X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

নৌকায় বিদ্যালয়, হলো সূর্যোদয়

বিজয় রায় খোকা, কিশোরগঞ্জ
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:০১আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:০১

হামিদপল্লীর শিশুদের প্রায় সবাই দরিদ্র পরিবারের। বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের কাজকর্মও করতে হয়। বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয় না। তবে তারাও পড়তে চায়। আছে বড় হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু পরিবারের সামর্থ্য না থাকায় এবং হাওরের প্রতিকূল পরিবেশে তা অনেক সময় হয়ে ওঠে না। এ অবস্থায় এসব শিশুর শিক্ষাবঞ্চনা দূর করতে অভিনব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদ্যোগটি সূর্যোদয়ের মতো আশাবাদী করেছে তাদের। শিক্ষার সব আয়োজন নিয়ে তাদের বাড়ির ঘাটে হাজির হয়েছে অন্যরকম স্কুল। যার নাম ভাসমান বিদ্যালয়। সেখানে চলছে স্বপ্নপূরণের পাঠ। নৌকায় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে সুবিধাবঞ্চিত ও ঝরেপড়া কয়েকশ শিশু।

নৌকায় সাজানো ভাসমান বিদ্যালয়টির অবস্থান হামিদপল্লীর ঘাটে। এটি কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা মিঠামইনের একটি গ্রাম। গ্রামের শিশুরা এখন এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামটিতে দুই হাজার মানুষের বসবাস। যোগাযোগ ব্যবস্থা নৌকানির্ভর। দ্বীপের মতো গ্রামটিতে নেই কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আশপাশের বিদ্যালয়গুলো অনেক দূরে। সামর্থ্য ও নিরাপত্তার কথা ভেবে সেখানে শিশুদের দিতে চান না অভিভাবকরা। ফলে শিক্ষাবঞ্চনা নিয়ে বেড়ে উঠছিল গ্রামের শিশুরা।

নৌকায় সাজানো ভাসমান বিদ্যালয়টির অবস্থান হামিদপল্লীর ঘাটে

হামিদপল্লীর শিশুরা এখন শিখনকেন্দ্রে মনের আনন্দে পড়ছে এবং শিখছে। রোজ নিয়ম করে সময়মতো বিদ্যালয়ে যায়। অনন্দঘন পরিবেশে রপ্ত করছে বাংলা-ইংরেজি বর্ণমালা। আগ্রহী হয়ে উঠেছে বই পড়ায়। নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা ও খেলাধুলায় বিনোদন পাচ্ছে শিশুরা। 

উদ্যোক্তারা বলছেন, পরবর্তীতে এসব শিশু যুক্ত হবে মূলধারার লেখাপড়ায়। তখন তাদের স্বপ্নপূরণ হবে। একদিন তারাও দেশের জন্য অবদান রাখবে। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি সংস্থা ঢাকা আহছানিয়া মিশন ২০১৭ সাল থেকে অভিনব এই শিক্ষাকার্যক্রম চালাচ্ছে। তখন এই কার্যক্রমে সহযোগিতা দেয় রিচ আউট টু এশিয়া (রোটা)। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের রিড ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোগিতায় শিক্ষাকার্যক্রমটি চলমান রেখেছে তারা। 

এই শিক্ষাকার্যক্রমের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর এবিএম শাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে হাওরের মিঠামইন উপজেলায় দুটি ভাসমান নৌকায় স্কুল ও ১০টি হাটভিত্তিক শিশু শিখন কেন্দ্রে ৪২০ শিশু পড়াশোনা করছে। ভাসমান স্কুলে দুই পর্বে লেখাপড়া চলছে। শুধু হামিদপল্লী নয়, আশপাশের গ্রামের শিশুরাও এখানে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বর্ষায় নৌকা দিয়ে তাদের স্কুলে নিয়ে আসা হয়। ছুটির পর আবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে শুকনো মৌসুমে শিশুদের স্কুলে আসা-যাওয়া কিছুটা সহজ হয়। স্কুল চলাকালীন শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা ও যত্ন নেওয়ার আলাদা লোক রয়েছে। দৈনিক তিন ঘণ্টা করে ক্লাস চলে। উপজেলার ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সী ঝরেপড়া শিশু-কিশোরদের মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করছি আমরা।’

গ্রামের শিশুরা এখন এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

ভাসমান বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. রাব্বি জানায়, এখানে পড়তে খুব ভালো লাগে আমার। সবচেয়ে ভালো লাগে ছবি আঁকতে। লেখাপড়া করে পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন দেখি। আগে পড়ার সুযোগ ছিল না, এখন পড়ছি। 

একই কথা জানিয়ে আট বছরের তাসমি আক্তার জানায়, এই বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলা হয়। এটি আমার অনেক পছন্দের। তাই প্রতিদিন স্কুলে যাই। 

কয়েকজন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক জানিয়েছেন, তাদের বিদ্যালয়ে আনন্দের সঙ্গে খেলার ছলে পড়ালেখা শেখানো হয়। এজন্য তাদের বিদ্যালয় খুব ভালো লাগে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সময়ের আগেই বিদ্যালয়ে চলে আসে। এতদিন এমন একটি বিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখেছিল গ্রামের শিশু ও অভিভাবকরা।

আমাদের গ্রামে কোনও বিদ্যালয় নেই জানিয়ে হামিদপল্লীর বাসিন্দা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘গ্রাম থেকে বিদ্যালয়গুলো অনেক দূরে। তাই ইচ্ছে থাকার পরও সন্তানকে বিদ্যালয়ে দিতে পারি না। এখন বাড়ির পাশের ঘাটে স্কুল এসেছে। অন্তত প্রাথমিক পর্যন্ত লেখাপড়া নিয়ে যে দুশ্চিন্তা ছিল, তা দূর হয়েছে।’

শিশুরা মনের আনন্দে পড়ছে এবং শিখছে উল্লেখ করে ভাসমান বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের শিশুদের অভিভাবকরা এতটাই গরিব যে, খরচপাতি করে সন্তানদের পড়ানোর সামর্থ্য নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খরচ না থাকলেও সেগুলো অনেক দূরে হওয়ায় পড়তে যায় না শিশুরা। এজন্য বাড়ির কাছে ভাসমান বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে মজা পাচ্ছে তারা। তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয়। প্রতিটি শিশুর আগ্রহের প্রতি খেয়াল রাখা হয়। আগ্রহের ওপর ভিত্তি করে পড়ালেখা করানো হয়। এ কারণে তারা বিরক্ত হয় না, বরং আনন্দ নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।’

হামিদপল্লীর শিশুরা এখন শিখনকেন্দ্রে মনের আনন্দে পড়ছে এবং শিখছে

এটিকে প্রশংসনীয় উদ্যোগ উল্লেখ করে মিঠামইন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. এরশাদ মিয়া বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার যোগ্য সব শিক্ষার্থীর সরকারি স্কুলে যাওয়া কথা। এরপরও নানা কারণে কিছু শিশু বাদ পড়ে যায়। ওসব শিশুকে পড়াশোনার যে আয়োজন করা হয়েছে, তা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে যে এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।’

এই জাতীয় প্রতিষ্ঠান আরও বাড়ানো হবে জানিয়ে ঢাকা আহছানিয়া মিশনের শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ঢাকা আহছানিয়া মিশনের শিক্ষা বিভাগ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাসেবা প্রদানে নিরলসভাবে কাজ করছে। ভবিষ্যতে এই কার্যক্রম চলমান থাকবে এবং প্রতিষ্ঠান আরও বাড়বে।’

/এএম/
সম্পর্কিত
শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষায় মনোযোগ দিতে হবে: বিডিইউ উপাচার্য
ক্লাসে ফিরেছে শিক্ষার্থীরা, ক্ষতি পোষাতে বদ্ধপরিকর শিক্ষকরা
আইইএলটিএস দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়া নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত
সর্বশেষ খবর
গেজেট প্রকাশের পর আ.লীগের নিবন্ধন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি
গেজেট প্রকাশের পর আ.লীগের নিবন্ধন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি
বিশ্বশান্তি কামনায় বুদ্ধপূর্ণিমা উদযাপন
বিশ্বশান্তি কামনায় বুদ্ধপূর্ণিমা উদযাপন
দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা জুলাই আহতদের
দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা জুলাই আহতদের
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন জুলাইযোদ্ধা দুর্জয়
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন জুলাইযোদ্ধা দুর্জয়
সর্বাধিক পঠিত
জরুরি বৈঠক ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা
জরুরি বৈঠক ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা
লঞ্চঘাটে তরুণীদের প্রকাশ্যে মারধর, যুবক বললেন ‘ভাই হিসেবে মেরেছি’
লঞ্চঘাটে তরুণীদের প্রকাশ্যে মারধর, যুবক বললেন ‘ভাই হিসেবে মেরেছি’
আরও কমলো স্বর্ণের দাম
আরও কমলো স্বর্ণের দাম
যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ
যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ
বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ
বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ