যশোর জেনারেল হাসপাতালসহ জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ইনজেক্টেবল স্যালাইন সরবরাহের সংকট দেখা দিয়েছে। দুই-তিনগুণ বেশি দামে বাইরে থেকে এসব স্যালাইন কিনতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। তাও সহজে মিলছে না। শহরের দুই-একটি ফার্মেসিতে মিললেও ৯২-৯৫ টাকার এসব স্যালাইন ২৫০-৩০০ টাকা দাম নেওয়া হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।
জেলার ওষুধ ব্যবসায়ীরা বলছেন, অপসো, ওরিয়ন, লিবরা ইনফিউশন, পপুলার, একমি, বেক্সিমকো, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসসহ কয়েকটি কোম্পানি ইনজেক্টেবল স্যালাইন সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু গত তিন মাস ধরে চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন দিচ্ছে না কোম্পানিগুলো।
কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, ইনজেক্টেবল স্যালাইন সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। ফলে ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইনের তীব্র সংকট চলছে। তবে সরবরাহ কেন কম তা বলতে পারছেন না তারা।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বাটিকাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সাবদার আলী মণ্ডল (৬৫) গত আট দিন ধরে যশোর জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। ছয় দিন আগে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন হয়েছে তার।
সাবদার আলীর মেয়ে সফুরা বেগম বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে প্রতিদিন দুই ধরনের মিলিয়ে আটটি স্যালাইন দিতে হয় বাবার শরীরে। হাসপাতাল থেকে একটাও স্যালাইন দেওয়া হয়নি। হাসপাতালের সামনের ফার্মেসিগুলো থেকে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে স্যালাইন কিনতে হচ্ছে। তাও পাওয়া যাচ্ছে না।’
সাবদার আলী বেডের অপর পাশে গ্যাস্ট্রিক ও আলসারের রোগী নান্নু মণ্ডলের (৪৫) অপারেশন হয়েছে গত শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) বিকালে। তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার স্ত্রী ময়না বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী ২২ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। প্রতিদিন গড়ে তিনটি করে স্যালাইন দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে চারটি দিয়েছে। বাকি সবগুলো দ্বিগুণ দামে বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হয়েছে। কখনও কখনও ৯৫ টাকার স্যালাইন ৩০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যশোর জেনারেল হাসপাতালের তিন জন সিনিয়র স্টাফ নার্স জানিয়েছেন, আগে সব ধরনের স্যালাইন সরবরাহ করা হতো। গত দুই মাস ধরে ডেঙ্গু, মেডিসিন, গাইনি, কলেরা, সার্জারি কোনও ওয়ার্ডের রোগীদের স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে না। তবে শুধুমাত্র ডেঙ্গু ওয়ার্ডে নরমাল স্যালাইন এবং কলেরা ওয়ার্ডে খাবার স্যালাইন সরবরাহ করা হয়। এর ফলে দরিদ্র অনেক রোগীর স্বজনরা বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। রোগীদের রোগের ওপর নির্ভর করে ডিএনএস, এনএস, এইচএসএস, কলেরা ও বেবি স্যালাইন দেওয়া হয়; সরবরাহ কম থাকায় এখন সরবরাহ বন্ধ আছে।
সংকটের কথা জানিয়ে যশোর শহরের তুহিন মেডিক্যাল ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পরপরই ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইন সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ডিএনএস, ডিএ, এনএস এবং এইচএস স্যালাইন বেশি চলতো। একমি, ওরিয়ন, অপসো, লিবরা, বেক্সিমকো ও স্কয়ার কোম্পানি এসব স্যালাইন উৎপাদন করে সরবরাহ করতো। কিন্তু তারা এখন সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সব ফার্মেসিতে স্যালাইন সংকট। এ সুযোগে কতিপয় ফার্মেসির মালিক দুই-তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি করছেন।’
স্যালাইন সরবরাহে সংকটের কারণ জানতে চাইলে বেক্সিমকো ওষুধ কোম্পানির যশোরের মেডিক্যাল প্রমোশন অফিসার মো. বিজয় হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার অর্থাৎ তিন মাস আগেও দিনে দুই-তিন হাজার স্যালাইন সরবরাহ করতো কোম্পানি। এখন ৫০০-এর বেশি দিচ্ছে না। ফলে ফার্মেসিগুলোতে সরবরাহ করতে পারছি না। কেন সরবরাহ কম, তা কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভালো জানেন।’
ফার্মেসিগুলোতে দুই-তিনগুণ বেশি দাম নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেন তারা দাম বেশি নিচ্ছেন, তা জানি না। আমরা আগের দামই নিচ্ছি। দাম বাড়েনি। তবে যেহেতু চাহিদা বেশি, জোগান কম। সেজন্য ফার্মেসিগুলো বেশি দাম নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।’
যশোর জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সরকারিভাবে চাহিদামতো স্যালাইন সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। জীবনরক্ষাকারী এই পণ্যের সংকট রয়েছে গত তিন মাস ধরে। রোগীদের ধরন অনুযায়ী স্যালাইন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ডিএনএস (ডেক্সট্রোজ প্লাস সোডিয়াম ক্লোরাইড), ডিএ (ডেক্সট্রোজ অ্যাকোয়া), হার্টম্যান সলিউশন, নরমাল এবং কলেরার স্যালাইন উল্লেখযোগ্য। এসব স্যালাইন রোগীরা ফার্মেসিতে গিয়ে পাচ্ছেন না। আবার পেলেও দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিনশ রোগী যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি থাকেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়।’
স্যালাইন সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সংকট আছে কিছুটা। তবে হাসপাতালে যে স্যালাইন আছে, তা দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি আমরা। আসলে প্রতিদিন কত সংখ্যক রোগীর জন্য স্যালাইন প্রয়োজন হয়, তা রোগ বিশ্লেষণ না করে বলা সম্ভব নয়। তবে ভর্তি রোগীর ৫০ শতাংশকে স্যালাইন দিতে হয়।’
স্যালাইন সংকটের কথা স্বীকার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানিয়েছি। তারা দিলে আমরা রোগীদের সরবরাহ করবো।’
আরও পড়ুন: স্যালাইন সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে অপসো-ওরিয়ন-লিবরা ও পপুলার, দাম দ্বিগুণ