X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল কালাম ‘আমাদের’ নয়

ড. জোবাইদা নাসরীন
০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:১১আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:১৩

জোবাইদা নাসরীন নাম তার আবুল কালাম। পেশায় তিনি ছিলেন ফুলবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এইতো মাত্র কয়দিন আগে একটি আন্দোলনের বিপরীতে তাকে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টিকে আমি এভাবেই হত্যাকাণ্ড হিসেবেই দেখি। এই ঘটনাটি ঘটেছে ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া কলেজ জাতীয়করণের দাবি চলছিল। সেই দাবি দমিয়ে রাখতে রাষ্ট্রকে পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করতে হয় এবং তাতে প্রাণ হারান শিক্ষক আবুল কালাম। গত বছর সচিবদের চেয়ে কম বেতন হওয়ায় বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জোরদার আন্দোলনে নেমে ছিলেন, জোর গলায় বলেছেন শিক্ষকরা সচিব বানায়। এই সচিবরা একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সচিব গড়ার কারিগর। হ্যাঁ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও একদিন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র ছিলেন, এদের কারও না কারও কলেজ জীবনেই আবুল কালামের মতো বুক টান টান করে দাঁড়ানো শিক্ষক ছিলেন, জীবন লড়াকু ছিল। কেউ কেউ হয়তো সেই শিক্ষককে তার জীবনের হিরো ভাবতেন। কিন্তু আবুল কালামের মৃত্যু তাদের কাউকেই বিচলিত করেনি, যার কারণে শিক্ষকদের তৈরি করা কোনও পাটাতন থেকে এই মৃত্যু নিয়ে কোনও ধরনের প্রতিবাদ আসেনি। কারণ শিক্ষকদের মধ্যেও যে রয়েছে বৈষম্য। সমাজের বিভিন্ন বৈষম্য নিয়ে কথা বলা এবং এই বিষয়ে জনগণকে সব সময় জ্ঞান দেওয়া বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চুপ থাকেন আবুল কালামদের মৃত্যুতেও। কারণ তিনি শিক্ষক হলেও তাদের নয়।
বাংলাদেশের শিক্ষা আন্দোলন দীর্ঘদিনের। সরকারি বাজেটে সবচেয়ে অবহেলিত খাত শিক্ষা। সরকার শিক্ষাখাতে বাজেট কমিয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেদের আয় বাড়াতে বলে। মাথা তোলে স্বান্ধ্য কোর্সগুলো। শিক্ষা সংক্রান্ত যেকোনও আন্দোলন দমাতে রাষ্ট্র সকল সময় সজাগ। যে কারণে শিক্ষক আজাদের মৃত্যু হওয়ার পর সেই এলাকায় তড়িঘড়ি করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয় যেন সেই শিক্ষকের মৃত্যুকে ঘিরে পুনরায় কোনও আন্দোলন না শুরু হয়। সেই ১৪৪ ধারায়ই যেন রাষ্ট্রের চাওয়া পূরণ করে। আজাদ প্রতিবাদের স্মারক হয়ে আসেনি আর।

দুই.

এদেশে শিক্ষা আন্দোলন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, বর্ধিত ফি বাতিল, শিক্ষাঙ্গলে আবাস সংকট, শিক্ষকদের বেতনভাতা এই সকল বিষয় নিয়ে আন্দোলন, মিছিল, ধর্মঘট, আমরণ অনশন, স্মারকলিপি, মানববন্ধন নানা দফায় দেন দরবার নিত্য নৈমিত্যিকতায় দাঁড়িয়েছে তবে শিক্ষকদের আন্দোলন দমানোতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং টিয়ার গ্যাস এবং পেপার স্প্রের ব্যবহার শিক্ষকের মৃত্যু কোনও কিছুই এখন আর নতুন নয়। ২০১৩ সালে জানুয়ারি মাসে নন-এমপিও শিক্ষক-কমর্চারীরা দেশের সকল স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে যে লাগাতার কর্মসূচি পালন করেছিল সেই আন্দোলন দমাতে পুলিশ সেখানে পেপার স্প্রে ব্যবহার করে। সেই স্প্রের কারণে সেই আন্দোলন সেকান্দর আলী নামের একজন শিক্ষকের মৃত্যু হয় এবং অনেক শিক্ষক অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। তবে সেই সময়ও চুপ ছিলেন সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের সংগঠন এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। কারণ এই শিক্ষকরাও যে তাদের 'জাত' এর শিক্ষক নয়।

তিন.

তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষা বিষয়ে আন্দোলন বন্ধ করতে, ঠেকাতে, দমাতে সরকার যতোটা মনোযোগী ঠিক ততোটাই অমনোযোগী শিক্ষা বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি, ক্যাডারিজম রুখতে এবং যৌন হয়রানি রুখতে। বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষকদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা, এমপিরা। এদেশে শিক্ষাখাতে সবচেয়ে কম বাজেট থাকে, শিক্ষার মান বিবেচিত হয় পিএসসি, জিএসসি, এসএসসি আর এইচএসসি পরীক্ষার পারে হার দিয়ে। সেখানে শিক্ষার উপকরণ, শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সমস্যা বিবেচনার এজেন্ডায় থাকেনা। যে কারণে যেখানে শিক্ষা সংক্রান্ত আন্দোলন, সেখানে তা দমনের প্রসঙ্গ আসে।

এখানে আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে শিক্ষকদের আন্দোলন কোনোভাবেই শিক্ষার বাইরেরু আন্দোলন নয়। এটি শিক্ষা আন্দোলনই অংশ। আর শিক্ষার অধিকার এবং শিক্ষাকেন্ত্রিক আন্দোলন গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই একটি ধারা। আর এই শিক্ষা আন্দোলনকে দমানোর ইতিহাসও নতুন নয়। এটিও পাকিস্তান আমলের মনস্কতারই একটি পুনরুৎপাদন। পাকিস্তান আমলে আইয়ূব খান ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বয়ত্বশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র শিক্ষকদের কাজের ওপর নজরদারীর প্রস্তাব করে। এর প্রতিবাদে যে আন্দোলন তৈরি হয় তাতে পুলিশ এবং ইপিআর গুলি চালায়। সেই আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন বাবুল, গোলা মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ এবং সুন্দর আলী নামের এক শ্রমিক।

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৫ বছর আগে। দফায় দফায় হয়েছে শিক্ষানীতি। শিক্ষা অধিকার থেকে রূপান্তরিত হয়েছে বাণিজ্যে। শিক্ষা ব্যবস্থায় আছে বৈষম্য। বাজেটে শুধু শিক্ষা খাতে ব্যয়ই কম নয়, সবচেয়ে কষ্ট করা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেডও অনেক নিচে। এই শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের করা কোনও মোর্চার অংশ হয় না। আমাদের সবারই শৈশবের শিক্ষার কারিগর এই শিক্ষকদের কান ধরে ওঠা বসার হুকুম দিতেও আমাদের বিবেক ক্ষত হয় না।

আরা চুপ থাকি, কী এক অদৃশ্য ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে আমরা যেনে যাই কে আমাদের অংশ আর কে না? কে শিক্ষক হলেও আমরা তার জন্য রাজনৈতিক আহাজারী করবো না, শোরগোল তুলবো না, প্রতিবাদী হয়ে ওঠবো না। আশেপাশে লক্ষ্য রেখে অনেক হৈ চৈ শুরু হলে আমরাও একটি ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের সান্ত্বনার জায়গা তৈরি করবো। কাকে নিয়ে আমরা আর কে আমাদের না এই হিসেবটি খুবই জটিল। কেননা 'আমরা' আর 'আমাদের' নিয়েই হয় আসল রাজনীতি, তাইতো আবুল কালামরা মৃত্যুর মধ্য দিয়েও আমাদের হতে পারে না।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
‘স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচতে প্রত্যেককে গাছ রোপণ করতে হবে’
‘স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচতে প্রত্যেককে গাছ রোপণ করতে হবে’
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হামাস, অগ্রহণযোগ্য বলছে ইসরায়েল
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হামাস, অগ্রহণযোগ্য বলছে ইসরায়েল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ