X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাগ-বিরাগের রায় নিয়ে বিতর্ক

আনিস আলমগীর
২২ আগস্ট ২০১৭, ১২:৪৩আপডেট : ২২ আগস্ট ২০১৭, ১৮:১৮

আনিস আলমগীর ঘটনাটি আগেও বলেছিলাম। একবার কলকাতা হাইকোর্টের একক বেঞ্চের এক বিচারপতিকে এক লোক জুতা মেরেছিলো। কোর্ট লোকটাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়নি। প্রধান বিচারপতি অন্যান্য বিচারপতি নিয়ে লোকটা কেন জুতা মেরেছে তার বক্তব্য শুনেছিলেন।
বক্তব্যে লোকটা বলেছিলেন- বিচারপতি গত ছয় বছরব্যাপী মামলার কোনও শুনানি করেননি, তারিখের পর তারিখ দিয়েছেন। আজকেও তিনি পরবর্তী তারিখ দিয়েছেন। মামলায় গত ছয় বছরে অর্থবিত্ত সব হারিয়েছি। আগামী তারিখে হাজির হওয়ার মতো আমার কাছে কোনও অর্থবিত্ত নেই। তাই বিচারপতিকে জুতা মেরেছি। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সব বিচারপতির বৈঠকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছিলো এবং তার মামলার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়েছিল। বিচারপতিকেও মাঝে মাঝে অপমান হজম করতে হয় যদি বিচারপতির অপরাধ থাকে।
১৬ তম সংশোধনীর রায়ে হাইকোর্টের কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের ওপর রায় সীমাবদ্ধ না রেখে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে বিচারপতিরা কথাবার্তা বলে ফেলেছেন বেশি। এমনভাবে কথাবার্তা বলেছেন যে মনে হয় এ প্রজাতন্ত্রটা অকার্যকর হয়ে গেছে। যে যে পদেই থাকুক পদে বসে কারও সীমা লঙ্ঘন করা উচিত নয়। পদে বসে সীমা লঙ্ঘন করলেই প্রজাতন্ত্র অকার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সম্ভবতো সে কাজটি করেছেন খুবই সুন্দরভাবে এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই। রায়ের সূত্রধরেই বিএনপি দাবি তুলেছেন পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে। কারণ রায়ে প্রচ্ছন্নভাবে সে উস্কানি রয়েছে। প্রজাতন্ত্র হচ্ছে খুবই জরুরি সংগঠন। অপরিহার্য। এজন্যই প্রজাতন্ত্রের বা রাষ্ট্রের কেউ ক্ষতি করতে চাইলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়।

আমাদের সুশীল সমাজের দাবি নির্বাচন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হতে হবে। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে। পার্লামেন্টের আচরণ মাদার পার্লামেন্টের মতো হতে হবে। তারা বুঝে না যে বাংলাদেশ মাদার পার্লামেন্টের দেশ ইংল্যান্ড নয়। এদেশে সুশীল সমাজ মাদার পার্লামেন্টের দেশ ইংল্যান্ডের সুশীল সমাজ নয়, এদেশের বিচারপতিরা মাদার পার্লামেন্টের দেশ ইংল্যান্ডের বিচারপতিও নন।

যে দেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাশীন থাকলে বিরোধী দল বিএনপি বছরের পর বছর পার্লামেন্ট অধিবেশনে যোগদান করে না সে দেশে উত্তম পার্লামেন্টের উদ্ভব হবে কিভাবে! মাদার পার্লামেন্ট এর দেশ ইংল্যান্ডে বিচারপতিরা কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে পর্যন্ত যোগদান করেন না অথচ বাংলাদেশে নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির পরিবার প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন। গরুকে বাঘের চামড়া মুড়িয়ে দিলে গরুতো বাঘ হবে না। একটা জাতির চরিত্র থেকে ভুলত্রুটি দূর করতে হলে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নিরবিচ্ছিন্ন প্রয়াসের প্রয়োজন। কেউতো তা করেন না। সীমা অতিক্রম করাই এখানে নিয়ম।

আগামী বছর আমাদের দেশে সাধারণ নির্বাচন সবাই মুখিয়ে আছেন আমেরিকা কোন দলকে সমর্থন করে, ভারত কোন দলকে আশির্বাদ করে, চীন কার পক্ষে দেখার জন্য। এ যদি অবস্থা হয়, নিরপেক্ষ নিরপেক্ষ বলে আওয়াজ তুলে লাভ কি! আমি এক সুশীলকে জিজ্ঞেস করেছি, নির্বাচনের অবস্থা কী বুঝেন? তিনি উত্তর দিলেন ভারতের ভূমিকা কী হবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। সুতরাং এই প্রশ্নের উত্তর এখন দেওয়া ঠিক হবে না।

এরশাদকে দিল্লির দরবার ডেকে ছিলেন। তিনি দেখা করে এসেছেন। এয়ারপোর্টের অনুষ্ঠানে এরশাদ সাহেব বলেছেন ভারতীয় বন্ধুরা চাচ্ছেন আমি ক্ষমতায় যাই। পত্রিকায় দেখেছি বেগম জিয়া লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লি হয়ে আসবেন। বিএনপির নেতা কর্মীরা বলছেন দিল্লির একটু গ্রিন সিগনাল পেলেই হবে। ভাগ্য ভালো প্রধান বিচারপতি এসব দেখেও কোনও মন্তব্য করেননি।

প্রধান বিচারপতির যদি এতো কথা বলতে হয় তাহলে বরং রায়ে দেশের সার্বভৌমত্ব সংকটজনক অবস্থায় এ মন্তব্য করাটা প্রাসঙ্গিক ছিল। কারণ প্রধান বিচারপতি সব বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি রায়ে বলেছেন সংসদ সদস্যরা ইম্মেচিউর, সংসদ অকার্যকর। আবার বলেছেন ১৫২ জন সংসদ সঠিকভাবে নির্বাচিত হয়ে আসেননি। সংসদ সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মানে না। গণতন্ত্রকে তিনি তার পর্যবেক্ষণে ‘মেকি’ বলেছেন। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কেও তিনি তীর্যক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, বিচার ব্যবস্থাও নাকি ডুবু ডুবু। অর্থাৎ তিনি প্রজাতন্ত্রটাকে একটা ব্যর্থ প্রজাতন্ত্র হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন।

বিচারপতির কলম স্বাধীন সার্বভৌম এ কথা সত্য। কিন্তু তিনি তার সে কলম দিয়ে প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিমূলে আঘাত করতে পারেন না। তিনি প্রজতেন্ত্রর প্রতি এতো বিরাগ হলেন কেন? তিনি তো রাগ-বিরাগের বশীভূত হয়ে কোনও রায় দিতে পারেন না। রাগ-বিরাগের বশীভূত হলে তিনি তো শপথচ্যুত হয়ে যান। আর শপথচ্যুত হয়ে গেলে তিনি তো প্রধান বিচারপতি পদে থাকতে পারেন না। এই প্রসঙ্গটি সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সাহেব যথাযথভাবে উত্থাপন করেছেন।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে তার সাবেক সহকর্মী বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক অভিযোগ তুলেছেন, ‘সিনহা সাহেব ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং তিনি শান্তি কমিটির মেম্বারও ছিলেন’। যেখানে দালাল আইনে তার বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল সেখানে তিনি বিচারপতি হলেন কিভাবে আবার আওয়ামী লীগ সরকার তাকে প্রধান বিচারপতি বানালেন কিভাবে? এমন লোক প্রধান বিচারপতি হলে প্রজাতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘোষণা করাই তো স্বাভাবিক। কারণ প্রজাতন্ত্রের প্রতি সিনহা সাহেবের আনুগত্য তো প্রশ্নাতীত নয়। অনেকে বলেছেন এটা নাকি পেনড্রাইভ জাজমেন্ট। কোনও ইংরেজি এবং বাংলা পত্রিকার সম্পাদকদ্বয় নাকি রায় লিখে দিয়েছেন। প্রচারিত কথা যদি সত্য হয় তাহলে বিষয়টিতো এক ব্যাপক ষড়যন্ত্র। এটা আরেক গুরুতর অপরাধ। এটা তো আদালতের সর্বনাশ ডেকে আনছে।

এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গত রবিবার বিচারিক আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে আপিল শুনানির সময় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক একটি রায়ের কথা স্মরণ করিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণা করলেও সেখানে কোনও আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। আমাদের আরও পরিপক্কতা দরকার’।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের প্রধানমন্ত্রীত্ব চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো তিনি জাতীয় সংসদের সদস্যপদ হারিয়েছেন। জাতীয় সংসদের সদস্যপদ হারাবার কারণ ছিল পানামা পেপারস-এ তার সম্পদের যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে গত নির্বাচনে মনোনয়নপত্রে সঙ্গে দেওয়া নওয়াজের সম্পদের তালিকায় তার উল্লেখ নেই। সুতরাং পাকিস্তন সুপ্রিম কোর্ট শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই কাজ করেছেন। ফৌজদারি কর্মকাণ্ডের কোনও বিচার করেননি এবং সেটি দেখার জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি একাউন্টিবিলিটি কোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

সিনহা সাহেবের রায়ের সঙ্গে এই রায়ের কোনও তুলনাই চলে না। সিনহা সাহেব ১৬ তম সংশোধনীর হাইকোর্টের আকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের ওপর রায় দিতে গিয়ে এতো অনাকাঙ্ক্ষিত কথা বলেছেন যে, তাতে প্রজাতন্ত্রই অকার্যকর হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে আমরা প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করবো অপ্রাসঙ্গিক কথা রায় থেকে বের করে যেন চলমান বিতর্কের অবসান ঘটান।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ