X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১
২২ বছরে ২৮ খুন, ৯৩৪ মামলা

চার হাজার আসামির এলাকায় ‘শান্তির সুবাতাস’

সালেহ টিটু, বরিশাল
২৫ জুলাই ২০২৩, ০৮:০১আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২৩, ০৮:০১

বরিশালের মুলাদী উপজেলার বাটামারা ও সফিপুর ইউনিয়নে বংশীয় দুই গ্রুপের বিরোধে হত্যা, ডাকাতি, বোমাবাজি, চুরি ও অপহরণ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাটামারার হাজী ও সফিপুরের আকন গ্রুপের মধ্যে এই বিরোধ বছরের পর বছর চলে আসছিল। এভাবে চলে আসায় দুই ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামে বেড়েছে অপরাধ ও হত্যাকাণ্ড। দুই গ্রুপের লোকজন করেছেন ৯৩৪টি মামলা। এসব মামলার আসামি চার হাজারের বেশি। অবশেষে পুলিশের উদ্যোগে পাঁচ গ্রামের মানুষের মাঝে বইছে শান্তির সুবাতাস। 

স্থানীয় সূত্র জানায়, বরিশাল, মাদারীপুর, শরীয়তপুরের সীমান্ত ইউনিয়ন মুলাদীর বাটামারার তয়কা, টুমচর, চিঠিরচর ও চর সাহেবরামপুর গ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে হাজী গ্রুপ। অপরদিকে সফিপুরের বালিয়াতলি গ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে আকন গ্রুপ। গ্রামের কেউ কোনও গ্রুপের অনুসারী না হলে সেখানে বসবাস করা মুশকিল হয়ে পড়তো। ফলে কোনও না কোনও গ্রুপভুক্ত হতো। বেশিরভাগ মানুষ মামলার আসামি হওয়ায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে দুই ইউনিয়নের পাঁচ গ্রাম।

এ অবস্থা নিরসনে সম্প্রীতি সমাবেশের আয়োজন করেছে বরিশাল, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা পুলিশ। এতে দুই গ্রুপ থেকে পাঁচ জন করে ১০ ব্যক্তির মাঝে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মধ্য দিয়ে দুই যুগের বিরোধ মিটেছে। পাঁচ গ্রামে বইছে শান্তির সুবাতাস। বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন মামলার আসামিরা। এমন উদ্যোগ নেওয়ায় বরিশাল, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা পুলিশের প্রশংসা করছেন স্থানীয়রা।

পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মাঝেমধ্যেই হাজী ও আকন গ্রুপের সংঘর্ষ হতো। সংঘর্ষে গত ২২ বছরে (২০০১-২০২৩) পাঁচ গ্রামে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২৮ জন। সেইসঙ্গে ঘটেছে ডাকাতি, বোমাবাজি, চুরি ও অপহরণের ঘটনা। এসব ঘটনায় ৯৩৪টি মামলায় চার হাজার ৪৩৯ জনকে আসামি করা হয়। একে-অন্যের বিরুদ্ধে এসব মামলা করেছেন দুই গ্রুপের লোকজন। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় মামলার পর মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে গিয়ে আশ্রয় নিতেন আসামিরা।

দুই গ্রুপ থেকে পাঁচ জন করে ১০ ব্যক্তির মাঝে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর

বাটামারার টয়কা টুমচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জামিল মোর্শেদ বলেন, ‘সংঘর্ষ ও মারামারির কারণে পাঁচ গ্রামের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি এসব গ্রামে জনপ্রতিনিধি ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত ছিলেন। বাড়িতেও আসতেন না অনেকে।’

তিনি বলেন, ‌‘পাঁচটি গ্রামের অনেকে শিল্পপতি, কেউ রাজনীতিবিদ, আবার কেউ সরকারি বড় পদে আছেন। সংঘর্ষের কারণে তারা গ্রামের খোঁজখবর নিতেন না। এ জন্য উন্নয়নে পিছিয়ে পড়েছে গ্রামগুলো। আবার দেখা গেছে, হত্যা, ডাকাতি ও চুরির ঘটনায় করা মামলায় দুই গ্রুপের বহু লোককে আসামি করা হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে যারা এলাকায় থাকেন না, তাদেরও মামলার আসামি করা হয়েছে। এর ফলে অপরাধ না করেও অনেকে আসামি হয়েছেন। ফলে যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা গ্রামের বাড়িতে থাকেন না। ছেলেমেয়েদের নিয়ে শহরে বসবাস করেন। এত বছর পর পুলিশ এমন পদক্ষেপ নেওয়ায় গ্রামগুলোতে শান্তির সুবাতাস বইছে। এমন একটি পদক্ষেপের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা।’

সফিপুর ইউনিয়নের সমাজসেবক মিজানুর রহমান ও ব্যবসায়ী হুমায়ুন মোল্লা জানান, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে হাজী ও আকন গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। বাবার পর ছেলে, তারপর নাতি—বংশ পরস্পর এই বিরোধ চলে আসছিল। হাজী গ্রুপের একজনকে হত্যা করা হলে কয়েকদিনের মধ্যে আকন গ্রুপের একজনকে হত্যা করা হতো। এরপর চলতো পাল্টা-পাল্টি মামলা। এভাবে গত ৫০ বছরে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পাশাপাশি দুই গ্রুপ আধিপত্য ধরে রাখতে বোমাবাজি, ডাকাতি, চুরি ও অপহরণ করে শক্তির জানান দিতো। এতে প্রতিটি গ্রামে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসবাস করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। তবে যারা সচ্ছল তারা গ্রাম ছেড়ে শহরের বাসিন্দা হয়েছেন। যারা গ্রামে রয়েছেন, তারা একেকজন পাঁচ থেকে ১০টি মামলার আসামি। অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন, কেউ কেউ কারাগারেও আছেন।

পুলিশের এমন পদক্ষেপ প্রশংসনীয় উল্লেখ করে হুমায়ুন মোল্লা বলেন, ‘আমরা অনেক খুশি হয়েছি। এই সম্প্রীতি বজায় রাখতে দুই গ্রুপের অনুসারীদের শান্ত থাকতে হবে। তা না হলে আবারও অশান্তি শুরু হবে।’

এই সম্প্রীতি সমাবেশ আরও আগে হলে অপরাধ অনেক কমে যেতো বলে জানালেন বাটামারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন অশ্রু। তিনি বলেন, ‘পাঁচ গ্রামের বাসিন্দাদের পাশাপাশি আমি অনেক খুশি হয়েছি। বহু বছর পর গ্রামগুলোতে শান্তি ফিরেছে। ২০০১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচটি গ্রামে ২৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। স্বাধীনতা পর থেকে হিসাব করলে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।’

সফিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু মুসা হিমু মুন্সি বলেন, ‘এই সমাবেশ আরও আগে হলে ভালো হতো। সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর দুই গ্রুপের পালিয়ে থাকা ব্যক্তিরা পরিবারে ফিরতে শুরু করেছেন। তারা এখন নিরাপত্তা চাচ্ছেন। বিষয়টি মুলাদী থানার ওসিকে বলেছি। ওসি বলেছেন একজন ব্যক্তিকেও মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হবে না। প্রকৃতপক্ষে যারা অন্যায় করেছে, তাদের গ্রেফতার করা হবে।’

ওই দুই ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামে শান্তি ফেরাতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানালেন মুলাদী থানার ওসি মো. মাহাবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাটামারা ও সফিপুর ইউনিয়নের সঙ্গে মাদারীপুর এবং শরীয়তপুরের সীমান্ত রয়েছে। হত্যা ও অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটানোর পর সীমান্ত ব্যবহার করে অপরাধীরা সহজে আত্মগোপনে চলে যেতো। ফলে ওসব গ্রামে হত্যাকাণ্ড ও অপরাধের সংখ্যা বেশি হয়। আধিপত্য ধরে রাখতে এলাকায় হাজী ও আকন গ্রুপের সৃষ্টি হয়। দুই গ্রুপের বিরোধ বহু বছরের। গত ২২ বছরে হত্যা, ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অপহরণের ঘটনায় ৯৩৪টি মামলা হয়। এসব মামলায় চার হাজার ৪৩৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।’

বাটামারা-সফিপুর ইউনিয়নে স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পুলিশ সুপার ওয়াহিদুল ইসলাম

ওসি আরও বলেন, ‘বিরোধের জেরে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। এরপর বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছিল। পরে তিন জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সম্প্রীতি সমাবেশের মাধ্যমে দুই গ্রুপকে সমঝোতার জন্য ডাকা হয়। আশা করছি, এর মধ্য দিয়ে তাদের বিরোধ মিটে গেছে। এলাকায় শান্তি ফিরেছে। যারা অপরাধ না করেও আসামি হয়েছেন, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে না। আমরা দুই পক্ষকে বলেছি, তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত আইনের আওতায় আনা হবে। তারা বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কোনও বিশৃঙ্খলার কথা আমরা শুনিনি।’

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শনিবার (২২ জুলাই) বিকাল ৪টায় মুলাদী উপজেলার বাটামারা ইউনিয়নের জাগরণী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার ওয়াহিদুল ইসলাম। প্রধান আলোচক ছিলেন মাদারীপুর জেলা পুলিশ সুপার মাসুদ আলম ও শরীয়তপুর জেলা পুলিশ সুপার মাহাবুবুল আলম। সমাবেশ শেষে মাদারীপুর-শরীয়তপুর সীমান্তের বাটামারা-সফিপুর ইউনিয়নে স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পুলিশ সুপার ওয়াহিদুল ইসলাম। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল হাসান, বরিশালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহজাহান হোসেন, শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. বদিউজ্জামান, মুলাদী উপজেলা চেয়ারম্যান তারিকুল হাসান খান মিঠু খান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান, সাতক্ষীরা যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. বেল্লাল হোসেন এবং দুই গ্রুপের লোকজন।

/এএম/ 
সম্পর্কিত
কষ্টিপাথর কিনে প্রতারিত হয়ে অপহরণ, গ্রেফতার ৭
৩২ কুর্দি সদস্যকে হত্যার দাবি তুরস্কের
প্রত্যেক বস্তা থেকে সরানো হয় চাল, ডিলারের বিরুদ্ধে থানায় মামলা
সর্বশেষ খবর
ডি মারিয়ার সঙ্গে চুক্তির গুঞ্জনে যা বললেন মায়ামি কোচ
ডি মারিয়ার সঙ্গে চুক্তির গুঞ্জনে যা বললেন মায়ামি কোচ
রাজশাহীতে হাসান আজিজুল হক সাহিত্য উৎসব, পদক পাচ্ছেন ৬ জন
রাজশাহীতে হাসান আজিজুল হক সাহিত্য উৎসব, পদক পাচ্ছেন ৬ জন
এই সরকার ভোটে নির্বাচিত নয়, সেজন্য জনগণকে তারা ভয় পায়: ড. মঈন খান
এই সরকার ভোটে নির্বাচিত নয়, সেজন্য জনগণকে তারা ভয় পায়: ড. মঈন খান
পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলো ভারত
পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলো ভারত
সর্বাধিক পঠিত
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে