মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে এক্সপ্রেসওয়েতে গুলিতে নিহত শাহিদা আক্তার (২২) আদৌ অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন কী ছিলেন না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। শাহিদার কথিত প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়ের দাবি, অন্তঃসত্ত্বা দাবি করে বিয়েতে চাপ দেওয়ায় পরিকল্পিতভাবে শাহিদাকে গুলি করে হত্যা করে মুক্তি পেতে চেয়েছিল।
তবে নিহত শাহিদার মায়ের দাবি, তার মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা ছিল না। মেয়ের নিয়মিত মাসিকের বিষয়ে তিনি অবহিত। নিজেকে বাঁচাতে শাহিদাকে অন্তঃসত্ত্বা বলে মিথ্যা দাবি করছে তৌহিদ।
এ ব্যাপারে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. শামসুল আলম সরকার বলেছেন, ‘ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই আসলে এটি নিশ্চিত করে বলা যাবে। এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত কথিত প্রেমিকের বক্তব্য ছাড়া এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। তবে পুরো ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ।’
নিহত শাহিদা ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বেগুনবাড়ির বরিবয়ান এলাকার মৃত আবদুল মোতালেবের মেয়ে। তিনি ঢাকার ওয়ারী থানার যুগিনগর এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। গ্রেফতার তৌহিদ শেখ ওয়ারীর বনগ্রাম এলাকার মৃত শফিক শাহের ছেলে। ঘটনার পর থেকে এখনও তৌহিদের বিষয়ে খোঁজ নিতে স্বজনরা থানায় আসেননি বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন তার মা ও বোন।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিকাল ৩টার দিকে মুন্সীগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুলফিকার হোসাইন রনির কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় তৌহিদ। একই দিন সকালে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তৌহিদ জানিয়েছিল, রাজধানীর ওয়ারী থানা থেকে লুট করা অস্ত্র দিয়ে তৌহিদ নিজেই শাহিদাকে গুলি করে হত্যা করেছে। আর অস্ত্রটি লুট করে নেওয়ার পর ইউটিউবে ভিডিও দেখে পিস্তল চালানো শিখেছিল।
মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার শামসুল আলম সরকার সাংবাদিকদের বলেন, ‘শাহিদাকে গুলি করে হত্যার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে তৌহিদ। আমরা তাকে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তৌহিদ আমাদের জানিয়েছে, তার সঙ্গে শাহিদার দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। শাহিদা তৌহিদকে বলেছিলেন, তিনি আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এ কথা শোনার পর সাম্প্রতিক সময়ে শাহিদাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছিল। এর মধ্যে তৌহিদ তার পরিবারের পছন্দের অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিষয়টি শাহিদা জানতে পেরে তৌহিদকে বিয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাহিদাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। তৌহিদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গত শুক্রবার রাতে শাহিদাকে কল করে ওয়ারীর বাড়ি থেকে মাওয়ায় ইলিশ খাওয়ার কথা বলে ডেকে নেয়। শাহিদাকে নিয়ে খাওয়াদাওয়া শেষে রাতভর মাওয়া এলাকায় ঘোরাঘুরি করেছিল। শনিবার ভোরে শ্রীনগর দোগাছি এলাকার এক্সপ্রেসওয়েতে শাহিদাকে নিয়ে আসে। সেখানেই তার সঙ্গে থাকা ওয়ারী থানা থেকে লুট করা পিস্তল দিয়ে শাহিদাকে গুলি করে হত্যা করে। হত্যার পর দোগাছি এলাকা থেকে ঢাকায় পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার আগে পিস্তলটি কেরানীগঞ্জের বটতলী বেইলি সেতুর নিচে ফেলে দেয়। রবিবার তৌহিদ আত্মগোপনে ছিল। তার পরিবারের লোকজনের সহযোগিতায় সোমবার রাতে ঢাকা থেকে লঞ্চে করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। গভীর তদন্ত ও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা বিষয়টি জানতে পারি। পরে ভোলার ইলিশাঘাট এলাকায় লঞ্চের কেবিনের ভেতরে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।’
তবে শাহিদা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন বলে তৌহিদ যে দাবি করেছে, তাকে মিথ্যা বলছেন শাহিদার মা জরিনা খাতুন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাঁচ-ছয় বছর আগে তৌহিদের ছোট বোন স্মৃতির সঙ্গে আমার মেয়ের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এরপর থেকে আমার মেয়ে প্রায়ই তাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতো। তৌহিদের বোনও আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতো। শাহিদা ও স্মৃতি একসঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যেতো।’
জরিনা খাতুন বলেন, ‘ওদের বাড়িতে যাওয়া-আসা দেখে প্রায় বছরখানেক আগে আমার সন্দেহ হলে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করি। তখন তাদের মধ্যে কোনও রকমের সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করেছিল। তিন মাস আগে আমার বাসার সামনের সড়কে মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয় তৌহিদের। সে আমার মেয়েকে মারধর করেছিল। ওই সময় তাদের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পারি। তখন মেয়েকে মারধরের কারণ জানতে চাইলে আমাকেও মারধর করেছিল। এরপর বিষয়টি এলাকার গণ্যমান্য লোকজনকে জানিয়ে তাদের কাছে বিচার দিলে আমাকে শাসিয়ে চলে যায়। তারপর কিছুদিন মেয়েকে বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিই।’
এরপরও তৌহিদ সারাদিন শাহিদার মোবাইলে কল দিয়ে বিরক্ত করতো উল্লেখ করে জরিনা বলেন, ‘প্রায় দুই মাস আগে আমাদের অজান্তে মেয়েকে ফুসলিয়ে চাঁদপুরে নিয়ে যায় তৌহিদ। পরে শুনেছি, সেখানে নেশা করে মেয়েকে মারধর করেছিল। সেখানকার এলাকাবাসী তাদের দুজনকে আটক করে পুলিশে দেয়। পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে তার বোন স্মৃতি ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। পরে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে ছেলের পরিবার রাজি হয়নি। উল্টো আমার মেয়েকে তৌহিদের বোন ও মা ফোন করে হুমকি দেয়। তারা আমার মেয়ের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করে বলেছিল, টাকা দিলে বিয়ে হবে। আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই। এত টাকা কই পাবো? তৌহিদ ও তার পরিবার বলেছিল, বিয়ের কথা বললে আমার মেয়েকে মেরে ফেলবে। শেষ পর্যন্ত মেরেই ফেললো।’
তৌহিদ যে দাবি করেছে শাহিদা অন্তঃসত্ত্বা ছিল, তা মিথ্যা জানিয়ে জরিনা খাতুন বলেন, ‘তৌহিদ বাঁচার জন্য এখন এসব কথা বলছে। আমার মেয়ের শারীরিক বিষয়ে আমি জানি। কয়েকদিন আগে তৌহিদ তার পরিবারের পছন্দের একটি মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এতে বাধা ছিল আমার মেয়ে। এজন্য নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। আমি চাই তৌহিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।’
শাহিদার ভাই মো. জসিম জানান, তার বোন রাজধানীর বলধা গার্ডেনের পাশের এক আত্মীয়ের ছেলেমেয়েদেকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়ার কাজ করতেন। শুক্রবার রাত ১১টার দিকে ওই আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়। বোনের সঙ্গে ওই যুবকের সম্পর্কের বিষয়টি জানা ছিল না তার।
পুলিশ জানায়, পরদিন শনিবার দুপুরে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের সমসপুর এলাকার দোগাছি সার্ভিস সড়ক থেকে শাহিদার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের পাশে কয়েকটি গুলির খোসা পড়ে ছিল। তার শরীরে আটটি গুলির ছিদ্র ছিল। লাশ উদ্ধার করে শ্রীনগর থানায় নেওয়ার পর শাহিদার মোবাইলে তার মা জরিনার মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়। পুলিশের কাছে খবর পেয়ে ওই দিন বিকালে থানায় এসে মেয়ের লাশ শনাক্ত করেন মা।
এ ঘটনায় শনিবার রাতে জরিনা খাতুন বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। রবিবার সকালে ওই মামলায় এজাহারভুক্ত একমাত্র আসামি করা হয় তৌহিদকে। পরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। রবিবার রাতে ময়নাতদন্ত শেষে শাহিদার লাশ ময়মনসিংহের বরিবয়ান গ্রামে দাফন করা হয়।