।

রোহিঙ্গারা যে দাবি করেছে নাগরিকত্ব এবং নিরাপত্তা ছাড়া তারা নিজ দেশে ফেরত যাবে না, সেটি তাদের তরফ থেকে যৌক্তিক দাবি। নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাবিহীন ফিরে যাওয়া মানে এই সমস্যা কখনোই স্থায়ী সমাধান হবে না। মিয়ানমার ইচ্ছামতো তাদের ফিরিয়ে নেবে আবার মেরে কেটে তাড়িয়ে দেবে। সুতরাং রাজনৈতিক সমাধান, তা যত দীর্ঘ প্রক্রিয়াই হোক না কেন, সেটার চেষ্টা অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে।

আর এই চেষ্টার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাজনৈতিক সচেতনতা ও সংগঠন প্রয়োজন। দ্বিতীয় ধাপে নিজের আবাসভূমি উদ্ধারের জন্য সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ একটি বড় সম্ভাবনা। কিন্তু রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া সশস্ত্র যুদ্ধ কখনোই সাফল্য পাবে না। তবে খেয়াল রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক সংগঠন যেন তাদের আশ্রয়দাতাদের জন্য মাথাব্যথার কারণ না হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের উচিত হবে রোহিঙ্গা রাজনৈতিক শক্তি যাতে সঠিক লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, সেটি নিশ্চিত করা। পৃথিবীর দেশে দেশে এই কাজ আগেও হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আশ্রয়দাতা দেশ ভারত আমাদের প্রবাসী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা ও সহায়তা করেছে।

২. সমাজে কিছু বড় বড় রোহিঙ্গা বিদ্বেষী কথাবার্তা চালু হয়েছে। যেমন—এদের জন্মহার বেশি। আমাদের নিজেদের চাচা-ফুফুর সংখ্যা গুনে দেখুন। মামা-খালাদের সংখ্যা গুনে দেখুন। খুব কম পরিবার পাবেন যেখানে আমাদের দাদা-নানারা কমপক্ষে ৭/৮ জন করে বাচ্চা জন্ম দেননি। এখন বাংলাদেশে এই প্রবণতা কম। এর কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণের ওপর প্রচারণা চালানো হয়েছে, ছোট পরিবারের পক্ষে অ্যাডভোকেসি করা হয়েছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গারা সেই সুযোগ পায়নি। এদের যুগের পর যুগ ‘বার্মা’ জান্তারা অবরুদ্ধ রেখেছে। এদের না ছিল শিক্ষার অধিকার, না কমিউনিকেশন, চিকিৎসা জ্ঞান লাভের অধিকার। এরা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর তুলনায় একশ’ বছর পিছিয়ে আছে, সেই আমাদের নানা-দাদাদের যুগে আছে। সুতরাং আমাদের চশমা দিয়ে তাদের দেখলে হবে না, দোষারোপ করলে চলবে না। বরং রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় আকারে প্রচার-প্রচারণা চালানো, টিকাদান কর্মসূচি এসব করে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে আগে সচেতন করতে হবে।

এর বাইরে রোহিঙ্গাদের অপরাধপ্রবণতা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। আমাদের অনেকের মনেই হয়তো একটা ধারণা ছিল, তাদের আশ্রয় দিয়েছি এই খুশিতে তারা নেতিয়ে পুতিয়ে বসে থাকবে। জিকির-আজকার করে বাকি জীবন পার করে দেবে।

বাস্তবতা তা নয়। আমরা দশ লাখ মানুষ নিয়ে কথা বলছি! দশ লাখ মুখের কথা নয়। আমাদের কয়টা শহরে ১০ লাখ লোক বাস করে? সেই শহরগুলোতে কি চুরি-ছিনতাই-খুন-রাহাজানি হয় না? তাই বলে কি আমরা সেই শহরের কি জেলার সব লোকই খারাপ, এমন কথা বলতে পারি? ১০ লাখ লোক একসঙ্গে থাকলে সেখানে সাধু-সন্তরা যেমন থাকবে তেমনি চোর-বাটপাড়-খুনি-ধর্ষকও থাকবে—এটাকে বাস্তবতা হিসেবেই ধরে নিতে হবে। আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে আমরা চেষ্টা করবো এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে, কিন্তু এর জন্য গোটা জনগোষ্ঠীকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না।

৩. রোহিঙ্গাদের অপরাধপ্রবণতা একটু বেশি হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। বড় কারণ হচ্ছে, এদের কাজকর্ম নেই। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। রোহিঙ্গাদের খাবার ফ্রি, বাড়ি ফ্রি, চিকিৎসা ফ্রি। অন্যদিকে কোনও কাজকর্ম নেই। সুতরাং অকাজ তারা তুলনামূলক বেশি করতে পারে। তাদের কিশোর, যুবক, তরুণরা কী করবে? কত আর আড্ডা মেরে সময় পার করা যায়? সুতরাং তারা গ্যাংবাজিতে জড়িয়ে পড়বে, এটা হতেই পারে। এদের কীভাবে কাজকর্মে যুক্ত করে ব্যস্ত রাখা যায়, সেদিকটা আমাদের ভেবে বের করা দরকার।

৪. একটা সিরিয়াস ইস্যু হচ্ছে স্কুলিং। বাংলাদেশ সরকার ক্যাম্পগুলোতে সাধারণ কারিকুলাম পড়াতে দিচ্ছে না, যেটি খুবই সঠিক সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ রোহিঙ্গা শিশুরা বাংলা ভাষার শিক্ষা সেখানে পাবে না, তারা পাবে মিয়ানমারের ভাষায় শিক্ষা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মিয়ানমারের ভাষা জানা শিক্ষক পর্যাপ্ত পরিমাণ আমরা দিতে পারবো না। তাই প্রয়োজনীয় স্কুল আমরা করতে পারছি না সেখানে। তাছাড়া যেহেতু জীবন রক্ষা করে তাদের বাঁচিয়ে রাখাটাই সেখানে প্রায়োরিটি, স্কুলের দিকে তাই তেমন নজর দেওয়া হয়নি গত দুই বছরে। সেখানে অবশ্য কিছু মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। মাদ্রাসার মাধ্যম যেহেতু আরবি, তাই সেটি স্থাপনে তেমন জটিলতা নেই। কিন্তু মাদ্রাসার কারিকুলাম কি সেটি মনিটর করা হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা কী হবে, সেটি নির্ধারণ করার এখন সময় চলে এসেছে। তাদের অশিক্ষিত অসচেতন হিসেবে বড় হয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিশ্বের সবার জন্যই দায়।

৫. সম্প্রতি আরেকটি বড় বিদ্বেষের জায়গা হচ্ছে এনজিও বিদ্বেষ। অনেকে তো এরকম বলতেও ছাড়ছেন না, এনজিওরা তাদের ব্যবসা নষ্ট হবে বলে রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে নিরুৎসাহিত করে। কথাটা বলার আগে দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত। এনজিওরা কি এদেশে রোহিঙ্গা ঢুকিয়েছে? না, তারা ঢোকায়নি, আমরা সেধে সেধে এদের নিয়ে এসেছি। এনজিওরা এই লাখ লাখ রোহিঙ্গা ম্যানেজমেন্টে আমাদের সাহায্য করছে। আজকে এনজিওদের বের করে দিলে কালকে সরকারের পক্ষে এককভাবে এই সমস্যা সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।

প্রথমে জানতে হবে রোহিঙ্গা পালনে যে বড় খরচ, অর্থাৎ এদের খাদ্য-চিকিৎসা-বাসস্থান, এসব কিন্তু বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে না। এগুলো আসলে আন্তর্জাতিক সাহায্য হিসেবে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো তাদের দেশগুলো থেকে ফান্ড জোগাড় করছে এবং সেই টাকায় রোহিঙ্গাদের দেখভাল করছে। সুতরাং এনজিওদের বের করে দিলে এই দশ লাখ লোকের খাওয়ানো পরানোর দায়িত্ব আমাদের ঘাড়ে এসে পড়বে। বাংলাদেশ সরকার নিশ্চয়ই অন্য দেশে গিয়ে ফান্ড জোগাড় করতে যাবে না। এখন বলতে পারেন, এনজিও লাগবে কেন। বিদেশি সাহায্য আমাদের সরকারের মাধ্যমে বিলি বন্দোবস্ত হোক।

প্রথম কথা হচ্ছে, যারা টাকা দেয় তারা নিজেরাই সেটা তাদের মতো করে স্বচ্ছতা বজায় করে ব্যবস্থাপনা করে। সরকারের কাছে দিলে প্রতিনিয়ত তারা এর স্বচ্ছতা নিয়ে হাউকাউ বাধাবে এবং একপর্যায়ে পদ্মা সেতুর ফান্ডের মতো করে এখান থেকেও ফান্ড উইথড্র করে নেবে। তখন সব দায় এসে পড়বে সরকারের ঘাড়ে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, এমনিতেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের ব্যাপক খরচ হচ্ছে ব্যবস্থাপনা রক্ষা করতে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন রাখতে, বেসরকারি প্রশাসনের মনিটরিং বজায় রাখতে ব্যাপক লোকবল যুক্ত রাখতে হচ্ছে। এখন যদি একেবারে ১০ লাখ লোকের সব কাজকর্ম দেখভাল করতে হয়, তাহলে সেখানে আরও অনেক বড় আকারে প্রশাসনিক অবকাঠামো চালু করতে হবে, যা শুধু ব্যয়ের কারণেই নয়, ম্যানজমেন্টের দিক থেকেও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে? আসলেই সেটা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। সাময়িকভাবে সরকার তাদের ভাষানচরে সরিয়ে নিতে চেয়েছিল। উদ্যোগটা কেন থেমে আছে, আমি জানি না। কিন্তু এদের কক্সবাজারের ক্যাম্প এলাকা থেকে স্থানান্তর করে অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়াটা আসলেই জরুরি। নিরাপত্তার কারণে এতো বড় জনগোষ্ঠীকে এরকম স্পর্শকাতর এলাকায় বছরের পর বছর রেখে দেওয়া ঠিক হবে না। বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছে। আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়েছে। এর মাশুল বাংলাদেশকে দিতে হয়েছে বিভিন্ন সময়। রোহিঙ্গা স্থানান্তরের সিদ্ধান্তটি আটকে থাকা তেমনই এক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত বলে আমার মনে হয়।

লেখক: ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট

    

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ