X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

অবৈধপথে বিদেশ যাত্রা: গল্প শুধু নির্যাতন-অত্যাচারের

বিজয় রায় খোকা, কিশোরগঞ্জ
১২ আগস্ট ২০২১, ১৪:২৯আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২১, ১৫:২১

সচ্ছল জীবনের দেশের অনেক তরুণ অবৈধপথে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশের বিভিন্ন দেশে। অবৈধভাবে গিয়ে প্রাণ হারান এদের অনেকেই। অনেকের খোঁজ মিলে না সারা জীবনেও। গত বছরের ২৮ মে অবৈধপথে ইতালি যাওয়ার সময় লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে মাফিয়ারা। যার মধ্যে ভৈরবের ছয় জন নিহত হন। আহত হন তিন জন। আর এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন দুই জন।

বিশ্ব তোলপাড় করা এ ঘটনায় নিখোঁজ ভৈরবের জগন্নাথপুরের ইছার উদ্দিন (৪০) ও লক্ষ্মীপুর গ্রামের বিজয়ের (২০) পথ চেয়ে এখনও বসে আছেন স্বজনরা।

স্বজনরা জানান, ২৮ মে যে দলটি থেকে লিবিয়ায় ২৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে সে দলের সঙ্গেই লিবিয়া গিয়েছিলেন নিখোঁজ দুই জন। তবে নিহতদের তালিকায় ছিল না তাদের নাম। এ ঘটনার আগের দিনও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তারা। ১০ লাখ টাকা যেভাবেই হোক যোগাড় করে মুক্তিপণ পাঠানোর আর্তি ছিল তাদের। ভয়েস মেসেজে পাঠিয়েছেন অমানবিক পাশবিক নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছিলেন নিখোঁজ দুই জন। সেই মেসেজগুলো শুনে এখনও কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা।

নিখোঁজ ইছার উদ্দিন প্রায় এক যুগ ধরে ভৈরবে বসবাস করলেও তার বাড়ি নেত্রকোনায়। তিনি নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ী উপজেলার নুরালীপুর গ্রামের মৃত আকবর মিয়ার ছেলে। বিয়ের কয়েক বছর পর থেকে শ্বশুরবাড়ি ভৈরবেই তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে ড্রেজারে মাটি কাটার কাজ করতেন তিনি। একমাত্র মেয়ে সিনহা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। স্ত্রী সুমাইয়া এক বছর ধরে স্বামীর পথচেয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন।  

স্বজনরা জানান, প্রতিবেশী জগন্নাথপুরের উত্তর পাড়ার হযরত মিয়ার তিন ছেলে লিবিয়া ও ইতালি থাকার সুবাদে তাদের পরিবারের কাছ থেকে ইতালি যাওয়ার প্রস্তাব পায় ইছার উদ্দিন। উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে হযরত আলীর কথায় গতবছর অবৈধপথে লিবিয়ার জন্য রওনা হন তিনি। হযরত আলীর সঙ্গে কথামতো যাওয়ার আগে পঞ্চাশ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। সাগর পথে লিবিয়ার কাছাকাছি এক জায়গায় পৌঁছার পর আরও সাড়ে চার লাখ টাকা হযরত আলীর হাতে তুলে দেন ইছারের স্ত্রী সুমাইয়া। 

তারপরের গল্প শুধু নির্যাতন, অত্যাচার আর অমানবিকতার। ইছার উদ্দিন একের পর এক স্ত্রীর কাছে অজ্ঞাত এক নম্বর থেকে ইমোতে ভয়েস মেসেজ পাঠাতে থাকেন। তিনি ভয়াবহ নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন ভয়েস মেসেজে। জানান তার একটি হাত ও পা ভেঙে ফেলা হয়েছে, যেভাবেই হোক ১০ লাখ টাকা দুবাইয়ের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে। আবার কখনও ভয়েস মেসেজে জানিয়েছেন কারেন্টের শক দেওয়ার নির্মম নির্যাতনের কথা। 

গত বছরের ২৮ মে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার আগের দিন পর্যন্ত ইমোতে একের পর এক স্ত্রীর কাছে ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছেন ইছার উদ্দিন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর আর কোনও মেসেজ আসেনি। তবে ইছার উদ্দিনের নাম পাওয়া যায়নি নিহত বা আহতদের তালিকায়। কয়েকদিনের মধ্যেই দালাল হযরত আলী ও তার ইতালি ফেরত ছেলে সুজনকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা এখন জেল হাজতে থাকলেও নিখোঁজ স্বামীর সন্ধান পাননি সুমাইয়া। 

সিআইডি থেকে কয়েকবার তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ভয়েস মেসেজগুলোও সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

ইছার উদ্দিনের স্ত্রী সুমাইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমার মেয়েকে আমি কোনও জবাব দিতে পারি না। তার বাবা কোথায় আছে, কেমন আছে? ভয়েস মেসেজগুলো শুনে আমি ঠিক থাকতে পারি না। আমার কিছুই বলার নেই। আমি আমার স্বামীকে ফিরে পেতে চাই। 

ইছার উদ্দিনের মতো একই ঘটনার শিকার হয়েছেন ভৈরব লক্ষ্মীপুরের আশেক মিয়ার ছেলে বিজয় (২০)। বাবার সঙ্গে ভৈরবে ফলের দোকান চালাতো বিজয়। একই উপজেলার পঞ্চবটী এলাকার জাফরের ফাঁদে পা দিয়ে অনিশ্চিত যাত্রায় পা বাড়ান তিনি। ছেলেকে ইতালিতে নিয়ে ভালো কাজ দেওয়ার আশ্বাসে সাড়ে চার লাখ টাকা জাফরকে দেন আশেক মিয়া। লিবিয়ার কাছাকাছি পৌঁছার পর থেকে আশেক মিয়ার কাছে মুক্তিপণের দাবিতে আসতে থাকে ফোন। কান্নাকাটি করে দুবাইয়ের এক ব্যাংকে ১০ লাখ টাকা পাঠানোর কথা বলে বিজয়। গত বছরের ২৮ মে লিবিয়ায় ২৬ জনকে হত্যার পর থেকে আর তার খোঁজ মিলছে না। নিহত বা আহতদের তালিকায়ও নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি বিজয়ের। পরবর্তীতে সংবাদ মাধ্যমে পরিবারের স্বজনরা জানতে পারে জাফরকে ইতালিতে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বিজয়ের বাবা আশেক মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জাফরকে দেশে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আমার ছেলের সন্ধান মিলবে। আমি পাগলের মতো হয়ে গেছি। চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বিজয় সবার ছোট। আমাদের অনেক আদরের সন্তান ছিল সে। ভেবেছিলাম ইতালি যেতে পারলে আমার ছেলের অনেক ভালো হবে। সামনে যে এত বড় বিপদ আমরা তা বুঝতেই পারিনি। 

ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুবনা ফারজানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিখোঁজ দুই জনের স্বজনরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমি গুরুত্বসহকারে তাদের ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে লিবিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশের নিযুক্ত কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়েছি। বেশ কয়েকবার লিবিয়ায় যোগাযোগ করেছি। এখন পর্যন্ত তাদের বিষয়ে কোনও খোঁজ মেলেনি। আমরা যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। পরিবারগুলোরও খোঁজ রাখা হচ্ছে বলে জানান তিনি। 

 

/টিটি/
সম্পর্কিত
‘বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রণোদনা ৩ শতাংশ বিবেচনা করা হবে’
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
সিঙ্গাপুরে রডচাপায় বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যু
সর্বশেষ খবর
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ