X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একদিকে ভাতা স্থগিত অন্যদিকে আমলাদের বিলাস

রুমিন ফারহানা
২০ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৩৭আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৩৭

ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়া একটা গল্প আজকাল প্রায়ই মনে পড়ে আমার। অবশ্য ‘পড়ে’ না বলে ‘পড়ায়’ বললেই বোধ হয় ঠিক হয়। সরকার তার উদ্ভট নানান কাজ দিয়ে মনে পড়িয়ে দেয় গল্পটি। এই যেমন করোনার ভয়াবহতা কাটতে না কাটতেই পদ্মা সেতু উদ্বোধন নিয়ে চারদিকে যখন হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল সরকার তখনও মনে পড়েছে গল্পটি; সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’। সবার জ্ঞাতার্থে গল্পটি আবার মনে করিয়ে দেই। দলবল নিয়ে স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন লাট সাহেব। সঙ্গে ছিল লাট সাহেবের তিন ‘ঠাঙওয়ালা’ একটি কুকুর। সেই কুকুরের জন্যে মাসে বরাদ্দ ৭৫ টাকা। লাট সাহেব চলে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের পণ্ডিত মশাই বলছিলেন, “অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুজি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?” গল্পটি কেন আবার মনে পড়লো সে কথায় আসছি পরে।           

ভবন হবে দুইটি। প্রতিটির আয়তন ধরা হয়েছে সাড়ে ১৮ হাজার বর্গফুট। আমি নিজে থাকি ১৮শ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে। অর্থাৎ আমার ফ্ল্যাটের ১০ গুণ বড় হবে এক একটি ভবন। পাঠক হয়তো ভাবতে পারেন আমার মতো গরিবের সাথে তুলনা কেন? তুলনা একারণেই যে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে এই দুই ভবনের ভবিষ্যৎ বাসিন্দা আর আমি একই কাতারে পড়ি। বিশাল এই রাজপ্রাসাদের একটিতে থাকবেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব, অন্যটিতে প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী এই দুই সচিব, তিন বাহিনীর প্রধান আর সংসদ সদস্যদের অবস্থান ১২ তে। তাছাড়া আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত একটি পরিবার সাধারণত ১১০০ থেকে ১২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে থাকে। অর্থাৎ ১৮ হাজার বর্গফুটের এই ভবন দুটিতে মোট ৩০টি পরিবার থাকতে পারবে।   প্রতিটি ভবন নির্মাণে সব মিলিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ‘মাত্র’ সাড়ে ২১ কোটি টাকা।   

আমলাদের শিরোমণি বলে কথা। প্রতিটি বাসভবনে সুইমিং পুল হবে দুই সেট। এই বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। কতজন মানুষের চিন্তা মাথায় রেখে দুই সেট সুইমিং পুল করার চিন্তা করা হচ্ছে সে এক গবেষণার বিষয় বটে। কারণ যত হাজার বর্গফুটের ভবনই হোক না কেন, থাকবেন মাত্র একটি পরিবার। তবে সেই পরিবারের খেদমতে কতজন থাকবেন সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। হতে পারে একটি পুল হবে কেবলই খেদমতগারদের জন্য।  

দুটি ভবনেই অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জাতে খরচ হবে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। কী দিয়ে সাজানো হবে কে জানে! দুটি ভবনে আসবাবের পেছনে খরচ হবে দেড় কোটি টাকা, সোনা রুপার পানি দিয়ে ধোয়া আসবাব হবে সন্দেহ নেই। ২টি ভবনের জন্য ৭টি করে মোট ১৪টি এলইডি টেলিভিশন কেনা হবে। এতে ব্যয় হবে ৯ লাখ টাকা। এত টিভির দর্শক কারা হবেন সেও এক প্রশ্ন বটে। সিসিটিভি সিস্টেম কেনা হবে ৩২টি। তাতে খরচ হবে ৬০ লাখ টাকা। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার জন্য পৌনে দুই কোটি টাকা খরচ হবে। এক হাজার কেজি লিফটে (ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড) খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থায় খরচ হবে ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এছাড়া বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ খাতে খরচ হবে ১৮ লাখ টাকা। শ্রাদ্ধ আর কাকে বলে!  এত গেলো রাজা রাজড়াদের কথা, তাদের হিসাব আলাদা। এবার দেখি সাধারণ মানুষ কেমন আছে?

এক স্বনামধন্য জাতীয় দৈনিকের খবর বলছে মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিগত ছয় মাসে তাদের ওপর বড় আঘাত কী। জবাবে ৮৮ শতাংশ মানুষ খাদ্যের চড়া দামকে বড় আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আরও তিনটি বিষয় বড় আঘাত হিসেবে উঠে এসেছে—রোগ ও চিকিৎসা ব্যয়, তেলের দাম ও পরিবহন ব্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬৮ শতাংশ।

জরিপে আগস্ট মাসের পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়, ওই মাসে পরিবারের খাদ্য কেনার জন্য ৬৪ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়েছেন। ২৯ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙেছে। আবার খাবার কিনতে গিয়ে ১০ শতাংশ পরিবার তাদের গত ১২ মাসের সব সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে মাছ, মাংস, সামুদ্রিক খাবারসহ পুষ্টিকর উপাদানসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে মাত্র ১৭ শতাংশ পরিবার।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমরা সিঙ্গাপুর হবো, না ইউরোপ হবো, তা নিয়ে জোর তর্ক-বিতর্ক ছিল সরকারি মহলে। এমনকি করোনা সারা বিশ্বকে এক রকম স্থবির করে দিলেও দমাতে পারেনি সরকারের উঁচু গলাকে। সর্বনাশ হলো পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরপর। এলাকা ভেদে লোডশেডিংয়ের সময় বাড়ছে। এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দামের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরিবহন ব্যয়, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। টিসিবির লাইনে মুখ লুকিয়ে দাঁড়াচ্ছেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তরাও।

মজার বিষয় হলো যেদিন পত্রিকায় ৪৩ কোটি টাকার প্রাসাদের খবর এসেছে সেদিনই আরেকটি খবরে চোখ আটকে গেছে মানুষের। ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২২’ পালন উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আবারও অনুরোধ করছি, কোনও খাদ্যের অপচয় নয়, যার যেখানে যতটুকু জমি আছে, তা চাষের আওতায় এনে খাদ্য উৎপাদন বাড়ান। সারা বিশ্বে যে দুর্যোগের আভাস আমরা পাচ্ছি, তা থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত করুন। আমি বিশ্বাস করি, সকলের প্রচেষ্টায় এটা করা সম্ভব।’ চোখ-কান খোলা রাখা মানুষ নিশ্চয়ই বুঝেছেন, বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী কেন ‘আবারও’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বৈশ্বিক খাদ্য সংকট নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে নিয়মিত সতর্কতা দিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর জায়গা থেকে এমন একটি সতর্কবার্তা বারবার আসা প্রমাণ করে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছুদিন যাবত ক্রমাগত মানুষকে সতর্ক করছেন এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখার জন্য। অপচয়ের বিষয়ে সাবধান করতে গিয়ে তাগিদ দিয়েছেন বেঁচে যাওয়া খাবার সংরক্ষণ করে পুনঃব্যবহারের বিষয়ে।

সরকার আসলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তাদের ক্ষমতায় আসা এবং থাকার পেছনে আমলাদের ভূমিকা বিরাট। সেকারণেই সকল প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করলেও আমলাদের বিদেশ সফর, কিংবা তাদের প্রাসাদ নির্মাণ প্রকল্প সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় ওপরের দিকেই থাকে সব সময়।

প্রাসাদ কেমন হবে ভাবতে ভাবতে চোখ আটকে গেলো আর একটি খবরে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সমাজসেবা অধিদফতর পরিচালিত সবচেয়ে বড় কার্যক্রম হচ্ছে ‘বয়স্ক ভাতা’ এবং ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত মহিলা ভাতা’ সংক্ষেপে যা ‘বিধবা ভাতা’ নামে পরিচিত। খবর এসেছে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এ অর্থবছরে (২০২২-২৩) এ দু’টি ভাতার জন্য নতুন করে কাউকে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে পত্রিকাটি জানায় অর্থ বরাদ্দ নেই। অধিদফতরের জিটুপি (গভর্নমেন্ট টু পারসন) পদ্ধতিতে অর্থাৎ মুঠোফোনের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠানোর মোট আট ধরনের ভাতা কার্যক্রমের মধ্যে ‘প্রতিবন্ধী ভাতা’ ছাড়া বাকিগুলোর নতুন করে তালিকাভুক্তি স্থগিত আছে। সরকারের ভাষায় বৈশ্বিক খাদ্য সংকট যখন কড়া নাড়ছে দরজায় তখন এই ‘প্রাসাদ তৈরি’ কিংবা ‘ভাতা তালিকাভুক্তি স্থগিত’ আর যাকেই অবাক করুক আমার কাছে এটি স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। এ সরকার ভালো করেই জানে ক্ষমতায় থাকতে তার কাকে প্রয়োজন।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য বিএনপি দলীয় হুইপ।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ