X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এক শিক্ষকের উদ্যোগে বদলে গেছে একটি বিদ্যালয়

বিপুল সরকার সানি, দিনাজপুর
১০ মার্চ ২০২৩, ১১:০০আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৩, ১১:০০

এক শিক্ষকের উদ্যোগে বদলে গেছে একটি বিদ্যালয়। যিনি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই নয়, জীবনে চলার প্রয়োজনীয় সব জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার জন্য কাজ করছেন। বিদ্যালয়টিকে শতভাগ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। এই বিদ্যালয়টির রূপকারের নাম রতন কুমার রায়। তিনি দিনাজপুরের সারদেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

রতন কুমার রায় ১৯৯৮ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে সারদেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। এরপর থেকেই বিদ্যালয়টিকে উন্নত করতে কাজ শুরু করেন। গত পাঁচ বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হারও নিয়ে এসেছেন শূন্যের কোঠায়। এ ছাড়াও বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলেও এসেছে সাফল্য।

রতন কুমার রায় এই বিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্লাসরুমই করা হয়েছে ডিজিটাল ভিত্তিতে। প্রজেক্টরের মাধ্যমে পাঠদান করানো হয় শিক্ষার্থীদের। পাঠ্যপুস্তকের সহযোগিতা নিয়ে শ্রেণিশিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে কম্পিউটারে নোট তৈরি করে সেগুলো প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেখান। প্রয়োজনে সেগুলো শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করেন। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ালেখা বুঝতে সুবিধা হয়।

বিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাসে লাগানো হয়েছে নানান রকমের ফুল ও ফলের গাছ। একধারে হাউজ করে পানি এবং মাটি দিয়ে লাগানো হয়েছে শাপলা। এ ছাড়াও নানান ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে, যেগুলো সচরাচর দেখা যায় না। রয়েছে বিদেশি গাছ।

বাংলাদেশের নাম পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেওয়ার গৌরবময় ইতিহাসকে শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে দিতে বিদ্যালয়টিতে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ এবং শহীদ মিনার। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব অর্থায়নে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং শহীদ মিনারের আদলে এসব নির্মাণ করা হয়। এটিই বাংলাদেশের প্রথম কোনও বিদ্যালয় যেখানে ক্যাম্পাসে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। রয়েছে দেশের মানচিত্র। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেয়ালে বসানো হয়েছে বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, মণীষী, বিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন মানচিত্রের ছবি।

একুশে ফেব্রুয়ারি ও শিশু দিবসে দেয়ালিকা প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে তিন বার। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে টানা তিন বার ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জেলা চ্যাম্পিয়ন এবং বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কয়েকবার। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে পুরস্কার অর্জন করেছে। ২০১৯ সালের অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান মেলায় প্রথম স্থান অধিকার ছাড়াও প্রতি বছর শতাধিক পুরস্কার অর্জন করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশপাশি এই প্রতিষ্ঠানের সাত জন শিক্ষার্থী পেয়েছে স্কাউটিং প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড।

শিক্ষার্থীদের খেলাধুলাতেও উৎসাহ দেন প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়টির একটি বড় কক্ষের কিছুটা অংশ জুড়ে দোকানের আদলে গঠন করেছেন ছোট একটি প্রতিষ্ঠান। নাম সততা স্টোর। এই দোকানে রয়েছে শিক্ষার্থীদের খাতা-কলম এবং আনুষঙ্গিক শিক্ষাসামগ্রী কেনার সুবিধা। শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় সব ধরনের উপকরণ নিচ্ছে এবং তার দাম দিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু এখানে টাকা নেওয়ার মতো কেউ নেই। শিক্ষার্থীরা যাতে ছোট থেকেই সৎ হয়ে ওঠে সে জন্য এই উদ্যোগ। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের মানসিক চিন্তাশক্তি পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন বাণী লেখা আছে। যেমন– ‘সততা খুবই দামি উপহার,’ ‘যে সৎ হয় নিন্দা তার কোনও অনিষ্ট করতে পারে না,’ ‘শঠতার যুগে সত্যি বলাই একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ’ ইত্যাদি।

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে প্রধান শিক্ষক এই বিদ্যালয়ে গঠন করেন দুই টাকার ব্যাংক। যা শিক্ষার্থীরাই পরিচালনা করে। প্রতি শিক্ষার্থী মাসে দুই টাকা করে এই ব্যাংকে জমা করে। পরে এই টাকা আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য ব্যয় করা হয়। তার শিক্ষাউপকরণ কিনে দেওয়া হয় এই অর্থ দিয়ে। করোনাকালে ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর এই ব্যাংকের প্রায় দেড় লাখ করে টাকা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় ব্যয় করা হচ্ছে।

আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। এখানকার অনেক শিক্ষার্থী কাগজ, পুঁথি, সুতাসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে হাতের তৈরি ফুল, ফল তৈরি করছে। বিভিন্ন মাধ্যমে এসব উপকরণ বিক্রিও করছে তারা। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের চারুকলায় পারদর্শী করে গড়ে তুলতে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি।

শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে এই বিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বীরশ্রেষ্ঠ কর্নার। শুধু তাই নয়, রয়েছে শেখ কামাল কর্নারও। এ ছাড়াও সাহিত্য বিকাশে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল কর্নারও গঠন করা হয়েছে।

বিদ্যালয়টিতে ২০১৪ সালে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ শতাধিক। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮ শতাধিক। ২০১৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয় ৭৮ জন শিক্ষার্থী। ৪ জন জিপিএ-৫-সহ মোট উত্তীর্ণ হয় ৬৯ জন। ২০২২ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০ জন জিপিএ-৫ এবং মোট উত্তীর্ণ হয় ৯৫ জন।

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইভানা আক্তার বলে, ‘আমি এই বিদ্যালয় থেকেই ক্রিকেট খেলায় আগ্রহী হয়েছি। জেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতাতেও অংশ নিয়েছি। এই বিদ্যালয় থেকে খেলাধুলায় আমাকে বেশ সাপোর্ট দেওয়া হয়। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও আগ্রহী হয়েছি এমন পরিবেশের জন্য।’

সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী বুশরা বলে, ‘বিদ্যালয়ে প্রজেক্টরের মাধ্যমে ক্লাস হয়। এখানে ভর্তি হওয়ার পর প্রজেক্টরের মাধ্যমে ক্লাস করছি। এতে আমার পড়ালেখা বুঝতে সুবিধা হচ্ছে।’

নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান মুসকান বলে, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধ কী, এ নিয়ে মনে অনেক প্রশ্ন এসেছে। আমাদের বিদ্যালয়ে মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের ছবি দেখে সেই প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। দিনাজপুরের অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক অনেক ছবি আছে আমাদের এই কর্নারে। এখন উপলব্ধি করতে পারি, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কতটা ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই বাংলাদেশ!’

নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোস্তরিনা চৌধুরী বলে, ‘আমাদের শিক্ষকরা অনেক প্রশিক্ষণই দেন। হস্তশিল্প, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞানসহ নানান বিষয়ে প্রতিযোগিতায় জ্ঞানার্জনে আমাদের সহযোগিতা করা হয়।’

শ্রেণিকক্ষে প্রধান শিক্ষক রতন কুমার রায় দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন শাহনুর করিম সৌরভ। তিলে তিলে একটি প্রতিষ্ঠানটির উচ্চ শিখরে ওঠা তার চোখের সামনে। তিনি বলেন, ‘১৯২৭ সালে এই বিদ্যালয়টির যাত্রা। সেদিক দিয়ে অনেক প্রাচীন বিদ্যালয়। পুঁথিগত বিদ্যালয়ের বাইরেও অনেক শিক্ষা রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী পরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠতে পারে। সেই দিক বিবেচনায় রেখেই প্রধান শিক্ষক কাজ করছেন এবং আমরাও তার সঙ্গে কাজ করছি। ইতোমধ্যে আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নানান বিষয়ে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।’

সহকারী প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়া, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। শতভাগ ডিজিটাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে আমাদের বিদ্যালয় সফলতা অর্জন করবে। সাহিত্য চর্চা, খেলাধুলা, আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। এই বিদ্যালয়টিতে ঘাটতি রয়েছে একটি ডিজিটাল ল্যাবের। আগের যে ল্যাবটি রয়েছে তাতে বৃহৎ শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

প্রধান শিক্ষক রতন কুমার রায় বলেন, ‘১৯৯৮ সালে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরুর পর মনের ইচ্ছা ছিল একটি আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই শুরু হয় বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ। ঝরে পড়া রোধ, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা, বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা প্রদান, পাঠ্যবইয়ের বাইরে থেকে জ্ঞান আহরণ, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পারদর্শী করতে শিক্ষকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট সময়সীমার বাইরেও তারা কাজ করছেন। কিছু বিষয়ে সমস্যা রয়েছে, যেগুলোতে সরকারিভাবে পদক্ষেপ ও পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট দফতরে জানানো হয়েছে। এগুলোর সমাধান হলে আমরা আরও একধাপ এগিয়ে যাবো।’

/এমএএ/
সম্পর্কিত
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
সর্বশেষ খবর
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি