বেনাপোল দিয়ে ভারত থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় গত দুই মাসে নয় হাজার ৬৬২ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এতো পরিমাণ আমদানি হলেও বেনাপোলসহ যশোরের বাজারে এর কোনও প্রভাব পড়েনি। উল্টো স্থানীয় বাজারে গত সপ্তাহেও চালের দাম কেজিপ্রতি চার-পাঁচ টাকা করে বেড়েছে।
এ অবস্থায় ভারত থেকে চাল আমদানির সময়সীমা আবার বাড়ানো হয়েছে। আমদানির জন্য বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভারত থেকে চাল আনতে পারবে। গত ৬ জানুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বেসরকারিভাবে নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল ও আতপ চাল আমদানির জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে এলসি খোলার সময়সীমা আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হলো।
আমদানিকারকরা বলছেন, ভারতে চালের দাম বেশি। তাই আমদানিকৃত চালের দাম বেশি পড়ছে। ফলে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। এ অবস্থায় দাম কমার কোনও সম্ভাবনা দেখছেন তারা।
ক্রেতারা বলছেন, এখন ধান-চালের ভরা মৌসুম। কৃষকের ঘরে উঠেছে আমন ধান। তারপরও সাধারণ মানুষকে বেশি দামেই চাল কিনতে হচ্ছে। এতে অনেকে আর্থিক সংকটে পড়েছেন। ভরা মৌসুমেও কম দামে চাল না কিনতে পেরে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। সিন্ডিকেট গড়ে ওঠায় দাম কমছে না বলে মনে করছেন তারা। বিশেষ করে বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারির ব্যবস্থা না থাকায় দাম বেড়েছে বলে জানান ক্রেতারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, খেটে খাওয়া মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় স্বল্পআয়ের মানুষকে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন বাড়ছে চালের দাম। সম্প্রতি বাজারে এমন কোনও পণ্য নেই যে তার দাম বাড়েনি।
আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর গত বছরের ১৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি দুই মাসে বেনাপোল দিয়ে নয় হাজার ৬৬২ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। সরকার গত ১৭ নভেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয়। এ সময়ের মধ্যে আশানুরূপ আমদানি না হওয়ায় সময় বাড়িয়ে চলতি মাসের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। তাতেও দেশের বাজারে চালের দাম না কমায় ভারত থেকে আমদানির জন্য আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক মাস সময় বাড়িয়েছে সরকার। আশা করা যায়, সামনে কমবে। আমদানিকারকদের ভাষ্যমতে, ভারতে চালের দাম বেশি। এ কারণে আমদানিকৃত চাল কম দামে বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।
বেনাপোল চেকপোস্ট কার্গো শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা আবু তাহের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আট প্রতিষ্ঠান গত ১৭ নভেম্বর থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত নয় হাজার ৬৬২ মেট্রিক টন চাল আমদানি করেছে। আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ৯২ প্রতিষ্ঠানকে। দুই লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিক টন সেদ্ধ এবং এক লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তাদের। অনেক প্রতিষ্ঠান এই সময়ের মধ্যে আমদানি করতে পারেনি। সরকার ২৫ দিন সময় নির্ধারণ করে দেয় আমদানিকৃত চাল বাজারজাত করার জন্য। পরে তা ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে ধীরগতিতে চলছে আমদানি। পর্যাপ্ত পরিমাণ আমদানি না হওয়ায় আরও এক মাস সময় বাড়িয়েছে সরকার। এ সময়ের মধ্যে সব চাল আমদানি হলে দাম কমবে।’
চলতি মৌসুমে ধানের দাম বেশি, যে কারণে কমছে না চালের দাম—এমনটাই বলছেন অটোরাইস মিল মালিক ও ধান ব্যবসায়ীরা। নাভারণ বাজারের সবচেয়ে বড় চালের আড়ত চৌধুরী রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী রাশেদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মোটা চাল ৫১ টাকা ও স্বর্ণা মোটা চাল ৫৩ টাকা কেজি পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে। নতুন ধানের চাল বাজারে আসতে শুরু করেছে। আমদানিও স্বাভাবিক রয়েছে। সামনে দাম কমবে। যদিও এবার অতিবৃষ্টির কারণে উৎপাদন কমেছে। সে কারণে আমদানি চলমান থাকবে।’
যশোরের শার্শা ও বেনাপোল সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বেশিরভাগ ধান উৎপাদন হয়। চলতি মৌসুমে এই অঞ্চলে ২১ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। বেশিরভাগ ধান ঘরে উঠে গেছে। এবার ধানের বাজার চড়া। এক হাজার ৩৫০-৪৫০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। বেশি দাম পেয়ে খুশি কৃষকরা।
কয়েকটি অটোরাইস মিল ঘুরে দেখা যায়, এখনও ধান কিনতে পারেননি মিল মালিকরা। কৃষকরা ধান বাজারজাত করতে পারেননি। তবে মিল মালিকরা অন্য জেলা থেকে ধান কিনে আনছেন। এসব ধান থেকে চাল করতে খরচ পড়ছে ৫০ টাকা এবং চিকন চালে ৬৩ টাকার বেশি খরচ পড়ছে বলে জানান মিলাররা।
বেনাপোল বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে মোটা চাল ৫২, হীরা চাল ৪৮, উনপঞ্চাশ চাল ৫৬, আঠাশ ৫৮-৬০, জিরাশাইল ৭৫, মিনিকেট ৬৫, ইন্ডিয়ান মিনিকেট ৭৫, বাসমতি ৯০, পাইজাম ৫৬, স্বর্ণা ৫৫ ও নাজিরশাইল ৮০ টাকায় খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে।’
চাল কিনতে টানাপোড়েনে পড়ার কথা জানিয়ে বেনাপোল বাজারের জামাল হোসেন বলেন, ‘এখন ধানের মৌসুম, আবার ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে। তারপরও দাম কমছে না কেন? প্রতি বছর এই সময়ে নতুন ধান উঠলে বাজারে চালের দাম অনেক কমে আসে। কিন্তু এবার বাজারের চিত্র উল্টো। সিন্ডিকেট আছে।’
আরেক চাল ক্রেতা আব্দুল জব্বার বলেন, ‘এবার পর্যাপ্ত ধানের আবাদ হয়েছে। তারপরও দাম কমছে না। আমরা গরিব মানুষ। দাম না কমলে কীভাবে চলবো? হয়তো সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমছে না। তাই আমি মনে করি, প্রশাসন বাজারে নজরদারি বাড়ালে দাম অনেকটা কমে আসবে।’
বেনাপোল চেকপোস্ট উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপসহকারী কর্মকর্তা শ্যামল কুমার নাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বছরের ১৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি দুই মাসে বেনাপোল দিয়ে নয় হাজার ৬৬২ মেট্রিক টন চাল শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হয়েছে। যেহেতু চাল নিত্যপণ্য এবং দেশের বাজারে চাহিদা ব্যাপক, সেহেতু আমদানিকৃত চাল বন্দরে আসা মাত্রই আমরা দ্রুত ছাড় করার ব্যবস্থা করছি।’