X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

উপকমিটি

আমীন আল রশীদ
১৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:১০আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:৫৬

আমীন আল রশীদ বড় রাজনৈতিক দলের উপকমিটি বরাবরই এক আশ্চর্যের জায়গা। সেই আশ্চর্যে এবার যুক্ত হয়েছেন চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক উপকমিটির খসড়া তালিকায় স্থান পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন অর রশিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. কামরুল হাসান খান। কমিটিতে ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ১১জন শিক্ষক রয়েছেন। যদিও কমিটি এখনও চূড়ান্ত নয়।
শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া নতুন কিছু নয়। বরং শিক্ষক সমিতির যে নির্বাচন হয়, সেখানে দলীয় প্রতীক না থাকলেও নীল দল-সাদা দলের বিভক্তি মূলত রাজনৈতিক। দেশের বড় দু’টি দলের ব্যানারেই শিক্ষকরা থাকেন এবং কোন শিক্ষক কোন পন্থী, তাও গোপন থাকে না। শুধু তাই নয়, উপাচার্য নিয়োগও যে হয়, রাজনৈতিক বিবেচনায়, তাও এখন মোটামুটি সিদ্ধ।

বলা হয়, নাগরিক হিসেবে শিক্ষকদেরও রাজনৈতিক আদর্শ বা পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। কিন্তু সরাসরি কোনও দলের কমিটিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের অন্তর্ভুক্তির ঘটনা সম্ভবত এটিই প্রথম হতে যাচ্ছে; তাও একসঙ্গে চারজন।

বিষয়টির নানা ব্যাখ্যা হতে পারে। নানা প্রশ্নও উত্থাপিত হতে পারে। প্রশ্ন আসতে পারে নৈতিকতার। যেমন বলা হয়, একজন সাংবাদিক সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন না। কারণ এতে তার নিরপেক্ষতা–অর্থাৎ সাংবাদিকতার প্রথম শর্তই লঙ্ঘিত হয়। সে হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদটি আরও বেশি সম্মানের এবং অধিকতর নিরপেক্ষতার দাবি রাখে। সুতরাং উপাচার্যের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ, অতি সংবেদনশীল এবং অতি সম্মানিত একটি পদে থাকা অবস্থায় কোনও রাজনৈতিক দলের–তা যে দলের ও যে কমিটিরই হোক, শিক্ষকরা যুক্ত হবেন কিনা, সেটি তাদের যতটা না আইনি তার চেয়ে অনেক বেশি নৈতিকতার প্রশ্ন।

যদিও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমান মনে করেন, শিক্ষিত লোকেরা রাজনৈতিক দলে যুক্ত না হলে অশিক্ষিত এবং অযোগ্য লোকেরা এই জায়গা দখল করবে। তাছাড়া সরকারি চাকরিজীবীরা যে রাজনৈতিক দলে থাকতে পারবেন না, এমন কোনও আইন নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

কথাটি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সরাসরি কোনও রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন, তিনি কি তার শ্রেণিকক্ষে বা পেশায় নিরপেক্ষ থাকতে পারেন? তিনি যে দলের কমিটিতে থাকবেন, তার বিরোধী কোনও দলের ছাত্রনেতার বা দলীয় কর্মীর সঙ্গে তিনি কি অভিভাবকসূলভ আচরণ করতে পারবেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলে, সেটি ছাত্র সংসদ নির্বাচন (যদিও ছাত্র সংসদ নির্বাচন বিষয়টাই আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে) বা এ রকম কোনও ইস্যুতে সৃষ্ট হয়, তখন ওই উপাচার্য কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন? তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য যে পরিমাণ ব্যস্ত থাকেন বা থাকতে হয়, তাতে তার পক্ষে রাজনৈতিক দলকে সময় দেওয়া আদৌ কি সম্ভব?

এটা ঠিক যে, শিক্ষিত লোকেরা রাজনীতিতে আসছে না বলে সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে অশিক্ষিতরা। কিন্তু তার অর্থ কি এই যে, একজন উপাচার্যকেও দলীয় পদ-পদবি গ্রহণ করতে হবে? তিনি অবসরে যাওয়ার পরেও তো সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেন এবং এটি হলে তখন আর তার নৈতিকতা বা নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না।

তবে শিক্ষিত ও সজ্জন লোকদের রাজনীতিতে আসা বা জনপ্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ আইনিভাবেই বন্ধ করা হয়েছে। যেমন, একসময় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনেক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, যারা সমাজে একইসঙ্গে ভালো মানুষ এবং মানুষের জন্য কাজ করার মানসিকতাসম্পন্ন বলে পরিচিত ছিলেন, তারা অংশ নিতেন। অনেকে বিজয়ী হতেন। দলীয় ব্যানার না থাকায় সব দলের লোকেরাই তাকে ভোট দিতেন। অর্থাৎ দলীয় পরিচয়ের বাইরে তার ব্যক্তি পরিচয়ই সেখানে মুখ্য ছিল। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সমাজের নিরপেক্ষ এই অংশের জনপ্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। এখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতে গেলেও তাকেও নৌকা-ধানের শীষের প্রতীক নিতে হয়। কিন্তু তৃণমূলে রাজনীতির যে ‘দলাবাজি’ আর ‘নোংরামি’, তাতে এই শিক্ষিত শ্রেণি কখনোই যুক্ত হতে চাইবে না।

তবে উপাচার্যদের দলীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া না হওয়ার চেয়েও বড় প্রশ্ন কারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হচ্ছেন? গত মে মাসে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একেএম নুরুন নবি রাতের আঁধারে পুলিশি পাহারায় বাসভবন ছেড়েছেন। যিনি কোষাধ্যক্ষসহ একইসঙ্গে ১৪টি পদে একাই দায়িত্ব পালন করতেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেয় তদন্ত কমিটি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মিজানুর রহমানকে নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। ‘বিশেষ কর্মকর্তার’পদ তৈরি করে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ছাত্রলীগের ১২ জন নেতাকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সবশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে যা হলো, তাও কাঙ্ক্ষিত নয়।

সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা এতটাই উঁচুতে যে, তারা যা বলেন, তা দলমত নির্বিশেষে সবাই মানতে চায়। একজন শিক্ষকের কাছ থেকে মানুষ সর্বোচ্চ নৈতিকতা এবং নিরপেক্ষতা আশা করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এইসব যোগ্যতা বা গুণ থাকলেই সম্ভবত এখন তিনি ভিসি হওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়েন। এখন ভিসি হওয়ার প্রধানতম যোগ্যতা দলীয় আনুগত্য এবং এটি যেকোনেও সরকারের আমলেই?

ভিসির মূল দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ঠিক রাখা, গবেষণার নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারে সহায়তা দেওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের সাথে দেন-দরবার করা। ব্যক্তিগত লোভ-লালসা তাকে গ্রাস করলে, রাজনৈতিক পদ-পদবির লোভ তিনি সামলাতে না পারলে একজন সাধারণ পেশাজীবীর সঙ্গে তার কোনও পার্থক্য থাকে না।

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে গবেষণার উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারছে না, নেতৃত্ব তৈরির মঞ্চ হতে পারছে না, এর পেছনে শিক্ষকদের এই দলীয় আনুগত্যই যে প্রধানত দায়ী, সে বিষয়ে কেউ কি দ্বিমত পোষণ করবেন?

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

/এসএএস/ এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লড়াই করেও কিংসের কাছে হারলো আবাহনী
লড়াই করেও কিংসের কাছে হারলো আবাহনী
গণতান্ত্রিক যেকোনও বিষয়কে বিএনপি ফাঁদ মনে করে: ওবায়দুল কাদের
গণতান্ত্রিক যেকোনও বিষয়কে বিএনপি ফাঁদ মনে করে: ওবায়দুল কাদের
২২ বছর পর প্রিমিয়ার লিগে ইপসউইচ
২২ বছর পর প্রিমিয়ার লিগে ইপসউইচ
৩২ ঘণ্টা পর লাইন ক্লিয়ার, ট্রেন চালুর অপেক্ষা
৩২ ঘণ্টা পর লাইন ক্লিয়ার, ট্রেন চালুর অপেক্ষা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ