২০২১ সালের ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড লিমিটেডের সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৫৪ শ্রমিক-কর্মচারী প্রাণ হারিয়েছেন। আগুনে পুড়ে আহত হয়েছেন আরও ৩৮ শ্রমিক। এই ঘটনায় করা মামলায় আট জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। পরে দীর্ঘ দুই বছর চার মাস পর ২০২৩ সালের ২১ নভেম্বর কারখানার মালিক ও তার চার ছেলেকে বাদ দিয়ে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। তবে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মৃতের স্বজনরা।
জানা গেছে, ঘটনার দিন বিকালে রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানার ছয়তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন দেখে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিন জনের মৃত্যু হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ১৯ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে আগুনে পুড়ে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। পরে ভবনের তিন ও চার তলা থেকে মাথার খুলি, চুল ও হাড় উদ্ধার করে। ডিএনএ পরীক্ষা করে সেখানে তিন জনের লাশ ছিল বলে নিশ্চিত করে সিআইডি। তারা সবাই ওই কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারী।
এ ঘটনায় তৎকালীন ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাসেমসহ আট জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলায় নিরাপত্তা না থাকাসহ বিভিন্ন অবহেলার অভিযোগ আনা হয়।
পরদিন সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম, তার ছেলে হাসীব বিন হাসেম ওরফে সজীব, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম, তানজীম ইব্রাহীম, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ আজাদ, হাসেম ফুড লিমিটেডের ডিজিএম মামুনুর রশিদ ও অ্যাডমিন প্রধান সালাউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়। ১০ জুলাই তাদের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খাতুন। রিমান্ড শেষে তাদের আদালতে হাজির করলে জামিন মঞ্জুর করেন বিচারক। এরপর মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এ ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছিল জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কারখানাটি ভবন নির্মাণ নীতিমালা (বিল্ডিং কোড) না মেনেই তৈরি করা হয়েছিল। কারখানায় পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র কিংবা ফায়ার সার্ভিসের নো অবজেকশন সার্টিফিকেটও (এনওসি) ছিল না বলে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাইন বিল্লাহ জানিয়েছেন। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস তাদের তদন্ত প্রতিবেদন সিআইডির কাছে জমা দিলেও সেখানে কী উল্লেখ করা হয়েছে, তা জানানো হয়নি।
এদিকে ২০২৩ সালের ২১ নভেম্বর হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় মালিক ও চার ছেলেকে বাদ দিয়ে দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছে নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কাজী মোহসীনের আদালত।
হাসেম ফুড কারখানার মালিক এম এ হাসেম (৭০), তার ছেলে হাসীব বিন হাসেম ওরফে সজীব (৩৯), তারেক ইব্রাহীম (৩৫), তাওসীব ইব্রাহীম (৩৩), তানজীম ইব্রাহীমকে (২১) বাদ দিয়ে ছয় জনকে আসামি করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ছয় আসামি হলেন- কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ আজাদ, উপ-মহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশীদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন, প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক) ওমর ফারুক এবং কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের পরিদর্শক নেছার উদ্দিন ও সৈকত মাহমুদ।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-৪ এর সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর বিউটি আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মামলাটি চার্জ গঠনের জন্য আদালতে রয়েছে। সেজান জুস কারখানার মালিক ও তার ছেলেদের নাম বাদ দিয়ে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মামলার ছয় জন আসামি জামিনে রয়েছেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার উপমহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র ঘোষ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মৃত ৫৪ জনের পরিবারের সদস্যদের দুই লাখ টাকা করে এবং আহত ৩৮টি পরিবার সদস্যদের ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দাবি করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের পক্ষ থেকে লেবার কোর্টে ৫১টি মামলা হয়েছে। তবে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার আট দিন আগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর নারায়ণগঞ্জের শ্রম পরিদর্শক নেছার উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করেন। প্রতিষ্ঠানের ভবন ও অগ্নিঝুঁকি থাকার ফলে শ্রম আইনের ৯টি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে কারখানার মালিক এম এ হাসেম ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মামুনুর রশিদকে আসামি করে ঢাকার শ্রম আদালতে মামলাটি করা হয়। মামলাটি চলমান রয়েছে। তবুও কেন পুলিশের করা মামলায় আমাদের দুজন পরিদর্শককে আসামি করা হয়েছে তা জানা নেই।
অগ্নিকাণ্ডের পরে কারখানাটির লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারখানার যে ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেই ভবনটি এখনও সিলগালা অবস্থায় রয়েছে। তবে কারখানাটির অন্য সব ভবনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মালিকপক্ষ তাদের মতো করে কারখানার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত তাদের লাইসেন্সের নবায়ন করা হয়নি। এরপরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলে মামলাটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে আসামির তালিকা থেকে কারখানার মালিক ও তার ছেলেদের নাম বাদ দেওয়ার ঘটনায় মৃতের স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মৃত শ্রমিক আশামনির মা শিমু বেগম বলেন, এই ঘটনায় সাড়ে চার লাখ টাকা পেয়েছি। কারখানার মালিকপক্ষ ও সরকারিভাবে টাকা পেয়েছি। আমি এখন অসুস্থ। যে কারণে মামলার বিষয়ে খোঁজ রাখতে পারি না। তবে মামলা থেকে মালিকপক্ষের নাম বাদ পড়ে কীভাবে? এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
নিহত খাদিজা আক্তারের মা সুফিয়া বেগম বলেন, সুষ্ঠু বিচার পেলে মেয়ের আত্মা শান্তি পেতো। মামলা থেকে সেজান জুস কারখানার মালিক ও তার ছেলেদের নাম বাদ দিয়েছে। টাকা দিয়ে তারা অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু বিচার একদিন ঠিকই হবে।
এ বিষয়ে সজীব গ্রুপের এজিএম (অ্যাডমিন) ক্যাপ্টেন (অব.) মো. মামুনুর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিহতের স্বজনদের তিন দফায় দুই লাখ ৭৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ঈদের সময়ে ঈদ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পবিবারের খোঁজ রাখা হচ্ছে।
কারখানার কার্যক্রম সচল রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, কারখানার পুড়ে যাওয়া ভবনটি বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া বাকি ভবনের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আইন মেনে কারখানার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কলকারখানাসহ কারও কোন অনাপত্তি নেই।
মামলার চার্জশিট থেকে কারখানার মালিক ও তার ছেলেদের নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা এটা আইনি প্রক্রিয়া। মামলা পর্যালোচনা ও তদন্ত করে সিআইডি তাদের নাম বাদ দিয়েছে।