X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

২০০ বছর ধরে কেন বিখ্যাত মুক্তাগাছার মণ্ডা?

আতাউর রহমান জুয়েল, ময়মনসিংহ
১১ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:০১আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:১৬

মিষ্টির জগতে এক অনন্য নাম মণ্ডা। দুধ, ছানা আর চিনি দিয়ে তৈরি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার এই বিশেষ মিষ্টির জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়েছে এর নাম। রাম গোপাল পালের সৃষ্টি মণ্ডা বংশানুক্রমে প্রায় দুইশ বছর ধরে টিকে রয়েছে আদি ঐতিহ্য আর নিজস্ব স্বাদ নিয়ে। সৃষ্টিলগ্ন থেকে নির্ধারিত একটি চুলায় চলছে এই মণ্ডা তৈরির কাজ। চাহিদা বাড়ায় একাধিকবার বাড়তি চুলা বানিয়ে বিশেষ এই মিষ্টির উৎপাদন বাড়াতে চায় পাল পরিবার। তবে স্বাদে গড়মিল হওয়ায় সুনাম বিনষ্টের শঙ্কায় আবারও আদি চুলায় ফিরে যান মণ্ডার কারিগররা।

বিশেষ এই মিষ্টির জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীরাও চেষ্টা করেছিলেন ব্যবসায়িকভাবে সফল হতে। তবে তারাও ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ একটাই, স্বাদের গড়মিল। ফলে একচেটিয়া সুনাম আর সুখ্যাতি নিয়ে এখনও সগৌরবে টিকে আছে গোপালের মণ্ডা।

যেভাবে এলো মণ্ডা

গোপালের বংশধরদের মুখে শোনা গেল মণ্ডা সৃষ্টির গল্প। তারা জানান, এক সন্ন্যাসী পর পর কয়েক রাত স্বপ্নে মণ্ডা তৈরির পদ্ধতি শিখিয়ে গোপাল পালকে আদেশ করেন, ‘গোপাল, কাল থেকে তুই এই জগতের মানবের খাওয়ার জন্য সুস্বাদু মণ্ডা তৈরির কাজ শুরু করে দে।’ গোপাল সন্ন্যাসীর স্বপ্নাদেশে এক শুভ দিনে মণ্ডা তৈরির কাজ শুরু করেন।

মুক্তগাছার রাম গোপাল পালের মণ্ডার দোকান

কাজ শেষে স্বপ্নে দেখা সেই সন্ন্যাসী স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে মণ্ডা তৈরির চুলায় হাত বুলিয়ে দেন। গোপাল সন্ন্যাসীকে দেখামাত্র পদযুগলে মাথা রেখে ভক্তি জানিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। সন্ন্যাসী গোপালের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তোর হাতের তৈরি এই মণ্ডা খেয়ে সবাই সুখ্যাতি করবে, তোর মণ্ডা একদিন পুরো বিশ্বে সেরা মিষ্টি হবে। পুরুষানুক্রমে তুই এই মণ্ডা শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করবি। তোর অবর্তমানে বংশধরদের হাতে এই সুস্বাদু মণ্ডা টিকে থাকবে।’ এর পর থেকে বংশানুক্রমে তৈরি হয়ে আসছে সুস্বাদু এই মণ্ডা। ১০৮ বছর বয়সে ১৯০৭ সালে গোপাল পরলোক গমণ করেন।

মণ্ডা ছাড়া হতো না জমিদারদের সকালের নাশতা

মুক্তাগাছার জমিদারদের আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতায় মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর বাড়ির পূর্বদিকে নির্মাণ করা হয়েছিল গোপাল পালের মণ্ডার দোকানের দালান ঘর। স্বর্গীয় রাম গোপাল পাল ১৮২৪ সালে সর্বপ্রথম মণ্ডা তৈরি করে মুক্তাগাছার তৎকালীন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরীকে আপ্যায়ন করেন। মহারাজ মণ্ডা খেয়ে খুবই খুশি হন। জনশ্রুতি রয়েছে, মণ্ডা ছাড়া নাকি জমিদারদের সকালের খাবার হতো না। আর জমিদার স্ট্যাটের সব কর্মচারীদের মধ্যাহ্নকালীন জলখাবারেও রাখা হতো এই মণ্ডা।

রাম গোপাল পালের প্রতিকৃতি

২০০ বছরের মণ্ডার ব্যবসা

পাল পরিবারের সদস্যরা জানান, নবাব সিরাজের পতনের পর গোপাল পালের দাদা শিবরাম পাল এবং তার বাবা রামরাম পাল অনেকের মতো জীবন বাঁচাতে মুর্শিদাবাদ থেকে রাজশাহীতে চলে আসেন। পরে রাজশাহী থেকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় স্থায়ী হন। ১৮২৪ সালে জমিদার পরিবারের সহায়তায় এই মণ্ডার ব্যবসা শুরু করেন। এর পর ১৯৮ বছর ধরে গোপাল পরিবারের ঐতিহ্যবাহী মণ্ডার ব্যবসা চলে আসছে। তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাসা বাড়ি ও ব্যবসা ফেলে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন গোপাল পরিবারের সদস্যরা। এ সময় মণ্ডার দোকানের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসার পর আবার ঘুরে দাঁড়ায় পাল পরিবারের সদস্যরা। নতুন করে যাত্রা করে মণ্ডার দোকান।

মণ্ডার স্বাদ ময়মনসিংহ থেকে পৌঁছেছে দশ দিগন্তে

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা রাজনৈতিক আলোচনার জন্য মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতে আসতেন উপ মহাদেশের বহু খ্যাতিমান ও প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গ। এদের মধ্যে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্ত্র রায়, নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুসহ অনেক অতিথি এই মণ্ডার স্বাদ নিয়েছেন।

মুক্তগাছার মণ্ডার দোকান

লেখক ও শিক্ষাবিদ মোখলেছুর রহমান জানান, মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী ও তার পুত্র শশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর খুব প্রিয় ছিল এই মণ্ডা। মুক্তাগাছার মহারাজ শশীকান্ত আচার্য্য একবার রাশিয়ার জোসেফ স্টালিনের কাছে মণ্ডা উপহার পাঠিয়েছিলেন। স্টালিন পত্রযোগে মহারাজ শশীকান্তকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। পাকিস্তানের সাবেক ফিল্ড মার্শাল ও রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানও ছিলেন মণ্ডার ভক্ত। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মোনায়েম খান প্রায়ই তার কাছে মণ্ডা পাঠাতেন। মওলানা ভাসানী মণ্ডা খেতে কয়েকবার মুক্তাগাছায় এসেছেন। একবার চীন সফরে যাওয়ার সময় নেতা মাও সেতুংয়ের জন্য মণ্ডা নিয়ে যান ভাসানী। পাকিস্তান আমলে ময়মনসিংহ ও মুক্তাগাছা সভা শেষে বঙ্গবন্ধু এই মণ্ডার দোকানে এসেছিলেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ ঢাকায় এলে মুক্তাগাছা থেকে গোপাল পালের মণ্ডা নেওয়া হয়।

কেমন আছে গোপালের মণ্ডার দোকান

ময়মনসিংহ শহর থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরের মুক্তাগাছা পৌর এলাকার রাজবাড়ি সংলগ্ন গোপালের মণ্ডার দোকানের সামনে অনেকটাই ফাঁকা রাখা হয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য। একতলা পুরনো পাকাদালান ঘরের প্রধান ফটকের সামনের ওপরে কংক্রিটে আঁকা আয়েশি মেজাজের সিংহের ছবি। ভেতরের ছোট্ট করিডোরের মতো জায়গায় কয়েক টেবিল আর বেঞ্চ পাতা। একপাশে ক্যাশ কাউন্টারের আসনে পাওয়া গেলো গোপালের চতুর্থ বংশধর রবীন্দ্র নাথ পাল। আরেক পাশে কাচের ফ্রেমে বাধা কাঠের তৈরি রাম গোপাল পালের প্রতিকৃতি। এই প্রতিকৃতির সামনে রয়েছে নিয়মিত ভোগ হিসেবে দেওয়া একটি মণ্ডা।

মুক্তগাছার মণ্ডা

দেয়ালে গাথা জমিদার পরিবারসহ দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের মণ্ডার জন্য দেওয়া প্রশংসাপত্র। সাথে রাম গোপাল পালের বংশধরদের পুরুষানুক্রমের পরিচয়পর্বের কাঠের বোর্ড। এরকম পরিবেশে বসে ভক্তরা মণ্ডা খাচ্ছেন, কেউবা প্যাকেটে করে নিয়ে যাচ্ছেন।

পরিবারের সিনিয়র সদস্য রবীন্দ্র নাথ পাল বলেন, দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ কেজি মণ্ডা বিক্রি হয়। কাঁচামাল চিনি ও দুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং দক্ষ লোকবলের অভাবে মান বজায় রেখে উৎপাদন অব্যাহত রাখা কষ্টদায়ক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দোকানে বসে ১৫ মিনিটেই দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র। এ সময় আট কেজি মণ্ডা পার্সেল হয়। আবার অনেকে দোকানে বসেই নেন মণ্ডার স্বাদ।

স্থানীয়দের দাবি দৈনিক ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি মণ্ডা বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু করের ভয়ে দোকান মালিক তা কম করে বলেন। প্রতি কেজিতে ২০টির মতো মণ্ডা পাওয়া যায়, দাম ৬০০ টাকা।

/টিটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জানা গেলো বেইলি রোডে আগুনের ‘আসল কারণ’
জানা গেলো বেইলি রোডে আগুনের ‘আসল কারণ’
গরমে খান দইয়ের এই ৫ শরবত
গরমে খান দইয়ের এই ৫ শরবত
সাভারে ভাঙারির দোকানে আগুন, এক ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে
সাভারে ভাঙারির দোকানে আগুন, এক ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে
বার্সা চায় শিরোপার দৌড়ে ফিরতে, আরও কাছে যাওয়ার বাসনা রিয়ালের
এল ক্লাসিকোবার্সা চায় শিরোপার দৌড়ে ফিরতে, আরও কাছে যাওয়ার বাসনা রিয়ালের
সর্বাধিক পঠিত
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও