X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

'আপনিও কি দেশ ছেড়ে চলে এলেন?'

গোলাম মোর্তোজা
০৪ মে ২০১৬, ১৩:০৯আপডেট : ০৪ মে ২০১৬, ১৪:৩৮

গোলাম মোর্তোজা একটির নিচে আরেকটি চাপা পড়ার নীতি বিরতিহীনভাবে চলছে। চিন্তা করছি একটি বিষয় নিয়ে লিখবো, মুহূর্তেই নতুন ঘটনা সামনে চলে আসছে। নিজেও স্থির না থাকায় গত প্রায় মাসখানেক কিছু লিখিনি। কারণ দেশের বাইরে ছিলাম। দেশের বাইরে থাকলেও দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা যায় না। পৃথিবীর সব প্রান্তেই বাংলাদেশের মানুষ অবস্থান করছেন। আমরা সবাই জানি, বিদেশে যারা থাকেন তারা দেশ নিয়ে অনেক বেশি ভাবেন। যে, যে দেশে থাকেন, নিজ দেশও তেমন হবে- প্রত্যাশা করেন। প্রত্যাশা আর বাস্তবতার ব্যবধান যোজন-যোজন। দেশ তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী চলে না। দেশ নিয়ে তারা হতাশ হয়ে পড়েন। যদিও তারা প্রায় কেউই মোটেই হতাশ বা নিরাশাবাদী মানুষ নন। যার যার ক্ষেত্রে প্রায় সবাই সফল এবং আশাবাদী মানুষ। বিদেশের কঠিন পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছেন, সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। অনেকের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংগ্রাম এখনও চলছে।
বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে আমেরিকা। আমেরিকার নিউইয়র্কে বাংলাদেশের এত মানুষের বসবাস যে, দূরে মনে হয় না। জ্যাকসন হাইটস তো এক টুকরো বাংলাদেশ, কমবেশি অনেকেই তা জানি। প্রবাসের বাংলাদেশিরা দেশ নিয়ে কী ভাবছেন, এবং সেখানে যেসব প্রশ্নের মুখামুখি হয়েছি, সে বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা।
১. ‘আপনিও কি দেশ থেকে চলে এলেন?’- সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হয়েছি! যেখানেই গিয়েছি বাঙালিদের সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং তাদের প্রথম প্রশ্ন এটাই। এরপরের প্রশ্ন- ‘আপনারা কি সব কথা বলতে পারছেন?’ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে নিজেরাই বলছেন, ‘বুঝতে পারছি, পারছেন না।’ আবার অনেকে বলেছেন, ‘দেশে তো অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। আপনারা খারাপ দিকগুলোই তুলে আনেন, সমালোচনা করেন। ভালো দিকগুলো দেখেন না, বলেন না, লেখেন না।’
এমন মন্তব্যের মানুষের সংখ্যা কম। আগের বক্তব্যের মানুষের সংখ্যা বেশি।
নিউইয়র্কের মতো একই প্রসঙ্গের মুখোমুখি হয়েছি জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াতেও। দেশের বাইরে যারা অবস্থান করছেন তারা এভাবেই ভাবছেন দেশ নিয়ে।
২. নিউইয়র্কে বাঙালিদের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগটি করে দিয়েছিল ‘সাপ্তাহিক আজকাল’। ‘আজকাল’ নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। পত্রিকাটি অষ্টম বছরে পদার্পণ করলো। বাংলাদেশ থেকে আমিই ছিলাম একমাত্র আমন্ত্রিত অতিথি। অন্য একটি অনুষ্ঠানে জাপানে অবস্থান করছিলাম। 'আজকাল'র  প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্যে টোকিও থেকে বিশ ঘণ্টা উড়ে গিয়েছিলাম নিউইয়র্কে। ‘সাপ্তাহিক আজকাল’-এর প্রধান সম্পাদক জাকারিয়া মাসুদ জিকো। তিনি উত্তর আমেরিকার পরিচিত মুখ। নিউইয়র্কের বিশাল বাংলাদেশি ব্যবসায়ী কমিউনিটি জ্যাকসন হাইটস বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সভাপতি। পত্রিকাটির সম্পাদক প্রবীণ, অভিজ্ঞ সাংবাদিক মনজুর আহমদ। সহযোগী সম্পাদক হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশের টেলিভিশনের পরিচিত মুখ সাংবাদিক হাসানুজ্জামান সাকি। দীর্ঘ বছর ধরে নিউইয়র্ক থেকে বারো চৌদ্দটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ‘আজকাল’ একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। অষ্টমবর্ষে পদার্পণ এবং এ উপলক্ষে আয়োজিত মার্জিত-রুচিশীল বিশাল আয়োজন তার বড় প্রমাণ বহন করছে। দেশের বাইরে একটি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন এত বড়, এত গোছানো হতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন । অনুষ্ঠানটি ছিল এক কথায় অভূতপূর্ব। এই অনুষ্ঠানেও এসব প্রসঙ্গ এসেছিল। কিছু কথা বলেছিলাম।

আরও পড়তে পারেন: যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চাইলেন বাংলাদেশি ব্লগার রবি

৩. ‘দেশ থেকে একবারে চলে এলেন কিনা’- এই যে মানুষের মনে হওয়া, এর তাৎপর্য কী? তাৎপর্য এই যে, দেশ থেকে অনেকে আমেরিকা-ইউরোপে চলে যাচ্ছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সেই হার বেড়েছে। সত্যি সত্যি দেশে জীবন নিরাপদ নয়, সে কারণে অনেকে গেছেন। অনেক আবার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে গেছেন। বাস্তবতা হলো, সংবাদকর্মী বা লেখক-প্রকাশকদের জীবন এখন বাংলাদেশে নিরাপদ নয়। এ কথা দেশের বাইরে যারা থাকছেন, তারা খুব ভালোমতো বুঝতে পারছেন। নিজে এখন আর নিজের পেশাগত হুমকি বা সমস্যার কথা বলি না। জিডি করা বাদ দিয়েছি বহু বছর আগে থেকে। দেখেছি এতে সমস্যা বাড়ে, কমে না। কিন্তু প্রবাসে দেশ থেকে এত দূরে অবস্থান করা মানুষগুলোও বুঝতে পারছেন দেশে আমাদের জীবন নিরাপদ নয়। তাই তারা আশঙ্কা করছেন, একেবারেই হয়ত চলে এসেছি।

‘বাংলাদেশের অবস্থা আমেরিকার চেয়েও ভালো’- এসব কথা মানুষের হাসির খোরাক জোগায়, বিশ্বাসে স্থান পায় না।

৪. আর একটি প্রসঙ্গ- ‘সব কথা বলা যায় কিনা, সব কিছু বলতে পারছি কিনা?’ এই প্রশ্নের উত্তর কী? যে সমাজে এই প্রশ্নের উত্তর স্পষ্টভাবে দেওয়া যায়, সেই সমাজে এমন প্রশ্নই আসে না। আমার ধারণা প্রশ্নের উত্তর এটাই। এ কথাও সত্যি টেলিভিশনে কথা বলছি, পত্রিকায় লিখছি। সরকারের নানা কাজের সমালোচনা করছি। তার চেয়েও বড় সত্যি, সবচেয়ে প্রভাবশালী সম্পাদকের নামেও ৮০টি মামলা হচ্ছে। আইন সংশোধন করে প্রেস কাউন্সিলকে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভীতিকর। কে কখন কোন পরিস্থিতির শিকার হয়, অনুমান করাও কঠিন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করা গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এসব প্রশংসনীয় বিচারের পরেও বিচারহীনতার সংস্কৃতি স্থায়ী রূপ নিয়েছে। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

৫. ‘ভালোটা দেখি না, খারাপটার সমালোচনা করি।’ ‘আজকাল’-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও বলেছিলাম, আবারও বলছি। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে সরকারগুলো হয় দায়িত্বহীন এবং দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারি-দাম্ভিকতাপূর্ণ। এখন তো নয়ই, বিরোধী দল কখনোই তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে না। সরকারকে চাপে রেখে সঠিক পথে রাখার দায়িত্ব বিরোধী দল পালন করে না বা করতে পারে না। এই দায়িত্বটি পালন করতে হয় গণমাধ্যমকে।

আরও পড়তে পারেন: নিখিল হত্যাকাণ্ডের রহস্য কোথায়?

গণমাধ্যমের দায়িত্ব সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া। সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য জনমানুষকে জানানো। অন্যায় অনিয়ম আড়াল করে, প্রশংসা করা নয় । সুনির্দিষ্ট করে বলি, দোহাজারি -কক্সবাজার -গুনধুম রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। উদ্যোগটি প্রশংসার। কাজটি হবে জনগণের অর্থে। বাস্তবায়ন করবে সরকার। এখানে এক কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ভারতে এক কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয় মাত্র ১২ থেকে ১৭ কোটি টাকা। চীনে ২০০ কিলোমিটার গতিতে চলা হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয় ৭৩ থেকে ৭৫ কোটি টাকা। হাইস্পিড রেলপথের চেয়েও নির্মাণ ব্যয় বেশি! এত বেশি!!

যেখানে ভারতে সর্বোচ্চ ১৭ কোটি টাকা, সেখানে বাংলাদেশে প্রায় ১০২ কোটি টাকা!!

এখানেই শেষ নয়। ঢাকা- মাওয়া- যশোর রেলপথ নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৫ কোটি টাকা। আশ্চর্য হচ্ছেন, অবিশ্বাস করছেন? ভুল লিখছি কিনা ভাবছেন? না, এসবের কোনোটাই নয়, সঠিক জানছেন।

কেন এই ব্যয়? আপনি যদি 'উন্নয়ন'র প্রশংসার কথা বলেন,আপনার মনে কি এই প্রশ্ন আসে না ?

এর কোনও ব্যাখ্যা আছে কারও কাছে? এর নাম 'উন্নয়ন'? গণমাধ্যমের দায়িত্ব কি এই 'উন্নয়ন 'র প্রশংসা করা, না সঠিক তথ্য জনমানুষকে জানানো? অবশ্যই জানানো। আমরা সেই কাজটিই করার চেষ্টা করছি।
আরও একটি উদাহরণ দেই।

ইউরোপে এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় হয় ২৮ কোটি, ভারতে ১০ কোটি, চীনে ১৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশে কত জানেন? প্রায় ১১৪ কোটি টাকা! হ্যাঁ, প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ ব্যয়ের কথা বলছি! 

ঢাকা -মাওয়া -ভাঙা সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এরকম উদাহরণ আরও বহু দেওয়া যায়। এই 'উন্নয়ন 'র গুণকীর্তন করা কি একজন সংবাদ কর্মী বা গণমাধ্যমের দায়িত্ব? 

একটি ফ্লাইওভার বা সেতু নির্মাণের প্রশংসা করা গণমাধ্যমের দায়িত্ব নয়। গণমাধ্যমের দায়িত্ব ৩৫০ কোটি টাকার ফ্লাইওভার কেন ১২৫০ কোটি টাকা ব্যয় হবে সেটা বলা। ২০ হাজার কোটি টাকার সেতুতে কেন ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে, সেই তথ্য প্রকাশ করা।

সরকারের অঙ্গীকার ছিল, রাস্তা-সেতু-ফ্লাইওভার নির্মাণ করার। সঠিক অর্থ ব্যয়ে নির্মাণ করার কথা ছিল, বিপুল পরিমাণ অর্থ বেশি ব্যয়ে নয়। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের নামই দুর্নীতি, এরই নাম লুটপাট। বিদ্যুৎ খাতসহ প্রায় সর্বত্র একই রকম চিত্র বিদ্যমান। এই চিত্র প্রকাশ করাই গণমাধ্যমের দায়িত্ব।

আরও পড়তে পারেন: সন্দেহভাজন ৫ জনকে ধরেনি, যাদের ধরেছে তারা জড়িত নয়: বন্যা (ভিডিও)

স্বচ্ছভাবে, দুর্নীতিমুক্তভাবে, পরিকল্পিতভাবে, একটির সঙ্গে আরেকটি সাংঘর্ষিক, যেমন ফ্লাইওভারের সঙ্গে মেট্রোরেলের পরিকল্পনা সাংঘর্ষিক না করে যদি নির্মাণ করা হতো, সরকার অবশ্যই প্রশংসা পেত। এমনটা হচ্ছে না বলেই, সমালোচনা হচ্ছে এবং এই সমালোচনা করাটাই গণমাধ্যমের দায়িত্ব। বৃহৎ পরিকল্পনা ছাড়া একটি ফ্লাইওভার কোনও উন্নয়ন নয়, উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশে বর্তমানে উন্নয়নের নামে উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। বিশ পঁচিশ বছর পরে গিয়ে যা প্রকোটভাবে সামনে আসবে।

৬. দেশের সাধারণ জনমানুষ, প্রবাসের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী জনমানুষের ভাবনার প্রতি সরকারের কোনও আস্থা বা শ্রদ্ধা নেই। যদিও তা থাকা প্রত্যাশিত ছিল। ভোটের অধিকার থাকলে মানুষ তার জবাব দিতে পারতেন। জনমানুষ জবাব দিতে না পেরে, হতাশ এবং বিক্ষুব্ধ হচ্ছেন। কান পাতলেই সেই আওয়াজ শোনা যায়। ক্ষমতার কান তা শোনে না, শোনে শুধু তোষামোদকারীদের কথা।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আরও ২-৩ দিন পর্যবেক্ষণে থাকবে সুন্দরবনের আগুন লাগা এলাকা
আরও ২-৩ দিন পর্যবেক্ষণে থাকবে সুন্দরবনের আগুন লাগা এলাকা
রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা চালাতে ওআইসির সহযোগিতা চাইলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা চালাতে ওআইসির সহযোগিতা চাইলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
লাপাতা লেডিস: বিস্ময় জাগানো কে এই তরুণ
লাপাতা লেডিস: বিস্ময় জাগানো কে এই তরুণ
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রেখে পুরস্কার পেলো সানশাইন ব্রিকস
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রেখে পুরস্কার পেলো সানশাইন ব্রিকস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ