X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে জেলেরা ছুটছেন অশান্ত সাগরে

হেদায়েৎ হোসেন মোল্যা, খুলনা
২৯ অক্টোবর ২০২২, ০০:৫৮আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২২, ০৬:২৭

ইলিশের প্রজনন মৌসুম নিরাপদ করার লক্ষ্যে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুক্রবার মধ্যরাতে (২৯ অক্টোবর) শেষ হয়েছে। এ অবস্থায় রাতেই জেলেরা ফের শান্ত মনে ছুটেছেন অশান্ত সাগরে। তবে ঝড়-ঝঞ্জা থামলেও এখনও সাগরে শান্তি ফেরেনি। এমন অবস্থায় খুলনার জেলেরা সাগরে রওনা হওয়ায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাজ করছে স্বজনদের মধ্যে। 

পাইকগাছার হেতামপুর জেলে পল্লির রাম বিশ্বাস বলেন, সাগরের হঠাৎ হঠাৎ দুর্যোগ হচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। আমরা আগে লাইফ জ্যাকেট, বয়া কিছু পেতাম না। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা সরঞ্জাম, তাবু দিচ্ছে। রান্নার জন্য এলপি গ্যাস নিচ্ছি। সুন্দরবনের কাঠ, গাছ দরকার হচ্ছে না। কাঠের বদলে এখন লোহার তৈরি নোঙর ব্যবহার করছি।

মাহমুদকাটির রবিন বিশ্বাস বলেন, আগামী এপিল পর্যন্ত সাগরে অবস্থান করবো। তবে ঘন ঘন দুর্যোগ, বৈরী আবহাওয়ায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘এক সময়ে ঘণ্টা দেড়েক নৌকা চালিয়ে চাহিদামতো মাছ পেতাম। এখন সেখানে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। বহিরাগত জেলেদের জন্য আমরা অসহায়। ওরা দিনে দুই-তিন টন মাছ শিকার করে। সেখানে আমাদের অর্জন মাত্র চার-পাঁচ মণ। সাগরে মাছ ধরা ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না। তাই নিষেধাজ্ঞা আর দুর্যোগের কবলে আমরা বছরের অর্ধেক সময়ই কর্মহীন থাকি। 

আরও পড়ুন: নিষেধাজ্ঞা শেষে রাতে নদীতে নেমেছেন জেলেরা

পাইকগাছা উপজেলার রামনাথপুর মৎস্যজীবী ভোলানাথ বিশ্বাস বলেন, সাগরের আবহাওয়া আগের তুলনায় অনেকটাই পাল্টে গেছে। প্রকৃতি দেখে আবহাওয়া আঁচ করা গেলেও সম্প্রতি পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বর্তমানে আকস্মিক সাগর উত্তাল হয়ে উঠছে। ফলে অনেক সময় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামের সংকটে পড়তে হয়।

তিনি আরও বলেন,‘সমুদ্রে প্রচুর সম্পদ। কিন্তু আমরা তো কিছুই আনতে পারছি না। উল্টো জীবন নিয়ে ফিরে আসাও অনেক সময় কষ্টকর হেয়ে পড়ে। অন্য দেশের জেলেদের দাপটে টিকে থাকা দায়। ওদের এক কোটি, দেড় কোটি টাকার দামের বোট, আধুনিক জাল, মাছ ধরার সরঞ্জামের কাছে আমাদের ৫০টি নৌকাও টিকতে পারি না। আমরা মহাজনের কাছ থেকে লাখে ৩০ হাজার টাকা সুদ নিয়ে সাগরে যাই। সুদ দেবো, না লোন দেবো—তা নিয়ে চিন্তায় থাকি। তবে সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে টিকে থাকতে পারতাম।’

মাহমুদকাটি জেলে পল্লির বিশ্বজিৎ বিশ্বাস জানান, আর্থিক দূরবস্থা, উন্নত প্রযুক্তির সংকটের মধ্য দিয়েও তারা সমুদ্রে যান। নৌকা, জাল, খাবার, পানি—সব কিছু মিলিয়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়, যা দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুদে আনতে হয়। ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বছরে ১৩ লাখ টাকা দিতে হয়। 

রামনাথপুরের পাচু বিশ্বাস জানান, কোনো ব্যাংক বা বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) জেলেদের ঋণ দেয় না। সরকারি-বেসরকারি সুবিধা পেলে জেলেরা উন্নত নৌকা বা বোট নির্মাণ করতে পারতেন।

জেলেদের অভিযোগ, নিরাপত্তার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি ঋণ সুবিধা না থাকায় দাদন (সুদ) ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। জীবন বাজি রেখে দেশের পুষ্টি চাহিদা ও অর্থনীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তাদের কোনও মূল্যায়ণ নেই।

গদাইপুর গ্রামের রুবেল গাজী (৩২) বলেন, নিজেরা ঝুঁকি নিয়ে টাকা আয় করলেও আমাদের লাভ নেই। আমারা মাছ ধরতে পারি না, ভারত-মিয়ানমারের জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যায়। ধার-দেনা করে বাঁচা কষ্টকর।

সমুদ্রগামী জেলেদের নিয়ে কাজ করা উপকূলীয় পানি সম্মেলন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শামীম আরফিন বলেন, সমুদ্রগামী জেলেরা অন্য মৎস্যজীবীদের থেকে ব্যতিক্রম। তারা জীবন বাজি রেখে মৎস্য সম্পদ আহরণ করেন। যা সুনীল অর্থনীতির দুয়ার খুলে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আকস্মিক দুর্যোগ মোকাবেলার তাদের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণে বেশি বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সমুদ্রগামীসহ সামগ্রিকভাবে জেলেদের মানোন্নয়নে কাজ চলছে। তাদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদান, সাগরে অবস্থান চিহ্নিত করতে গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন (জিএসএম) স্থাপন করা হচ্ছে।

সমুদ্রগামী জেলেদের নিয়ে কাজ করা উপকূলীয় পানি সম্মেলন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শামীম আরফিন বলেন, সমুদ্রগামী জেলেরা অন্য মৎস্যজীবীদের থেকে ব্যতিক্রম। তারা জীবন বাজি রেখে মৎস্য সম্পদ আহরণ করেন। যা সুনীল অর্থনীতির দুয়ার খুলে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আকস্মিক দুর্যোগ মোকাবেলার তাদের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণে বেশি বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। 

খুলনার মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সমুদ্রগামীসহ সামগ্রিকভাবে জেলেদের মানোন্নয়নে কাজ চলছে। তাদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদান, সাগরে অবস্থান চিহ্নিত করতে গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন (জিএসএম) স্থাপন করা হচ্ছে।

মৎস্য অফিসের তথ্য অনুসারে, খুলনা জেলায় ৪৩ হাজার ২১৯ জন জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে সমুদ্রেগামী জেলের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩১ হাজার। এছাড়া বিভিন্ন নদীর মোহনায় ইলিশ মাছ শিকার করেন দুই হাজার ১০০ জন। খুলনায় জেলের সবচেয়ে বেশি ১৩ হাজার ৬৩ জন জেলে কয়রা উপজেলার। দাকোপে ৯ হাজার ৮৪ জন ও পাইকগাছায় চার হাজার ৮০৭ জন। ২০২০-২১ অর্থবছরে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ করা হয়েছে দুই হাজার ২০০ মেট্রিক টনের মতো। একসময় সমুদ্রগামী জেলেরা মৎস্য আহরণকালে জ্বালানি, আবাসস্থল তৈরি, ট্রলার নোঙরসহ বিভিন্ন কাজে বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের ওপর নির্ভর করলেও সেই চিত্র পাল্টেছে। বেসরকারি উদ্যোগে তাদের কেউ কেউ নিরাপত্তা সরঞ্জাম লাইফ জ্যাকেট, বয়া, রেডিও, দিক নির্ণয়কযন্ত্র, তাবু ও জিপিআরএস ব্যবহার করছেন।
 
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, সারাদেশে ৪৫০টি মৎস্যগ্রাম উন্নয়নসহ সমুদ্রগামী জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার কাজ করছে। জেলেদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদান, নৌকায় জিএসএম দেওয়া হচ্ছে। তাদের প্রশিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। তিনি বলেন, এখানে প্রায় ৪৪ হাজার জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে সমুদ্রগামী জেলেরা পর্যায়ক্রমে সহযোগিতা পাচ্ছেন।

/টিটি/
সম্পর্কিত
ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, জেলেপল্লীতে ঈদের আমেজ
১১ থেকে ১৭ মার্চ জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ধরা ইলিশে বাজার সয়লাব
সর্বশেষ খবর
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি