X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ওলামা লীগ: আওয়ামী লীগের অসহযোগী সংগঠন

প্রভাষ আমিন
১৬ এপ্রিল ২০১৬, ১৬:০৪আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০১৬, ১৬:০৭

প্রভাষ আমিন সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা, তদ্বির-ধান্ধাবাজির জন্য সরকার সমর্থক নানা ভুইফোঁড় সংগঠন গড়ে ওঠে। এটা আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। তবে আওয়ামী  লীগ টানা সাত বছর ক্ষমতায় থাকায় ভুইফোঁড় সংগঠনে সয়লাব দেশ। সংগঠনের নামের শেষে ‘লীগ’ বা নামের শুরুতে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গমাতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ইত্যাদি শব্দ বসিয়ে হরেকরকম সংগঠন বানানো হচ্ছে। এমনকি ‘শিশু লীগ’ নামেও একটি সংগঠনের অস্তিত্ব আছে। এগুলোর মূল কাজ চাঁদাবাজি, তদ্বিরবাজি, ধান্ধাবাজি। এরা প্রেসক্লাব বা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সরকারের পক্ষে নানা ইস্যুতে আলোচনা সভা, মানববন্ধন করে। এছাড়া লীগসর্বস্ব এসব সংগঠনের নেতারা সারাদেশ দাপটে বেড়ায়। এদের নানা কর্মকাণ্ডে মূল আওয়ামী লীগ এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় দারুণভাবে। রাজনৈতিক মহলে এসব সংগঠনকে বলে ‘দোকান’, আর এদের নেতাদের বলে ‘দোকানদার’। এরা নানা আয়োজনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের আমন্ত্রণ জানান। তারা থাকলে টিভি ক্যামেরাও আসে। বড় নেতাদের পাশে বসে টিভিতে চেহারা দেখানোর সুবাদে এরা সরকারি দলের নেতার পরিচিতি পায়। যে পরিচিতি কাজে লাগিয়ে চলে দেদারসে ধান্ধাবাজি।
এরা মূলত হাইব্রিড আওয়ামী লীগার, মধুলোভী। ক্ষমতা না থাকলে রাতারাতি হারিয়ে যাবে রাতারাতি ব্যঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা এসব সংগঠন। তার আগে সরকারের উচিত এখনই এদের নিয়ন্ত্রণ করা। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক ক্ষতি হয়েছে। আরও ক্ষতি হওয়ার আগেই ভুইফোঁড় এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে আনা, নিয়ন্ত্রণে আনা, আওয়ামী লীগের কোনও নেতা যাতে এসব অনুষ্ঠানে না যান; তা নিশ্চিত করতে হবে।তবে আমি আজ  এসব ভুইফোঁড় সংগঠনের অপকর্মের ফিরিস্তি দিতে বসিনি। এইসব সংগঠন মিলে আওয়ামী লীগের যতটা ক্ষতি করছে, তারচেয়ে অনেক বেশি করছে এক আওয়ামী ওলামা লীগ। এই সংগঠনটি মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলে বাস্তবে আওয়ামী লীগের নীতি আদর্শের উল্টো কাজ করছে। আওয়ামী লীগের সাতটি সহযোগী ও ৩টি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন আছে। সহযোগী সংগঠনগুলো হলো: যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, তাঁতী লীগ ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। আর ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো হলো: ছাত্রলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ। নামে যতই ‘লীগ’ থাকুক, এর বাইরে অন্য কোনও সংগঠনের সাথে আওয়ামী লীগের কোনও আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। কিন্তু আওয়ামী ওলামা লীগ ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউকে নিজেদের ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে মজার কথা হলো, আওয়ামী ওলামা লীগ নামে দুটি, কখনও কখনও তিনটি কমিটি তৎপরতা চালাচ্ছে। সবগুলো কমিটির পেছনে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগকে যখন ইসলাম বিরোধী শক্তি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে আজানের বদলে উলুধ্বনি শোনা যাবে, এমন অপপ্রচার হয়েছে; তখন নিজেদের ইসলামের পক্ষের শক্তি হিসেবে প্রমাণের জন্য, ওলামাদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেমন ইসলাম বিরোধী দল নয়, তেমনি ইসলামী দলও নয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৫৫ সালেই তারা নিজেদের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি ফেলে আওয়ামী লীগ হিসেবে নবযাত্রা শুরু করে। তারপর আওয়ামী লীগের দারুণ বিবর্তন হয়েছে। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের মূল চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখায় মানুষকে। সেই স্বপ্নে এককাট্টা হয় মানুষ। একাত্তরে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার মূল চেতনা ছিল উদার, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।

পঁচাত্তরের পর সকল ইসলামী শক্তি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগ নিজেদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা অক্ষুণ্ন রাখে। যদিও ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ নিজেদের মূল চেতনা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে, তারপর এখনও বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ ধারার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের কাঁধেই। বিভিন্ন সময়ে গোপনে ধর্মীয় শক্তির সাথে আঁতাত করলেও প্রথম চুক্তিটি করেন প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। ক্ষমতায় যেতে ব্যাকুল আওয়ামী লীগ চুক্তি করে ইসলামী ঐক্যজোটের সাথেও। সে নিয়ে অনেক সমালোচনা হলে আওয়ামী লীগ আবার কৌশলী হয়ে যায়। ইসলামকে হেফাজতের নামে যে সংগঠন দুই দফায় ঢাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে, সেই হেফাজতে ইসলাম এখন আওয়ামী লীগের পকেটে। তবে প্রকাশ্যে কখনও তা স্বীকার করেনি দলটি। গোপনে গোপনে যাই করুক, প্রকাশ্যে এখনও আওয়ামী লীগ তার ধর্মনিরপেক্ষ ইমেজটি ধরে রাখার চেষ্টা করছে। সেই ইমেজে নিয়মিত কালিমা লেপন করে যাচ্ছে আওয়ামী ওলামা লীগ। নিজেদের মধ্যে রাজপথে মারামারি ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এই সংগঠনটির নানা বক্তব্য-দাবি আওয়ামী লীগকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। সরকারের প্রণীত নারী নীতি, শিক্ষা নীতির প্রকাশ্য বিরোধিতা তো আছেই, বঙ্গবন্ধুর নামের আগে ‘শহীদ’ এবং ‘পরে রহমতুল্লা আলাইহি’ লেখার দাবি তুলেও হাস্যরস সৃষ্টি করেছে ওলামা লীগ। তবে সর্বশেষ বর্ষবরণ নিয়ে ওলামা লীগ যা বলেছে, তাতে অনতিবিলম্বে আওয়ামী লীগের উচিত সংগঠনটির সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক না থাকার ঘোষণা দেয়া অথবা ওলামা লীগকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া। নইলে আওয়ামী লীগের ঘোষিত আদর্শ আর ওলামা লীগের বক্তব্য সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রম বা সংশয় তৈরি করবে। বিষয়টা পরিস্কার হওয়া দরকার।

শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে কড়াকড়ি আরোপের জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধের দাবি জানিয়েছে ওলামা লীগ। সংগঠনটির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে পহেলা বৈশাখের আয়োজনকে ‘অনৈসলামিক ও হারাম’ বলে উল্লেখ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘পহেলা বৈশাখের নামে চারুকলার গাঁজাখোর মিডিয়া ও পুঁজিবাদী বেনিয়াগোষ্ঠি বাণিজ্য করছে। ওদের শোষণ থেকে জনগণকে বাঁচাতে হবে।’ মুসলমানদের ‘ইসলামহীন’ করার জন্যই পহেলা বৈশাখের ‘অপতৎপরতা’ বলে দাবি করেছে ওলামা লীগ।

সম্প্রতি বৈশাখী বোনাস চালু করে সব মহলের দারুণ প্রশংসা পেয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ওলামা লীগ দাবি করেছে, ‘সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রয়েছে। এজন্য মুসলমানদের পহেলা বৈশাখের বোনাস বাদ দিয়ে মহাপবিত্র সাইয়্যিদুল আইয়াদ শরীফ উপলক্ষে বোনাস দেওয়া উচিত।’ এমনকি সংগঠনটি চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগ দাবি করেছে। তাদের মূল আপত্তি প্রধান বিচারপতির ধর্ম।

মানববন্ধনে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’কে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ অ্যাখ্যা দিয়ে এটি সংশোধনের দাবি জানানো হয়। ওলামা লীগের নেতারা বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী আওয়ামী লীগের কাঁধে চড়ে তার নাস্তিক্যবাদী শিক্ষা দর্শন ৯৮ ভাগ মুসলমানের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে করে ধর্মপ্রাণ মানুষরা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, যে সুযোগ নিচ্ছে জামাত জোট।’ মানববন্ধনে ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন’ বাতিল করার দাবিও জানানো হয়।

আমি বিশ্বাস করি, ওলামা লীগ যা বলছে, তা কখনওই আওয়ামী লীগের মনের কথা নয়। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই এখনও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করে। তবে ভোটের রাজনীতির হিসেবেই হয়তো অনেক সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধে চুপ করে থাকে। বিশ্বাস যাই হোক, এটা ঠিক আওয়ামী লীগ আর এখন আগের মতো সাহসী সংগঠন নয়। ষাট বছর আগে সংগঠনের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেটে ফেলতে পারলেও,আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হুমকির কাছে অনেকটাই কৌশলী বা অসহায় দলটি। মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্মও বহাল আছে। কিন্তু তবুও আমরা বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগের পক্ষেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ার লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই দলটির উচিত অনতিবিলম্বে ওলামা লীগের ব্যাপারে দলটির অবস্থান পরিষ্কার করা। কারণ আওয়ামী লীগের যেমন সাতটি সহযোগী সংগঠন আছে,তেমনি আছে অসংখ্য অসহযোগী সংগঠনও। আর অসহযোগী সংগঠনের তালিকা এক নম্বরে থাকবে আওয়ামী ওলামা লীগের নাম। এখনই রাশ না টানলে এই ওলামারা গিলে খেতে পারে আওয়ামী লীগকেই, জামায়াত যেমন গিলে খেয়েছে বিএনপিকে।

লেখক:  অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

ইমেল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খুলনায় আড়াই ঘণ্টার বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতা
খুলনায় আড়াই ঘণ্টার বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতা
রৌমারীতে চেয়ারম্যান প্রার্থীর ওপর প্রতিপক্ষের হামলা
রৌমারীতে চেয়ারম্যান প্রার্থীর ওপর প্রতিপক্ষের হামলা
টেকনাফে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
টেকনাফে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ