X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

সিটি নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ

প্রভাষ আমিন
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৭:৫৬আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৭:৫৮

প্রভাষ আমিন পরীক্ষা আর খেলা দুটিই প্রতিযোগিতা। আর দুটির মধ্যে একটি মিলও রয়েছে। পরীক্ষায় পাস যেমন আছে, তেমনি ফেলও আছে। আছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হওয়ারও সম্ভাবনা। খেলার ক্ষেত্রেও তেমনি রয়েছে জয়-পরাজয়। আছে ড্রয়েরও সম্ভাবনা। তবে, নির্বাচনে সাধারণত জয়-পরাজয় থাকলেও ড্রয়ের সম্ভাবনা খুব কম। এক্ষেত্রে হয় আপনি জিতবেন, না হয় হারবেন। মাঝামাঝি কিছু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এক ভোট কম পেলেও আপনি হারবেন, এক লাখ ভোট কম পেলেও হারবেন। নির্বাচন প্রসঙ্গে তাই বারবার ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা আসে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলার জন্য মাঠ সমতল হওয়াটা খুব জরুরি। যেমন গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। উত্তরে আরও ৫ জন, দক্ষিণে আরও ৬ জন প্রার্থী ছিলেন। যে যাই ভোট পান, বাকি সবাই পরাজিত।
তবে ভোটের অঙ্কের বাইরেও রাজনীতিতে জয়-পরাজয়ের অনেক হিসাব-নিকাশ আছে। অনেক জয়ে যেমন গ্লানি আছে, তেমনি গৌরব আছে অনেক পরাজয়েও। ভোটের হিসাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আতিকুল ইসলাম প্রদত্ত ভোটের ৫৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তবে সমস্যা হলো উত্তরে ভোট দিয়েছেন মাত্র ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোটার। আর মোট ভোটারের মাত্র ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশের সমর্থন নিয়ে মেয়রের দায়িত্বে যাচ্ছেন আতিকুল ইসলাম। দক্ষিণের অবস্থা কিছুটা ভালো। দক্ষিণের ২৯ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে গিয়েছিলেন, যার ৫৯ দশমিক ৫৫ শতাংশই পেয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস। তবে তিনিও মোট ভোটারের ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশের সমর্থন নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনি বিধান অনুযায়ী তাদের মেয়র হওয়ার কোনও আইনগত জটিলতা নেই। ভোটের হারের কোনও মানদণ্ড নেই। যত জন ভোটার কেন্দ্রে যাবেন, তাদের মধ্যে যিনি বেশি ভোট পাবেন, তিনিই নির্বাচিত হবেন। আইনগতভাবে কোনও সমস্যা না থাকলেও ১৫ শতাংশ আর ১৭ শতাংশ ভোটারের সমর্থন নিয়ে মেয়রের চেয়ারে বসাটা নৈতিকভাবে তত শক্ত হলো না। তাই তাদের জয়টা ততটা গৌরবের নয়।

এই অগৌরব এসেছে ভোটারদের অনাগ্রহের হাত ধরে। যে যাই বলুক, এটা নির্বাচনের প্রতি, নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থারই প্রকাশ। এটা একধরনের প্রতিবাদও। তবে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ভোটার আছে কমবেশি ৪০ ভাগ। তার মানে আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও কেন্দ্রে যাননি। এই ব্যাখ্যাটা দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর। তার ব্যাখ্যা হলো, ‘অনাস্থার কারণে যদি ভোটকেন্দ্রে না যেতেন, তাহলে যারা সরকারি দলের, তাদের অন্তত ভোটে অনাস্থা থাকার কথা নয়। তাদের সব ভোটার যদি ভোট দিতে যেতেন, তাহলেও তো এতো কম ভোট পড়তো না। তার মানে তাদের অনেকেও ভোট দিতে যাননি। আমি ভোট না দিতে গেলেও সমস্যা নেই—এ ধরনের একটা মনোভাব থেকে হয়তো অনেকেই ভোট দিতে যাননি।’ তিনি একটা সত্যি কথা বলে দিয়েছেন, আমি ভোট না দিতে গেলেও সমস্যা নেই। এই মানসিকতা গণতন্ত্রের জন্যই এক বড় সংকট। অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে সেই রাজার দুধের পুকুরের মতো। সবাই ভাবছে, সবাই তো দুধই দেবে, আমি না হয় পানিই দেই। এই করতে করতে রাজার পুকুর দুধের নয়, পানির পুকুর হয়ে গিয়েছিল। এখন গণতন্ত্রের সংকটটা দাঁড়িয়েছে এখানেই। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানেন, শেখ হাসিনাই তাদের মনোনয়ন দেবেন, শেখ হাসিনাই জিতিয়ে দেবেন। ‘আমি ভোট না দিতে গেলেও সমস্যা নেই’—এই সিনড্রোমে এখন আক্রান্ত আমাদের গণতন্ত্র, নির্বাচনি ব্যবস্থা।

গণতন্ত্রের সংকটটা টের পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও। তিনি বলেছেন, ভোটের রাজনীতির প্রতি মানুষের অনীহা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বেশি হওয়া উচিত।’ তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের এতো জনসমর্থন, সেখানে আরও বেশি ভোট আশা করেছিলাম। আওয়ামী লীগের যে ভোটের হার, সে তুলনায় উপস্থিতি আশানুরূপ নয়।’ শেখ হাসিনাই সব করে দেবেন, নেতাকর্মীদের এই মনোভাব সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী। এই মনোভাব অতি দ্রুত বদলাতে না পারলে এই জয়, অনেক বড় বিপর্যয়ের পথ প্রশস্ত করতে পারে। সুখের কথা হলো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেটি বুঝেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য সংগঠন শক্তিশালী করা দরকার।’ এই দরকারটা যত তাড়াতাড়ি কার্যকর হবে, ততই মঙ্গল।

কিছু কিছু জয় আছে, যা সেলিব্রেট করতেও লজ্জা হয়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিজিত পক্ষে তো নয়ই, জয়ী পক্ষেও কোনও উচ্ছ্বাস নেই। আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর জয়ের ব্যাপারে কারও সংশয় ছিল না। কিন্তু নিশ্চিত জয়ের পথেই নির্বাচন কমিশনের নানা বিচ্যুতি, লাগাতার আচরণবিধি লঙ্ঘন, নির্বাচনের দিনে নানা অনিয়ম, মারপিট—পুরো জয়কেই উচ্ছ্বাসহীন করেছে। আর পরাজিত মহলে তো উচ্ছ্বাস থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই নির্বাচন থেকে বিএনপির প্রাপ্তি কম নয়। তাদের মূল প্রাপ্তিটা অবশ্য নির্বাচনের আগেই হয়ে গেছে। বিএনপিও জানতো, আওয়ামী লীগের সর্বগ্রাসী মনোভাবের সামনে তারা দাঁড়াতে পারবে না। তারপরও নির্বাচনের আগে টানা ২০ দিনের প্রচারণা এবং তার আগের সময়টা সাংগঠনিকভাবে তাদের অনেক আত্মবিশ্বাসী করেছে। অনেকদিন পর বিএনপির নেতাকর্মীরা বাধাহীনভাবে গ্রেফতার বা পুলিশি হয়রানির ভয় ছাড়াই রাস্তায় নামতে পেরেছে, থাকতে পেরেছে; এই প্রাপ্তি কম নয়। এ নির্বাচন বিএনপির অনেক অনৈক্য আড়াল করেছে। সাদেক হোসেন খোকা বেঁচে থাকতে ঢাকার রাজনীতিতে তার প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন মির্জা আব্বাস। কিন্তু এবার সাদেক হোসেন খোকার ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে মির্জা আব্বাস যেভাবে বিরামহীন প্রচারণা চালিয়েছেন, তা গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকেই তুলে ধরেছে। প্রচারণার সময় গণতন্ত্রের এমন আরও অনেক ফুল ফুটেছে। ফজলে নূর তাপস ভোট চাইতে গেছেন ইশরাকের বাসায়, ইশরাক রাজপথে ভোট চাইছেন আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছে, আতিকুল ইসলাম ভোট ও আশীর্বাদ চাইছেন মির্জা ফখরুলের কাছে—এসব রাজনৈতিক শিষ্টাচার হারিয়েই গিয়েছিল রাজনীতি থেকে। প্রচারণার সময় গণতন্ত্রের জয়ের যে ইঙ্গিত মিলেছিল, নির্বাচনের দিন তা হারিয়ে গেছে।

আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন বরাবরই সরকারি দলের জন্য শাঁখের করাত। হারলেও গালি শুনতে হয়, জিতলেও। বিরোধী দল বরং একটু সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। জিতলে তো কথাই নেই। হারলেও তাদের অনেক কিছু বলার থাকে। মির্জা ফখরুল নির্বাচনের অনেক আগেই বলে দিয়েছিলেন, এই সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা প্রমাণ করতেই আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি। নির্বাচনের দিন নির্বাচনের মাঠ থেকে বিএনপির হাওয়া হয়ে যাওয়াতেই মির্জা ফখরুলের সেই কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। পরাজয়ের পর বিএনপি সে কথাই বারবার বলছে। এখন মনে হচ্ছে, এই অভিযোগটুকু করার জন্যই বিএনপি নির্বাচনে এসেছিল। প্রচারের সময় তারা যতটা সিরিয়াস ছিল, নির্বাচনের দিন তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। অনেক কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের ভয় দেখিয়ে বের করে দেওয়ার অভিযোগ যেমন সত্যি, তেমনি অনেক কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্টরা যাননি, সেটাও তো মিথ্যা নয়। মাটি কামড়ে পড়ে থাকার যে মরিয়া চেষ্টা দরকার ছিল, তা বিএনপির মধ্যে দেখা যায়নি।

বিএনপি মাঠে না থাকলেও আওয়ামী লীগ নিজেরা নিজেরাই মারপিট করে, সাংবাদিক পিটিয়ে, গোপন কক্ষে ঢুকে অন্যের ভোট দিয়ে বিএনপির জন্য অভিযোগের ডালি সাজিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য সেই প্রাপ্তিটুকু বিএনপি একদিনও ধরে রাখতে পারেনি। ফল প্রত্যাখ্যান করে পরদিন হরতাল ডেকে বিএনপি নেতারা বাসায় ঘুমিয়েছেন। বিএনপির আবাসিক নেতা রুহুল কবির রিজভী ছাড়া বলার মতো আর কোনও নেতাকে রাজপথে দেখা যায়নি। পুলিশ রিজভীকে কর্মসূচি শেষ করার জন্য ৩০ মিনিট সময় দিলেও তিনি মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে রাজপথ খালি করে দিয়েছিলেন। দুই দিন পর বিএনপি থানায় থানায় বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছিল। কিন্তু সেটাও সব থানায় হয়নি। নামকাওয়াস্তে রুটিন কর্মসূচি পালন করেছে। হরতাল বা বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু সেটা তো পালন করতে হবে। কর্মসূচি ডেকে ঘরে বসে থাকার মানে কী? প্রচারের সময় বিএনপির দুই প্রার্থীর পেছনে যে হাজার হাজার মানুষ ছিল, তারা এখন কোথায়? হরতাল আর বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি আবারও তাদের দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করেছে।

দুই সিটির নির্বাচনে হেরেও যেমন অনেক প্রাপ্তি বিএনপির, তেমনি জিতেও অনেক গ্লানি আওয়ামী লীগের। তবে এই নির্বাচনে সবচেয়ে বড় পরাজয় হয়েছে গণতন্ত্রের, নির্বাচনি ব্যবস্থার। বিএনপি এমনিতেই রাজনীতিতে কোণঠাসা, এই দুই পরাজয় তাদের বিপর্যয়ে নতুন কোনও মাত্রা যুক্ত করবে না। দুই মেয়র পদে জিতেও আওয়ামী লীগেরও মহা কোনও অর্জন হবে না। তবে গণতন্ত্রের পরাজয়টা নিয়ে আমাদের সবাইকে আরও অনেক বেশি করে ভাবতে হবে। নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি সরকারি দলের। দায়িত্ব আছে সব রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও নির্বাচন কমিশনের।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

 

 

 

 

 

/এমএনএইচ/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
৭৮ দিন পর গ্রামের বাড়িতে তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া ৮ যুবকের মরদেহ
৭৮ দিন পর গ্রামের বাড়িতে তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া ৮ যুবকের মরদেহ
টিভিতে আজকের খেলা (৪ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৪ মে, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ