X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একসঙ্গে এত লাশ কখনও দেখেনি মাড়েয়া গ্রামের মানুষ

সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ, পঞ্চগড়
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২৩:১৮আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২৩:১৮

একসঙ্গে এত লাশ আগে কখনও দেখেননি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের মাড়েয়া বাজার গ্রামের বাসিন্দারা। তাদের কাছে হাঁটুজলের নদী হিসেবে পরিচিত করতোয়া এখন আতঙ্কের নাম। চিরচেনা নদীটি কেমন যেন অচেনা হয়ে পড়েছে। হবেই না কেন, গত তিন দিনে নদী থেকে একে একে ৬৮ জনের লাশ তুলে আনা হয়েছে তীরে। এখনও চার জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। 

মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৮ লাশ উদ্ধার করা হয়। ৬৮ লাশের মধ্যে নারী ৩০, পুরুষ ১৭ ও শিশু ২১ জন। এ সময় প্রিয়জনের নিথর দেহ দেখে আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ। শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো গ্রামে।

মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদে কথা হয় বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা হেমন্ত বর্মণের (৪৫) সঙ্গে। ডুবে যাওয়া নৌকার যাত্রী ছিলেন তিনি। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হেমন্ত বলেন, ‘ঘাটে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। নৌকার সংখ্যা কম ছিল। মহালয়া উপলক্ষে বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরে ধর্মসভায় যাচ্ছিলেন সবাই। স্রোতের মতো সবাই নৌকা উঠেছিল। নৌকায় পা রাখার জায়গা পর্যন্ত ছিল না। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে একপ্রকার দুলতে দুলতে ঘাট ছাড়ে নৌকাটি। কিছুদূর যাওয়ার পরই ঢেউয়ের তোড়ে নৌকাটি উল্টে যায়।’ 

তিনি বলেন, ‘নৌকা উল্টে যাওয়ার পর কোনও রকমে সাঁতরে তীরে আসি। কিন্তু নৌকায় নারী-শিশু বেশি থাকায় একজন আরেকজনের ওপরে চাপা পড়ে ডুবে যায়। কীভাবে বেঁচে ফিরলাম জানি না। এখনও চোখের সামনে ভাসছে সেই দৃশ্য। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলাম। জীবনেও এই ঘটনা ভুলবো না।’

আরও পড়ুন: করতোয়ার পাড় থেকে শ্মশান ঘাট, লাশ আর লাশ

মাড়েয়ার বাসিন্দা ওই ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য মাহবুব আলম প্রধান বলেন, ‘এর আগে এমন নৌকাডুবির ঘটনা এই এলাকায় ঘটেনি। একসঙ্গে এত মানুষের প্রাণহানিও কখনও হয়নি। আমার ষাট বছরের জীবনে তো বটেই আমার বাপ-চাচারাও এত মৃত্যু একসঙ্গে দেখেননি।’

প্রিয়জনের নিথর দেহ দেখে আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ

মাড়েয়া বাজার এলাকার বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব ভবানী রায় বলেন, ‘করতোয়ার সঙ্গে আমাদের বেড়ে ওঠা। এই নদীতে এমন ভয়াবহ ঘটনা এর আগে ঘটেনি। একসঙ্গে এত লাশ দেখিনি। চোখের সামনে লাশের সারি ভেসে উঠছে। কিছুতেই ভুলতে পারছি না এমন দৃশ্য।’ 

তিনি বলেন, ‘গ্রামের সাধারণ মানুষ ভুল করেই একসঙ্গে নৌকায় উঠেছিল। কিন্তু ঘাটে যারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন তারা কেন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেননি। ঘাটের ইজারাদারসহ সংশ্লিষ্টরা এত মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না।’

এর আগে ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুর দেড়টার দিকে মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিন নারী-শিশুসহ ২৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন আরও ২৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার কার্যক্রমের তৃতীয় দিন ১৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের তিনটি ইউনিট উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছে।

মঙ্গলবার উদ্ধারকৃত লাশগুলো হলো—শৈলবালা (৫১), সনেকা রানী (৫৫), হরি কিশোর (৪৫), শিল্টু বর্মণ (৩২), মহেন চন্দ্র (৩০), ভূমিকা রায় পূজা (১৫), আখি রানী (১৫), সুমি রানী (৩৮), পলাশ চন্দ্র (১৫), ধৃতি রানী (১০), সজিব রায় (১০), পুতুল রানী (১৫), কবিতা রানী (৯), রত্না রানী (৪০) মালিন্দ্র নাথ বর্মণ (৫৬), মণিভূষণ বর্মণ (৪৬), মুনিকা রানী (৩৬) ও দোলা রানী (৫)।

আরও পড়ুন: পঞ্চগড়ের আরও ৪ লাশ ভেসে এলো দিনাজপুরে

রাতে তৃতীয় দিনের উদ্ধার অভিযান সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউনকে এসব তথ্য নিশ্চিত করে উদ্ধার কার্যক্রমের কন্ট্রোল রুমের প্রধান ও পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপঙ্কর রায় বলেন, ‌‘এ পর্যন্ত ৬৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের করা তালিকা অনুযায়ী এখনও চার জন নিখোঁজ রয়েছেন। বুধবারও উদ্ধার কার্যক্রম চলবে।’

মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, নদী থেকে একের পর এক লাশ তুলে পাড়ে রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে অধিকাংশ ফুলে গেছে। কোনও কোনও লাশে পচন ধরেছে। ইউনিয়ন পরিষদের চত্বর ও ঘাটের পাড়ে লাশগুলো রাখা হয়েছে। স্বজনরা লাশ শনাক্ত করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারিতে আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। বিকালে শ্মশানঘাটে দাহ করার জন্য লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয়। মাড়েয়ার বটতলী, শালডাঙ্গ, ফুটকিবাড়ি ও রাঙ্গামাটিসহ বিভিন্ন শ্মশানঘাটে লাশগুলো দাহ করা হয়।

একের পর এক উদ্ধার হচ্ছে লাশ, করতোয়ার পাড়ে নির্বাক স্বজনরা/ ছবি: আরিফুল ইসলাম রিগান

রাঙ্গামাটি শ্মশানঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, লাশ সৎকারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কোনও লাশ পোড়ার ছাই পড়ে আছে, আবারও কোনও লাশ পোড়ানোর জন্য চিতায় নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: নৌকাডুবিতে মৃত্যু বেড়ে ৬৮, এখনও নিখোঁজ ৫

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স দিনাজপুর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মঞ্জিল হক বলেন, ‘আজ নদীর পানি কম ছিল। অনেক লাশ নদীর তলদেশে কাদায় আটকে ছিল। ঘটনাস্থল থেকে ভাটির দিকে ৩০ কিলোমিটার এলাকায়  উদ্ধার অভিযান চালানো হয়েছে। লাশগুলো শনাক্ত করে স্বজনদের বুঝিয়ে দিয়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। নিখোঁজ চার জনকে উদ্ধারে বুধবার সকাল থেকে অভিযান চালানো হবে।’

এদিকে, সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীর পাড়ে নিখোঁজ স্বজনের অপেক্ষায় ছিলেন অনেকে। স্বজন হারানো পরিবারে চলছে শোকের মাতম।

/এএম/
সম্পর্কিত
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা
সর্বশেষ খবর
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী