X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সমান কাজ করে পুরুষের অর্ধেক মজুরি পান নারী শ্রমিকেরা

এনায়েত করিম বিজয়, টাঙ্গাইল
০৮ মার্চ ২০২৪, ০৫:৩৫আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৪, ০৫:৩৫

‘আমরা গরিব মানুষ। পেটে ভাত না থাকলে নারী দিবস দিয়ে কী হবে। নারী দিবস কী তাও জানি না। আমরা নারী শ্রমিকেরা প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আমরাও তো মানুষ। তাহলে কেন আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়?’ এভাবেই কথাগুলো বললেন টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার বেড়বাড়ি গাজীর দোকান এলাকার জেবিএম ইটভাটার শ্রমিক নূর নাহার (৩৫)।

নূর নাহার কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার বাসিন্দা দিনমজুর আমিনুর ইসলামের স্ত্রী। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নূর নাহার ছাড়াও এই ইটভাটায় কাজ করছেন মনিকা বেগম (৪০), বিউটি আক্তার (২৪), শাহিনা বেগম (২৫), লিপি খাতুন (২২), আফিয়া খাতুন (৪০) ও আমেনা বেগমসহ (৩৩) বেশ কয়েকজন নারী শ্রমিক।

অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হয় নূর নাহারের। সংসারে অভাব-অনটন থাকায় স্বামীর সঙ্গে প্রায় ৮ বছর আগে শ্রমিকের কাজ শুরু করেন তিনি। তার এক মেয়ে দুই ছেলে। ওই ইটভাটায় তিনি স্বামীর সঙ্গে শ্রমিকের কাজ করছেন।

নূর নাহার বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। কোনদিক দিয়ে কোন দিবস যায়, আমরা বলতে পারবো না। গরিব মানুষের আবার কীসের দিবস। নারী দিবসের কথা কখনো শুনিনি। আজ প্রথম শুনলাম। একদিন বসা থাকলে সংসার চলবে না। আমরা নারীরা সর্বক্ষেত্রে অবহেলিত। পুরুষের চেয়ে আমরা কাজ কম করি না। তবুও পুরুষদের চেয়ে আমাদের নারী শ্রমিকদের মজুরি কম দেওয়া হচ্ছে। আমাদের সঙ্গে কেন বৈষম্য করা হয়?’

বৈষম্য নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে কাজ হারাতে নারী শ্রমিকদের

নূর নাহারের স্বামী আমিনুর ইসলাম বৈষম্যের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘প্রত্যেকটা ইটভাটায় নারী শ্রমিকদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়। পুরুষ শ্রমিকের মজুরি ৬০০ টাকা থাকলে নারী শ্রমিকের থাকে ৩০০-৩৫০ টাকা। নারী শ্রমিকের চেয়ে পুরুষ শ্রমিক খুব একটা বেশি কাজ করে না। প্রায় সমান সমান কাজ করে নারী শ্রমিকেরা। তবুও তাদের সঙ্গে এই বৈষম্য করা হচ্ছে। প্রতিবাদ করতে গেলে নারী শ্রমিকেরা কাজ পাবে না।’

একই ইটভাটায় স্বামী উকিল মিয়া ও তিন ছেলেকে নিয়ে কাজ করেন মনিকা বেগম নামের আরেক শ্রমিক। তিনি প্রায় ১৫ বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করছেন। হতদরিদ্র পরিবারে বিয়ে হওয়ায় সংসারের হাল ধরতে স্বামীর সঙ্গে ইটভাটায় কাজ শুরু করেন তিনি। নারী দিবস সম্পর্কে তার কিছুই জানা নেই।

মনিকা বেগম বলেন, ‘অভাব-অনটনের সংসার হওয়ায় স্বামীর সঙ্গে শ্রমিকের কাজ করছি। আমরা গরিব মানুষ। কোনও দিবসের কথা আমাদের জেনে কী হবে। টাকা কামাই, সংসার চালাই—এটাই আমাদের দিবস। প্রত্যেকটা দিবসের আগে আমাদের নারী শ্রমিকদের বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। আমরা নারীরা প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। সর্বক্ষেত্রে নারী শ্রমিকেরা বেতন-ভাতা পুরুষদের চেয়ে কম পাচ্ছে। আমরা নারী শ্রমিকেরা পুরুষদের চেয়ে খুব একটা কাজ কম করি না। পুরুষদের মজুরি থাকে ৮০০ টাকা আর আমাদের নারীদের শ্রমিকের মজুরি থাকে সাড়ে ৩০০-৪০০ টাকা। আমাদের সঙ্গে কেন এত বৈষম্য করা হয়?’

একই ভাটায় কাজ করেন সুনামগঞ্জ জেলার বাসিন্দা আফিয়া খাতুন (৪০)। তিনি স্বামী আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে প্রায় ১৫ বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করছেন।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস সম্পর্কে জানেন না তারা

আন্তর্জাতিক নারী দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে আফিয়া খাতুন বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ কোনও দিবসের খোঁজখবর রাখার মতো সময় নেই। কেউ কখনও নারী দিবসের কথা বলেনি। আপনার (সাংবাদিক) মুখে এই প্রথম শুনলাম নারী দিবসের কথা। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এই দিনে সরকারিভাবে ছুটি দেওয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছি। এই দিনে সরকারিভাবে ছুটি (কাজ বন্ধ) থাকলে সবাই জানতে পারবে দিনটি সম্পর্কে। তবে বেতন কাটলে ছুটির দরকার নেই। একদিন কাজ না করলে পেটে ভাত যাবে না।’

আমেনা বেগম (৩৩) নামের অপর এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘আমরা নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। পুরুষদের চেয়ে আমাদের নারী শ্রমিকদের মজুরি কম দেওয়া হচ্ছে। পুরুষ মানুষ পান-সিগারেট খাওয়ার জন্য গিয়ে প্রায় ১৫/২০ মিনিট দেরি করে। আমরা নারীরা জরুরি কাজ ছাড়া কাজ বাদ দিই না। তবুও আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়। ইটভাটায় প্রোডাকশনে কাজ করলে পুরুষের সমান টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু মালিকের অধীনে শ্রমিকের কাজ করলে পুরুষের চেয়ে টাকা কম দেয়। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করলে মালিকে কাজ দেবে না। এজন্য আমরা নারীরা বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করি না। নারীদের মজুরি বাড়ানো প্রয়োজন।’

তিনি আরও বলেন, ‘নারীদের জন্যও একটি বিশেষ দিবস আছে, কথাটি শুনে ভালোই লাগলো। এই দিনে সরকারিভাবে ছুটি থাকলে ভালোই হতো। মাঠপর্যায়ে নারী দিবসের কথা সব নারীকে জানানো উচিত। আমার মতো অনেকে দিবসটির কথা জানে না। নারী দিবসের কথা প্রত্যেক নারীকে জানানো প্রয়োজন। এজন্য যার যার কর্মস্থলে বা প্রত্যেক এলাকায় নারী দিবসের অনুষ্ঠান করা দরকার। এতে নারীদের গুরুত্ব বাড়বে।’

একই ইটভাটায় কাজ করেন শ্রমিক চাঁন মিয়া। তিনি বলেন, ‘নারী শ্রমিকেরা পুরুষদের প্রায় সমান কাজ করেন। তবে ভারী কাজ করতে কিছুটা সমস্যা হয় নারীদের। একজন পুরুষ কাজে এসে পান-সিগারেট ও চা খেয়ে যে সময় পার করেন, সে তুলনায় নারীরা অনেক ভালো। সামান্য ব্যবধানের জন্য নারী শ্রমিকদের মজুরি কমানো ঠিক না।’

নারী দিবসের কথা প্রত্যেক নারীকে জানানো প্রয়োজন

জেবিএম ইটভাটায় সরেজমিনে গিয়ে নারী শ্রমিকের সংখ্যা জানতে চাইলে ভাটাটির মালিক জয়নাল বিষয়টি এড়িয়ে যান। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীদের নিয়ে খবর প্রকাশের কথা জানালে তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে, ওই দিকে যান। গিয়ে দেখেন কয়জন নারী আছে।’ এরপর কয়েকজন নারীর সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেরার পর ইটভাটার মালিককে তার অফিসকক্ষে পাওয়া যায়নি।

বাসাইল উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদা সুলতানা রুবি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন গার্মেন্টস, কারখানা ও ইটভাটাসহ বিভিন্ন জায়গায় নারীরা শ্রমিকের কাজ করছেন। তবে নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। নারী শ্রমিকরা পুরুষের প্রায় সমান কাজ করেন। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও বেশি সচেতনতা তৈরিতে আগ্রহী করতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষিত নারী সমাজ মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। নারী দিবসে তাদের অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম, সেটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রান্তিক নারীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করলে তারা আরও সচেতন হবেন। সেই সঙ্গে নারী দিবস ও তাদের অধিকার এবং মর্যাদা সম্পর্কে জানতে পারবেন তারা।’

ভারী কাজ করতে কিছুটা সমস্যা হয় নারীদের

জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) কণিকা মল্লিক বলেন, ‘দিবসটি উপলক্ষে জেলা সদর ও প্রত্যেকটি উপজেলায় আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। মাঠপর্যায়ে প্রান্তিক নারীদের দিবসটি সম্পর্কে জানানোর জন্য কাজ করছি আমরা। নারীরা এখন বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কাজ করছেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো, এখনও নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এই বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরাও এটি নিয়ে কাজ করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘নারীদের বিভিন্নভাবে সচেতন, নারী ক্ষমতায়নসহ স্বাবলম্বী করার জন্য কাজ করছি। এখন হাতের মুঠোয় সব পাওয়া যায়। হয় তো কিছুসংখ্যক নারী দিবসটি সম্পর্কে জানে না। এখন নারীরা অনেককিছুতেই অবগত আছেন। আমাদের মন্ত্রণালয়ে “তথ্য আপা” আছে, তাদের কাজই হলো তৃণমূল পর্যায়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নারীদের সচেতনতাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা।’

/কেএইচটি/
সম্পর্কিত
নারীদের সম-অধিকার ও সমসুযোগ নিশ্চিতে বিনিয়োগ করতে হবে: স্পিকার
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালিত
আইইউবিতে ‘নেতৃত্বে নারী’ বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠান
সর্বশেষ খবর
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু