যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছাত্রদের দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে সিএসই বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গালিবের সাময়িক বরখাস্ত, এই ঘটনায় সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেত্রীর গায়ে স্পর্শসহ নানান অভিযোগে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
গতকাল রাতে দফায় দফায় হাতাহাতি, ইট পাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠির আঘাতে উভয়পক্ষের কমবেশি আট জন আহত হন বলে ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে চার জনকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এদিকে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে উচ্চ রক্তচাপে অসুস্থ হয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন প্রক্টর ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. আমজাদ হোসেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাতেই পুলিশ সদস্য মোতায়েন করে কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডিনস কমিটির আহ্বায়ককে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এদিকে, উদ্ভূত ঘটনায় শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিকালে প্রেসক্লাব যশোরে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন বিবদমান সিএসই এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অন্য বিভাগের ছাত্ররা। উভয়পক্ষ নিজ নিজ অবস্থান সাংবাদিকদের জানান। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোর জেলা কমিটির আহ্বায়ক রাশেদ খান উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে রাশেদ খান উভয়পক্ষকে একসঙ্গে বসিয়ে মীমাংসার চেষ্টা করেন। সন্ধ্যায় তিনি জানান, দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা হয়ে গেছে।
বিকাল ৫টার দিকে প্রথমে সংবাদ সম্মেলন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোর জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক সাদেকা শাহনী উর্মি ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
তারা জানান, শুক্রবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একটি চায়ের দোকানে লিফট দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত সিএসই বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গালিবকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোর জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক সাদেকা শাহনী উর্মি ও তার বন্ধুরা। এ সময় তার সঙ্গে সিএসই বিভাগের স্বপন নামে এক শিক্ষার্থীর ধাক্কা লাগে। এ ঘটনায় তারা প্রতিবাদ করলে সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়। পরে উর্মির বন্ধু ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের যুগ্ম আহ্বায়ক পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের হাবিব আহমেদ শান সিএসই বিভাগের বরখাস্ত শিক্ষক সৈয়দ গালিবকে নিয়ে মন্তব্য করেন।
এ সময় ওই বিভাগের শিক্ষার্থীরা শানের ওপর চড়াও হন। এরপর উর্মি ও শান প্রক্টর অফিসের দিকে যাওয়ার সময় সময় সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের দিকে তেড়ে গেলে তারা ছোট ভাই ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের ফোন দিয়ে ঘটনাস্থলে আসতে বলেন। এরপরই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
শিক্ষার্থীদের দাবি, প্রশাসনিক ভবনের নিচে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানালে সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের যুগ্ম সদস্য সচিব এস এম দোলেনুর করিম ও এফএমবি বিভাগের শিক্ষার্থী মঞ্জুরুল হাসান আহত হন। পরে সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা খেলার মাঠে ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা মুন্সী মেহেরুল্লাহ হলের সম্মুখ সড়কে অবস্থান নেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে সংঘর্ষ ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
এস এম দোলেনুর করিম বলেন, উর্মির ফোন পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে দেখি, আমাদের সহযোদ্ধা শানকে সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা ঘিরে রেখেছে। বিষয়টি সমাধান করতে গেলে তারা আমার গায়ে হাত তুলে এবং ধাক্কা দেয়। এ ঘটনা আমার বিভাগের শিক্ষার্থীরা জানতে পেরে ছুটে আসে। আমাকে কেন মারা হয়েছে এটা জানতে চাইলে তখন তারা আমার বন্ধু মাঞ্জুরুলকে আহত করে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী উর্মির দাবি, দুনীতি ও অনিয়মের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত সিএসই বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ গালিবসহ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের মদতপুষ্ট শিক্ষক, কর্মচারীদের শাস্তির দাবিতে আমরা দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। অথচ সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা সেই ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর নীল দলের সভাপতি ড. সৈয়দ গালিবকে রক্ষা করতে আন্দোলন করছে। গতকাল রাতের এই হামলা ফ্যাসিস্ট ও তাদের দোসরদের ইন্ধনে করা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি।
এদিকে, তাদের সংবাদ সম্মেলনের পরপরই সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে উপস্থিত হন সিএসই বিভাগের মুস্তাফিজুর রহমান, সামিউল, ফয়সাল আহমেদ, এ কে এম এস লিমন প্রমুখ।
সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর বলেন, সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে আমাদের এক ভাইয়ের হাত ভুলবশত উর্মি আপুর গায়ে লেগে যায়। তখন সরি বলার পরও তার বন্ধু ইএসটি বিভাগের শিক্ষার্থী শান আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। এ জন্য আমরা প্রক্টর স্যারের কাছে বিচারের জন্য যাচ্ছিলাম। তখন তারা আমাদের সঙ্গে বিশৃঙ্খলা করে এবং লিমনকে ধাক্কা দিতে থাকে। এ সময় তারা আমাদের বিভাগের তিন জন ভাইকে মেরে গুরুতর আহত করেন। তারা আমাদের ওপর ইট পাটকেল ছুড়ে মারে। আমরা তাদের ওপর হাত ওঠাইনি, শুধু আক্রমণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি।
তারা দাবি করেন, আমাদের বিভাগের চেয়ারম্যান স্যারকে (ড. সৈয়দ গালিব) সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে মর্মে নোটিশ দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ রয়েছে- সে বিষয়টি আমরা জানতে শুক্রবার সকালে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করি। আমরা কোনও ফ্যাসিস্টের পক্ষের লোক নই। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমরাও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে- তারা শাস্তি পাক, এটাই আমরা চেয়েছি।
এদিকে, সেখানে উপস্থিত বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, যবিপ্রবির ঘটনাটি দুঃখজনক। উভয়পক্ষেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। তাদের সবাইকে নিয়ে আমরা বসেছি। উভয়পক্ষের মধ্যে মীমাংসা হয়ে গেছে।
যবিপ্রবির প্রক্টর ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. আমজাদ হোসেন জানিয়েছেন, এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডিনস কমিটির আহ্বায়ককে (অধ্যাপক ড. জাফিরুল ইসলাম) আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শনিবার এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাম্পাসের মধ্যে সব ধরনের মিছিল, মিটিং, সভা, সমাবেশ ও গণজমায়েত না করার জন্য সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রক্টর ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. আমজাদ হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী রিজেন্ট বোর্ড থেকে একটা তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি তদন্তের মাধ্যমে বের করবে কারা কারা স্বৈরাচারের দোসর বা সুবিধাভোগী। এই রিপোর্ট পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।