আবু ইউনুস শহীদুন্নবী জুয়েল ছিলেন সজ্জন প্রকৃতির। কারও সঙ্গে কখনোই খারাপ আচরণের নজির নেই তার। ছাত্রজীবন থেকেই বই পড়তে ভালোবাসতেন। তারপরও নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তার পরিবার, বন্ধু, স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
জুয়েলের বড় ভাই আবু আক্কাস মেহেদুন্নবী পলাশ বলেন, ‘আমার ভাই এমন কোনও অপরাধ করেনি যে তাকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দিতে হবে। তার মতো একজন ভালো লোককে কারা, কেন এভাবে হত্যা করে পোড়ালো? আমরা এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় ও সরকারি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত চাই। প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। যেন দেশে আর কোথাও এমন জঘন্যতম ঘটনা না ঘটে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভাই চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার থেকে একটু এলোমেলো কথা বলতো। এ কারণে তাকে মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী এমন করেছে যে তাকে এত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হলো?’
জুয়েলের বোন হাসনা আক্তার লিপি বলেন, ‘পাটগ্রামে আমাদের আত্মীয় স্বজন আছে। সে আসলে এখানে কোথায় এসেছিল আমরা তা নিশ্চিত হতে চাই। তার সঙ্গে থাকা যুবকের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমরা ৫ ভাই ও ৩ বোন। রংপুর শহরে কোথাও আমাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। আমার ভাই জুয়েলের বিরুদ্ধেও নেই। তাহলে তাকে কেন এভাবে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট ন্যায়বিচার চাই।’
জুয়েল সম্পর্কে তার দুলাভাই আব্দুল মান্নান বলেন, ‘জুয়েল আমার শ্যালক। তাকে আমি যেভাবে চিনি ও জানি তাতে তার কখনোই কোনও অন্যায় করার নজির তো নেই। এমনকি খারাপ আচরণও নয়। পরিবারের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। তার স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের গ্রন্থাগারিকের পদ থেকে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর বাধ্যতামূলক অবসরে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। জুয়েলকে যারা অন্যায়ভাবে হত্যার পরে লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
উত্তরাঞ্চলের আন্দোলনকর্মী নাহিদ হাসান নলেজ বলেন, ‘আমি জুয়েল ভাইকে ৯৬ সাল থেকে চিনি ও জানি। তার মতো ভদ্র, সজ্জন ও ভালো স্বভাবের মানুষ কম দেখেছি। তাকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এ ঘটনায় আমরা সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুয়েল ভাই আমাকে নিহার রঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইটি পড়তে দিয়েছিলেন। তার হত্যার ঘটনাটি আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই। সরকারের প্রয়োজনে ঢাকা থেকে উচ্চ ক্ষমতা ও বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা সম্পন্ন লোকজন দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার পেছনের ঘটনা তুলে আনতে হবে। প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’
নাহিদা হাসান বলেন, ‘আমি যতদূর জেনেছি, বুড়িমারীতে আগেও তিনটি মব হয়েছিল। ওই সময় ব্যাপক হারে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করা হয়েছে। এসিল্যান্ডকে দুর্ঘটনায় পড়তে হয়েছিল। এসব গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জেনেছি। কিন্তু বিচার হয়েছে, এমনটা শুনিনি। তাই এবার যেন বিষয়টি কোনোভাবে আড়ালে না যায়।’
ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী ও পাটগ্রাম উপজেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক আরাফাত সুলতান কার্ণিজ বলেন, ‘আমি রংপুর ক্যান্টমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করার সময় থেকে জুয়েল স্যারকে চিনি ও জানি। তিনি আগে থেকেই নামাজ পড়তেন। আমার জানা মতে তিনি কখনও নামাজ কাজা করেননি। এত ভালো একজন মানুষকে এভাবে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি কোনও সুস্থ মানুষ করতে পারে না। বুড়িমারীতে বারবার মব কেন হয়? তা গভীরভাবে সরকারকে খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করি।’
জুয়েলের সাবেক সহকর্মী নুরুন্নবী শান্ত বলেন, ‘আমার দেখা ও জানা মতে তার মতো ভালো মানুষ কম হয়। যে মানুষটা পড়াশোনা করে, নামাজ পড়ে সে কখনোই অন্যায় কাজ করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। তাকে কেন নির্মমভাবে হত্যার পর লাশ পোড়ানো হলো। আমরা সঠিক ও ন্যায় বিচার চাই।’
এদিকে, জুয়েলকে গণপিটুনির পর লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনও মামলা হয়নি। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েকজনকে আটক করলেও স্বীকার করেনি। বর্তমানে পাটগ্রামে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের ডিআইজি ও লালমনিরহাট ১ আসনের এমপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছেন।
আরও পড়ুন...
হত্যার পর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি স্বজনদের
লালমনিরহাটে যুবককে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ
পিটিয়ে হত্যা করে মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন
‘যুবককে হত্যার পর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় একাধিক মামলা হবে’
পিটিয়ে হত্যার পর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার ছায়া তদন্তে র্যাব