X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

যে প্রক্রিয়ায় নোয়াখালী থেকে পাসপোর্ট পায় তিন রোহিঙ্গা

রনজিৎ চন্দ্র কুরী, নোয়াখালী
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২৩:১৬আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:০৯

তিন রোহিঙ্গা যুবকের  বাংলাদেশি পাসপোর্ট চট্টগ্রামের আকবর শাহ্ থানা এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার তিন রোহিঙ্গা যুবক নোয়াখালীতে ভুয়া ঠিকানা দেখিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করেছে। সেই পাসপোর্ট নিয়ে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় তুরস্কের ভিসা আনতে যাওয়ার সময় বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) গ্রেফতার হয় তারা। পাসপোর্টের আবেদনপত্রে আবেদনকারীর বাবা-মা, ঠিকানা এবং অন্যান্য তথ্য মিথ্যা উল্লেখ করা হলেও সে তথ্য যাচাই না করেই তদন্ত কর্মকর্তা তাদের পক্ষে ভুয়া রিপোর্ট দেন। দুই কর্মকর্তা সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আবুল কালাম আজাদ ও নুরুল হুদা আবেদনপত্র তদন্ত না করেই ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। ভুয়া পাসপোর্ট তৈরির এ পুরো প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিএসবির কিছু কর্মকর্তা জড়িত বলে জানা গেছে।

ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে পাসপোর্ট নেওয়া ওই তিন রোহিঙ্গা হলো মোহাম্মদ ইউসুফ, মোহাম্মদ মুছা ও মো. আজিজ। পাসপোর্টের তথ্যে ইউসুফ ও মুছা সম্পর্কে ভাই। এ তিন জন কক্সবাজারের উখিয়ার হাকিমপাড়ার শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা। তারা ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের সময় পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। গত দুই বছর কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার খাইয়াংখালী হাকিমপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছিল তারা। ইউছুফ ও মুছার বাড়ি মিয়ানমারের মংডুর দুমবাইয়ে এবং আজিজের বাড়ি মংডুর চালিপাড়ায়।
নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট সূত্রে জানা যায়, ইউসুফ ও মুছার পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর। তাদের বাবার নাম আলী আহমেদ, মায়ের নাম লায়লা বেগম। স্থায়ী ঠিকানা- নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কাদরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের নজরপুর গ্রাম। মোহাম্মদ আজিজের নামে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি। পাসপোর্টের আবেদনপত্রে তার বাবার নাম জামির হোসেন, মায়ের নাম রশিদা উল্লেখ করা হয়। স্থায়ী ঠিকানা লেখা হয়েছে, নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কাদরা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের নিজ সেনবাগ গ্রাম।
এ বিষয়ে কাদরা ইউনিয়নের নজরপুর গ্রামের দফাদার মহরম আলী বলেন, ‘এ গ্রামে মোহাম্মদ ইউসুফ ও তার ভাই মোহাম্মদ মুছা নামে কোনও ব্যক্তি নেই এবং কোনও অফিসার তদন্ত করতে আসেনি।’

আটক তিন রোহিঙ্গা নাগরিক

কাদরা ইউনিয়নের নিজ সেনবাগ গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মো. ইলিয়াস বলেন, ‘এই গ্রামে জামির হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ আজিজ নামে কেউ বসবাস করে না।’
কাদরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘মোহাম্মদ ইউসুফ, মোহাম্মদ মুসা ও মোহাম্মদ আজিজের নামে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি যে জন্মনিবন্ধন ইস্যু করা হয়েছে তা নিবন্ধন বালাম বা অনলাইনে নেই। তাদের কাগজপত্রের স্ক্যানিং ভুয়া। আমি ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর চেয়ারম্যান হিসেবে শপথ নিয়েছি। চেয়ারম্যানের কাছ থেকে যে নাগরিক সনদ নেওয়া হয়েছে তাতে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস উল্লেখ রয়েছে। এ সনদ আমাদের অফিস কর্তৃক ইস্যু করা নয়।’
সেনবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার তিন রোহিঙ্গার পাসপোর্ট পাওয়ার বিষয় তদন্ত করে দেখা হয়েছে। ওই ঠিকানা ভুয়া ছিল।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) এক কর্মকর্তা জানান, ভুয়া পাসপোর্ট তৈরিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিএসবি কর্মকর্তারা জড়িত। এ ঘটনার আগে চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ৫৪ রোহিঙ্গা পাসপোর্ট তৈরি করে দেশত্যাগ করার সময় বিমানবন্দরে গ্রেফতার হয়। ওই ৫৪ জনের মধ্যে দুইজন সেনবাগ উপজেলার ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট তৈরি করেছিল। মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তদন্ত না করেই রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে ডিএসবির এএসআই আবুল কালাম আজাদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই ঘটনায় এএসআই নুরুল হুদার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
ডিএসবি’র পরিদর্শক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, আজ রবিবার (৮ সেপ্টেম্বর) নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে তিনি নথিপত্র যাচাই করেছেন। সেখানে কাদরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ কামরুজ্জামান কর্তৃক নাগরিক সনদের কপি এবং সাবেক চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল হক কর্তৃক জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়েছে। তিন রোহিঙ্গা যুবকের পাসপোর্টে উল্লেখিত জাতীয় পরিচয়পত্র ও মুঠোফোন নম্বরগুলো জেলা সার্ভার স্টেশনে যাচাই করে এসব নম্বরের কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, ‘পাসপোর্ট তৈরিতে জালিয়াত চক্র ভুয়া নাম, ঠিকানার পাশাপাশি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করেছে। ওই তিন রোহিঙ্গা যুবকের পাসপোর্টের আবেদনপত্র তদন্ত করে রিপোর্ট প্রধানকারীর দুই পুলিশ কর্মকর্তা উপ-সহকারী পুলিশ পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ ও নুরুল হুদা ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছেন বলে স্বীকারও করেছেন।’ ভুয়া রিপোর্ট প্রদানকারী এ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. নুরুল হুদা বলেন, ‘এর আগেও দুই রোহিঙ্গার সেনবাগের নাম, ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এক্ষেত্রে পাসপোর্ট অধিদফতরের করার কিছুই নেই। পাসপোর্ট জালিয়াতি ঠেকাতে সরকার সম্প্রতি ১০ লাখ রোহিঙ্গার আঙুলের ছাপ (ফিঙ্গার প্রিন্ট) সংগ্রহ করে সব পাসপোর্ট অফিসে সরবরাহ করেছে। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের কেউ পাসপোর্ট নিতে গেলে ধরা পড়বে।’


যে প্রক্রিয়ায় নোয়াখালী থেকে পাসপোর্ট পায় তিন রোহিঙ্গা

তিনি বলেন, ‘ডিএসবি কর্তৃক আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট দেওয়ার পরেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। তিন রোহিঙ্গার পাসপোর্ট করার বিষয়ে আমার অফিসের কারও সংশ্লিষ্টতা নেই। তারপরও তদন্তে কারও যোগসাজশ থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ইউসুফ ও মুছার আবেদনপত্র তদন্তকারী এএসআই নুরুল হুদার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের দেওয়া তথ্য সঠিক। কারণ, তিনি নিশ্চিত হয়েই এ তথ্য দিয়েছেন।’
অভিযোগের বিষয়ে অপর তদন্তকারী এএসআই আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পাসপোর্ট সংক্রান্ত বহু তদন্ত প্রতিবেদন আমরা দিয়ে থাকি। তবে দফতরে সংরক্ষিত রেকর্ডপত্র না দেখে নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। তবে সাময়িক বরখাস্তের ব্যাপারে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান যে তথ্য দিয়েছেন তা সঠিক।’

আরও পড়ুন:  বাংলাদেশি পাসপোর্টসহ তিন রোহিঙ্গা আটক

             তিন রোহিঙ্গার নোয়াখালী থেকে পাসপোর্ট তৈরির বিষয় খতিয়ে দেখবে পুলিশ

 

 

 

 

 

 

 

 

/ওআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জলবায়ু অভিযোজনে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ
জলবায়ু অভিযোজনে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ
শতবর্ষী গাছের গোড়ায় জ্বলছে আগুন, ডাল দিয়ে বের হচ্ছে ধোঁয়া!
শতবর্ষী গাছের গোড়ায় জ্বলছে আগুন, ডাল দিয়ে বের হচ্ছে ধোঁয়া!
আলকারেজের কষ্টের জয়, বিদায় মেদভেদেভের 
আলকারেজের কষ্টের জয়, বিদায় মেদভেদেভের 
শেফালির মৃত্যু: কারিনা বললেন, ‘আমি বোটক্সের বিরুদ্ধে’
শেফালির মৃত্যু: কারিনা বললেন, ‘আমি বোটক্সের বিরুদ্ধে’
সর্বাধিক পঠিত
সঞ্চয়পত্রে কমলো মুনাফার হার, কার্যকর ১ জুলাই থেকে
সঞ্চয়পত্রে কমলো মুনাফার হার, কার্যকর ১ জুলাই থেকে
তিন বিমানবন্দরে ১৬ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে
তিন বিমানবন্দরে ১৬ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে
ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ
ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ
রূপপুর প্রকল্পের ১৮ প্রকৌশলী অপসারণ: হাইকোর্টের রুল
রূপপুর প্রকল্পের ১৮ প্রকৌশলী অপসারণ: হাইকোর্টের রুল
অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা মুখোমুখি
প্রশাসনে থামছে না আন্দোলনঅন্তর্বর্তী সরকার ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা মুখোমুখি