X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

টোকেন দিয়ে মাসে ৬০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি

নাসির উদ্দিন রকি, চট্টগ্রাম
২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:০০আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:০০

লাইন নিয়ন্ত্রণের নামে টোকেন দিয়ে চট্টগ্রাম নগরে সাত হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে মাসে ৬০-৭০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে একটি প্রভাবশালী চক্র। চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে প্রায়ই ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। শহরের প্রবেশদ্বার চান্দগাঁও থানার মোহরা কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড় থেকে এসব অটোরিকশা উপজেলা শহর ও বিভিন্ন গ্রামে যাতায়াত করে। ফলে অটোরিকশার লাইন নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি চলে অস্ত্রের মহড়া। তাদের হাতে জিম্মি চালকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীতে অবৈধ সিএনজি অটোরিকশার লাইনের মধ্যে চান্দগাঁও থানার মোহরা কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড় অন্যতম। জেলার রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, কাপ্তাই ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন যানবাহন যাত্রী নিয়ে আসে রাস্তার মাথা মোড়ে। সেখান থেকে যাত্রীদের নিয়ে উপজেলা শহর ও বিভিন্ন গ্রামে যান অটোরিকশাচালকরা। মূলত এই রাস্তার মাথা মোড় পর্যন্ত অটোরিকশা আনতে মাসে ৬০০ টাকা চাঁদা দিয়ে টোকেন নিতে হয় চালকদের। এর বাইরে রাস্তার মাথা মোড় থেকে যতবার যাত্রী নেবে ততবারই ১০ টাকা করে দিতে হয় লাইন নিয়ন্ত্রকদের।

দুই মাস আগে কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড় এলাকায় অটোরিকশার লাইন নিয়ন্ত্রণ করতেন হাসান, ভুট্টু, হোসেন ও সোহেল রানাসহ ২০ জনের একটি গ্রুপ। সম্প্রতি তাদের মারধর করে ওই স্থান থেকে তাড়িয়ে তা নিয়ন্ত্রণে নেন আজাদ, মুজিব, জাফর ও তাদের সহযোগীরা। চলতি বছর লাইন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ১০ বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ২০ জনের বেশি।

শহরের প্রবেশদ্বার চান্দগাঁও থানার মোহরা কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড় থেকে এসব অটোরিকশা উপজেলা শহর ও বিভিন্ন গ্রামে যাতায়াত করে

সরেজমিনে দেখা গেছে, কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার অটোরিকশা। এসব নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশ নেই। গুরুত্বপূর্ণ এই মোড়ের অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করছে এক শ্রেণির ‘লাঠিয়াল বাহিনী’। লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যদের কথায় চলে মোড় থেকে অটোরিকশা। দেখে মনে হচ্ছে আলাদা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে লাঠিয়াল বাহিনী। অটোরিকশার লাইন নিয়ন্ত্রকদের হয়ে কাজ করছেন লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যরা। নিয়ন্ত্রণের কাজে রয়েছেন ১৫-২০ জন সদস্য। এর মধ্যে কেউ যেসব অটোরিকশা যাত্রী নিয়েছে সেগুলো থেকে ১০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছেন। কেউ মাসিক টোকেনের মেয়াদ আছে কিনা তা দেখছেন। আবার কেউ গাড়ির সিরিয়াল করে দিচ্ছেন। কোনও চালক টাকা কম দিলে তাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় ফেলে লাঠি দিয়ে মারধর করা হচ্ছে। আশপাশে সবাই প্রতিদিন এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখলেও প্রতিবাদ করার যেন কেউ নেই।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এগুলো প্রতিদিনের দৃশ্য। যানবাহনের শৃঙ্খলার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণ করছেন লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যরা। তাদের কথায় চলছে এখানের সব অটোরিকশা।

তিন বছর ধরে কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড় থেকে বিভিন্ন স্থানে যাত্রী পরিবহন করেন রাঙ্গুনিয়ার আজগর আলী। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘রাস্তার মাথা থেকে যতবার যাত্রী নিই ততবারই ১০ টাকা করে দিতে হয় আমাদের। এছাড়া প্রতি মাসে ৬০০ টাকা দিয়ে টোকেন নিতে হয়। তা নাহলে রাস্তার মাথা মোড় থেকে যাত্রী তুলতে দেওয়া হয় না। যেসব অটোরিকশাচালক টোকেন নেননি সেগুলোকে ট্রাফিক পুলিশকে দেখিয়ে দিয়ে মামলা দিয়ে দেন লাইন নিয়ন্ত্রণকারীদের সদস্যরা। আবার তারা দেখিয়ে দিলে সেসব অটোরিকশা জব্দ করে নিয়ে যায় পুলিশ।’ 

আজগর আলী বলেন, ‘কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড় থেকে দিনে সাত হাজারের বেশি অটোরিকশা যাত্রী নিয়ে আসা-যাওয়া করে। সে হিসাবে সাত হাজার অটোরিকশা থেকে একবার ১০ টাকা করে নিলে দিনে ৭০ হাজার টাকা, মাসে ২১ লাখ টাকা। মাসে ৬০০ টাকা টোকেন দিয়ে সাত হাজার অটোরিকশা থেকে চাঁদা নেওয়া হয় ৪২ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে মাসে ৬০-৭০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করে তারা।’

অটোরিকশার লাইন নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি চলে অস্ত্রের মহড়া

দুই মাস আগে এই লাইন নিয়ন্ত্রণ করতেন মো. হোসেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘দুই মাস আগে আমাদের টিমকে তাড়িয়ে নতুন করে আজাদ, মুজিবসহ ১৫-২০ জনের একটি টিম রাস্তার মাথা এলাকার অটোরিকশার লাইন দখলে নিয়েছে। তারা এখন ওই এলাকায় চরম অরাজকতা চালাচ্ছে। আমরা নির্দয়ভাবে চালকদের কাছ থেকে টাকা নিই নাই। এখন তারা টাকার জন্য চালকদের মারধর করছে। অবৈধভাবে ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছে।’

রাস্তার মাথা এলাকায় অটোরিকশায় টোকেন বাণিজ্যে বর্তমানে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে অন্যতম মো. আজাদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘আগে হোসেনসহ আরও কয়েকজন অটোরিকশার এই লাইন নিয়ন্ত্রণ করতো। হোসেনকে অস্ত্রসহ কিছুদিন আগে আটক করেছিল র‌্যাব। এরপর আমিসহ অন্যরা লাইন নিয়ন্ত্রণ করছি। হোসেনের লোকজন কিছুদিন আগেও রাঙ্গুনিয়ায় আমাদের সদস্যদের ওপর হামলা করেছিল। এখন আমরা লাইন পরিচালনার জন্য ১৭ সদস্যের কমিটি গঠন করেছি। কমিটিতে আমাকে সভাপতি হিসেবে রাখা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এক মাসের প্রতি অটোরিকশা থেকে টোকেন প্রতি ৫০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। এখানে অনেক খরচ আছে। এই টাকা দিয়ে এসব খরচ মেটানো হয়।’ টোকেন দিয়ে চাঁদা নেওয়ার বৈধতা আছে কিনা জানতে চাইলে তার কোনও জবাব দেননি মো. আজাদ।

টোকেন দিয়ে চাঁদা আদায় সম্পূর্ণ অবৈধ বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর অটোরিকশা-অটো টেম্পো মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক টিটু চৌধুরী। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এটি মূলত চাঁদাবাজি। এসব চাঁদাবাজি বন্ধে প্রশাসনের কাছে আমরা একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু প্রশাসন এসব চাঁদাবাজি বন্ধে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। প্রকাশ্যে টোকেনের মাধ্যমে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে যে শুধু স্থানীয় সন্ত্রাসীরা জড়িত, তা কিন্তু নয়। স্থানীয় থানা ও ট্রাফিক পুলিশও জড়িত। এজন্য আমরা অভিযোগ দিলেও কোনও ব্যবস্থা নেয় না পুলিশ।’

তবে এসবে পুলিশ জড়িত কিনা তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার জয়নাল আবেদীন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘রাস্তার মাথা এলাকায় টোকেনের বিনিময়ে অটোরিকশা থেকে চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। টোকেন দিয়ে চাঁদা নেওয়ার বৈধতা কাউকে দেওয়া হয়নি। এটি সম্পূর্ণ চাঁদাবাজি। বিষয়টি সম্পর্কে স্থানীয় থানা পুলিশ এবং সিএমপির ক্রাইম ডিভিশন ভালো বলতে পারবে। তবে যানবাহনের কোনও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তা আমরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো।’

রাস্তার মাথা মোড় থেকে যাত্রীদের নিয়ে উপজেলা শহর ও বিভিন্ন গ্রামে যান অটোরিকশাচালকরা

টোকেন দিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ দেয়নি বলে জানালেন চান্দগাঁও থানার ওসি মঈনুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার দায়িত্ব হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি দেখা। যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য রাস্তার মাথা এলাকায় একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টরকে (টিআই) দায়িত্ব দেওয়া আছে। টোকেন দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা থেকে চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি আমাকে কেউ জানায়নি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। তবে রাস্তার মাথা মোড়ে প্রচুর সিএনজি অটোরিকশা যাতায়াত করায় কিছুটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তবে গ্রামের সিএনজি অটোরিকশা কীভাবে শহরে প্রবেশ করছে, তা আমার জানা নেই। বিষয়টি ট্রাফিক পুলিশ ভালো বলতে পারবে।’

রাস্তার মাথা এলাকায় দায়িত্বরত সিএমপির ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মোশারফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গ্রামের প্রচুর সিএনজি অটোরিকশা রাস্তার মাথা এলাকা থেকে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। এতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সমস্যা হয়। বিষয়টি নিয়ে আমিও বিব্রত। তবে টোকেন দিয়ে অটোরিকশাচালকদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। গ্রামের অটোরিকশা শহরে প্রবেশ করায় প্রতিদিন অন্তত ৯-১০টি জব্দ করে মামলা দেওয়া হয়।’

 

/এএম/
সম্পর্কিত
যাত্রাবাড়ীতে চাঁদা আদায়ের সময় গ্রেফতার ১৫
পিনাকীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
ফার্নিচার কারখানায় ৬০০ বস্তা চিনি মজুত
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ