X
মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
৩০ বৈশাখ ১৪৩২

সলঙ্গার হাটের চিত্র বদলালেও বিলেতি পণ্য বর্জনকারীদের স্মৃতিস্তম্ভ বসেনি

রানা আহমেদ, সিরাজগঞ্জ
২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:১০আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:১০

ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়কালে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে জনতা উদ্বেলিত হয়ে বিলেতি পণ্য বর্জন করে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের সংগ্রাম শুরু করেছিল। যার ঢেউ লেগেছিল সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায়ও। ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার ছিল বড়হাট বার। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের কর্মীরা হাটে বিলেতি পণ্য কেনাবেচা বন্ধ করতে নেমে পড়েন। স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের রুখতে ছুটে আসে পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর এন দাস, জেলা পুলিশ সুপার ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক এস কে সিনহার নেতৃত্বে ৪০ জন সশস্ত্র লাল পাগড়িওয়ালা পুলিশ। এ সময় ব্রিটিশ সরকারের পুলিশের গুলিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ হতাহত হন। সেই থেকে এই দিনটি রক্তাক্ত সলঙ্গা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) রক্তাক্ত সলঙ্গা বিদ্রোহের ১০১তম দিবস। ‍যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালন উপলক্ষে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ পাঠাগার, নূরুননাহার তর্কবাগীশ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, তর্কবাগীশ মহিলা মাদ্রাসা, তর্কবাগীশ উচ্চ বিদ্যালয় ও সলঙ্গা ফোরাম পৃথক পৃথক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ।

জানা গেছে, সলঙ্গার গো হাটায় ছিল বিপ্লবী স্বদেশি কর্মীদের অফিস। কংগ্রেস অফিস ঘেরাও করে মাওলানা আব্দুর রশিদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে তাকে মুক্ত করতে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বিদ্রোহে ফেটে পরে সলঙ্গার সংগ্রামী জনতা। জনতার ঢল ও আক্রোশ দেখে ম্যাজিস্ট্রেট জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি চালাতে নির্দেশ দেন। শুরু হয়ে যায় বুলেট বৃষ্টি। ৪০টি রাইফেলের মধ্যে মাত্র একটি রাইফেল থেকে কোনও গুলি বের হয়নি। এই রাইফেলটি ছিল একজন ব্রাহ্মণ পুলিশের।

সলঙ্গার হাটের চিত্র বদলালেও বিলেতি পণ্য বর্জনকারীদের স্মৃতিস্তম্ভ বসেনি

তবে এরই মধ্যে হাটের অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে। সলঙ্গা বিদ্রোহের ১০০ বছর পেরিয়ে গেলেও জায়গার অভাবে নিহত শহীদদের স্মরণে নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি একটি স্মৃতিস্তম্ভ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঐতিহ্যবাহী সলঙ্গা হাটে বেড়েছে বেচাকেনা। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন স্থাপনা। সে সময় সপ্তাহে দুদিন হাট বসতো শুক্রবার ও সোমবার। এর মধ্যে বড় হাটবার ছিল শুক্রবার। এখন হাট বসে বৃহস্পতিবার এবং সোমবার। সে সময় রাস্তাঘাট ভালো না থাকায় হাটের দিন অন্তত চার-পাঁচশ ঘোড়ার গাড়িতে সলঙ্গা হাটে মালামাল আসতো। ধান, পাট ও রবিশস্য আসতো গরু এবং মহিষের গাড়িতে। তখন ধান আসতো রানিরহাট ও কাটাগাড়ি হাট থেকে।

এখন সলঙ্গা হাটে মালামাল আমদানি-রফতানিতে আগের মতো গরু-মহিষের গাড়ি, নৌকা কিংবা ঘোড়া গাড়ির প্রচলন নেই। শত শত রিকশা, ভ্যান, ভটভটি, করিমন, নছিমন ও ট্রাক-পিকআপে মালামাল পরিবহন করা হয়। চারদিকে পাকা সড়ক। আমদানি-রফতানির কাজে ট্রাক ব্যবহার করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এখন প্রতিদিন ২০-২৫ ট্রাক ধান, পাট, সরিষা সলঙ্গা থেকে বাইরে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ২০-২৫ ট্রাক বিভিন্ন মালামাল বাইরে থেকে সলঙ্গায় আসছে।

সে সময় শুধু হাটের দিন দুই-তিন শত মণ ধান আমদানি হতো। এখন প্রতিদিন হাজার হাজার মণ ধান ও সবজি আমদানি হয়। তখন বাজারে হাতেগোনা কয়েকটি দোকান ছিল। এখন ছোটবড় মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক দোকান রয়েছে। আরও রয়েছে সাতটি আধুনিক মার্কেট। কাপড় ও গার্মেন্টের শতাধিক দোকান রয়েছে। রড-সিমেন্ট ও হার্ডওয়্যারের দোকান আছে ২০টি। এছাড়া ফ্রিজ, টেলিভিশনের দোকান আটটি। ১৫-২০টি স্টিলের দোকান আছে। কোনও পণ্যের জন্য এখন আর কাউকে বাইরে বাজার করতে যেতে হয় না। দৈনিক হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। কাঁচা বাজারসহ সব সদাই এক বাজারেই মেলে। সকাল থেকে রাত্র ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে দোকানগুলো। বিদ্যুতের আলোয় বাজার থাকে উজ্জ্বল।

সলঙ্গার হাটের চিত্র বদলালেও বিলেতি পণ্য বর্জনকারীদের স্মৃতিস্তম্ভ বসেনি

স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা জানান, হাটের অনেক জায়গা দখলে নিয়ে ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। আবার অনেকে হাটের জায়গা দখল করে দোকান নির্মাণ করে বিক্রি করে আসছেন। অথচ ১০০ বছর পার হলেও নিহত শহীদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি।

সলঙ্গা ফোরামের সভাপতি এ এইচ এম মহিবল্লাহ মহিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উত্তরবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বড় হাট বসে সলঙ্গা বাজারে। তবে আশপাশের উপজেলাগুলোসহ কিছু জায়গায় ছোট ছোট হাট বসার কারণে এখন সলঙ্গা হাটে জনসমাগম কিছুটা কমে এসেছে। সে সময় রাস্তাঘাট পাকা ছিল না। এখন এখানকার সব রাস্তাঘাট পাকা হওয়ায় হাটে আমদানি-রফতানি বেড়েছে। তবে ১০০ বছরে সলঙ্গা হাটের যে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল তা কিন্তু হয়নি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু প্রভাবশালী সলঙ্গা হাটের প্রায় ১০০ বিঘা জমি দখল করে রাখায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করা যাচ্ছে না। ১০০ বছর পার হলেও এখনও সলঙ্গা দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয়নি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাচ্ছি, সলঙ্গা দিবসকে যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়।’

মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ গবেষণা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ও ইতিহাস গবেষক মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সে সময় বিদেশি পণ্য বর্জনের জন্য মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ আন্দোলনের ডাক দিলে ব্রিটিশ সরকারের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ সদস্যদের গুলিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ হতাহত হন। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ শুধু সলঙ্গার জন্য নয়; তিনি দেশের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। তার আন্দোলনের কারণেই আজ ঐতিহ্যবাহী সলঙ্গা হাটে লাখ লাখ টাকার পণ্য আমদানি-রফতানি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে রক্তাক্ত সলঙ্গা বিদ্রোহ দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’

মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ পাঠাগারের সহ-সভাপতি গজেন্তনাথ মন্ডল বলেন, ‘সলঙ্গা দিবস উপলক্ষে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ পাঠাগারের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। সকাল ৮টায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১০টায় র‌্যালি ও আলোচনা সভা এবং সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। শনিবার ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ করা হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সে সময় উত্তরবঙ্গের মধ্যে শুধু সলঙ্গা বাজারেই হাট বসতো। এখন আশপাশে অনেক জায়গায় ছোট ছোট হাট বসে। তারপরও সলঙ্গা হাটে যে পরিমাণ লোকসমাগম হয়, তা অন্য হাটে হয় না। তবে ১০০ বছরে হাটের যে উন্নয়ন হওয়ার কথা, তা হয়নি। ভূমিদস্যুরা হাটের অনেক জায়গা দখলে নিয়েছে। কিন্তু নিহত শহীদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।’

এ বিষয়ে রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৃপ্তি কানা মন্ডল বলেন, ‘সলঙ্গা দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় জাতীয়ভাবে কোনও অনুষ্ঠান হচ্ছে না। তবে সলঙ্গায় আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের নামে যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেখানে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারা আমাকে দাওয়াত দিয়েছে আমি সেখানে যাবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘সলঙ্গা হাটের কিছু জায়গা প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে বিষয়টি আমি জানি। সলঙ্গা হাটের জায়গা দখলের বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। মামলাগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নিতে পারছি না। স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. আব্দুল আজিজ স্যারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, স্থানীয় ভূমি অফিসের পাশে অনেক জায়গায় রয়েছে, সেখানে নিহত শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। এক কোটি ৮০ লাখ টাকার বাজেটও নাকি পাস হয়েছে।’

 

/এএম/এফআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব পেমেন্ট সুইচ চালু
সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব পেমেন্ট সুইচ চালু
সরকারি চাল আত্মসাতের দায়ে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার কারাদণ্ড
সরকারি চাল আত্মসাতের দায়ে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার কারাদণ্ড
খাগড়াছড়িতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা গ্রেফতার
খাগড়াছড়িতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা গ্রেফতার
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজ দুই দিন পেছাচ্ছে!
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজ দুই দিন পেছাচ্ছে!
সর্বাধিক পঠিত
পররাষ্ট্র সচিবের অফিসার্স ক্লাবের সদস্য পদ স্থগিত
পররাষ্ট্র সচিবের অফিসার্স ক্লাবের সদস্য পদ স্থগিত
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
স্বর্ণের দাম আবার কমলো
স্বর্ণের দাম আবার কমলো
হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল ইতিহাসে এটাই প্রথম: প্রধান বিচারপতি
হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল ইতিহাসে এটাই প্রথম: প্রধান বিচারপতি
পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে সহায়তা করবে বালুচ লিবারেশন আর্মি
পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে সহায়তা করবে বালুচ লিবারেশন আর্মি