নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে পাঁচ জনের মৃত্যুর ৮৫ দিন পর নাম-পরিচয় শনাক্ত করেছে রেলওয়ে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী রেলওয়ে ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ তদন্তে নেমে তাদের পরিচয় উদ্ধার করেন। বৃহস্পতিবার (০৩ অক্টোবর) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভৈরব রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলীম হোসেন শিকদার।
গত ৮ জুলাই সকালে রায়পুরা উপজেলার মেথিকান্দা রেলস্টেশন-সংলগ্ন কমলপুর এলাকার রেললাইন থেকে ট্রেনে কাটা পড়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পাঁচ জনের লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ। ১৫ গজ দূরত্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল লাশগুলো। তিন জনের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন ছিল, দুজনের শরীর ছিল দ্বিখণ্ডিত। তাদের ডিএনএ ও ভিসেরা টেস্টের জন্য উদ্ধার করা আলামত ঢাকায় পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে নরসিংদী রেলওয়ে কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়।
ওই পাঁচ জন হলেন- রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার তালতলা মার্কেটের নিচতলার গলিতে ভিক্ষাবৃত্তি করা মো. সেলিম (২৫), একই গলির ভাসমান টোকাই রাব্বি মিয়া (১৫) ও আল আমিন (১২) এবং কমলাপুর পদচারী সেতু এলাকার ভাসমান টোকাই আবদুল্লাহ সাব্বির (১৬) ও সিয়াম মিয়া (১৪)।
রেলওয়ে পুলিশ বলছে, পাঁচ জনের মধ্যে সেলিমের বাড়ি কোথায়, তা জানা যায়নি। রাব্বির বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুরে, আল আমিনের বাড়ি ময়মনসিংহ বাসস্ট্যান্ড এলাকায়, আবদুল্লাহ সাব্বিরের বাড়ি সিলেটের হজরত শাহ জালাল (রহ.) এর মাজার-সংলগ্ন কুমারপাড়া গ্রামে ও সিয়ামের বাড়ি কুলাউড়া রেলস্টেশন এলাকায়।
নরসিংদী রেলওয়ে ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, পাঁচ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় কোনও প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। তাদের কেউ মোবাইল ব্যবহার করতো না। তাদের কারও জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল না। পরিচয় উদ্ধারের জন্য লাশের ছবি ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের সব রেলস্টেশনে পাঠানো হয়। তদন্তের একপর্যায়ে টঙ্গী রেলস্টেশনে গেলে রিফাত (১২) নামের এক টোকাই তাদের চিনতে পারে। ওই রিফাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিহতদের পরিচিত আরও কিছু টোকাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তাদের নাম-পরিচয় ও ঘটনার বিস্তারিত জানা যায়। রিফাতই পুলিশকে জানায়, ঘটনার দিন ওই পাঁচ জনের সঙ্গে ফয়েজুর (১২) নামের আরেকজন ছিল।
তিনি বলেন, ফয়েজুরকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে জানায়, ৭ জুলাই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে রাত ৯টার দিকে তারা ছয় জন মিলে ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার উদ্দেশে রওনা হয়। নরসিংদী রেলস্টেশনে ট্রেনটি যাত্রাবিরতি দিলে ফয়েজুর নেমে যায়। এর পরের কিছু সে জানে না বলে জানায়। তবে খিলগাঁওয়ের তালতলা মার্কেট এলাকার আরেক টোকাই আরিফুল দুর্ঘটনার সময় ট্রেনের পাশের বগির ছাদে অবস্থান করছিল বলে জানা যায়। জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আরিফুল জানায়, চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী একটি ট্রেনের ছাদে বসে ঢাকায় ফিরছিল সে। আখাউড়া স্টেশনে নেমে সে ওই পাঁচ জনকে গাঁজা সেবন করতে দেখে। পরে দিবাগত রাত পৌনে ১টায় ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা নোয়াখালী এক্সপ্রেস ট্রেনের ৩ নম্বর বগির ছাদে আরিফুল ও ২ নম্বর বগির ছাদে ওই পাঁচ জন চেপে বসে। দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আরিফুল জানায়, গাঁজা খেয়ে ট্রেনের ছাদে উঠার পরও তারা পলিথিনের ভেতরে ড্যান্ডি ঢুকিয়ে নেশা করছিল। মেথিকান্দা রেলস্টেশন পার হওয়ার পরই নেশাগ্রস্ত সেলিম ছাদ থেকে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল। তাকে বাঁচাতে হাত বাড়িয়ে টেনে তোলার চেষ্টা করে রাব্বি, আর রাব্বিকে ধরে রেখেছিল বাকি তিন জন। কিন্তু সামলাতে না পেরে পাঁচ জন একসঙ্গেই রেললাইনে ছিটকে পড়ে মারা যায়।
ভৈরব রেলওয়ে থানার ওসি মো. আলীম হোসেন শিকদার বলেন, তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। দুর্ঘটনার বিস্তারিত ও নিহত পাঁচ জনের মধ্যে দুজনের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ও তিন জনের শুধু নাম জানতে পেরেছি আমরা। নিহতদের মধ্যে চার জন টোকাই ছিল আর একজন ভিক্ষাবৃত্তি করতো। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ঢাকাগামী নোয়াখালী এক্সপ্রেস ট্রেনের ছাদ থেকে একসঙ্গে ছিটকে পড়ে ওই ট্রেনে কাটা পড়েই পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছিল।