X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে মানুষের বুকভাঙা আর্তনাদ

আরিফুল ইসলাম রিগান, কুড়িগ্রাম
২৩ অক্টোবর ২০২২, ২৩:১৯আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০২২, ২৩:১৯

‘বাড়ি ছিল ওই যে কালা গাছ দেহা যায় ওই হানে। ২৫টা বছর ধইরা খালি বাড়ি ভাইঙতাছি, খালি ভাইঙতাছি। আর সহ্য হয় না।’ ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে নদের কিনারে দাঁড়িয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নাগর আলী (৬৪)। আগ্রাসী হয়ে ওঠা এই নদের গ্রাসে আবারও ভাঙনের মুখে তার ভিটামাটি। 

শুধু নাগর আলী নন, তার গ্রামের শতাধিক পরিবার এখন ভাঙন আতঙ্কে। প্রতিদিনই ভিটা হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে একের পর এক পরিবার। নাগর আলী কুড়িগ্রামের উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সরকার পাড়া গ্রামের বাসিন্দা। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ওই গ্রামে ভিটামাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে অন্তত ১০টি পরিবার। প্রতিদিন একের পর এক পরিবারের ভিটামাটি গিলে খাচ্ছে তাদের চিরপরিচিত নদ।

ভাঙন প্রতিরোধে সরকারের কাছে আকুতি জানিয়ে নাগর আলী বলেন, ‘দুর্গতি হইলো আমাদের এই নদী। আমরা তো ট্যাকা-পয়সা চাই না। নদীটা ঠ্যাকায় দিলেই হয়।’

উপার্জনের টাকায় খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের সুখের জন্য নতুন ঘর তুলেছিলেন দিনমজুর মোঘল হোসেন। ভাঙনে ভিটার একেবারে কাছে এসেছে ব্রহ্মপুত্র। নদের আগ্রাসী ভাঙনে তিনি বুঝতে পেরেছেন শেষরক্ষা আর হবে না। শিশুসন্তান সুমনকে নিয়ে তাই পরম যত্নে গড়া ঘরের সবকিছু খুলে নিচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতেই কেঁদে ফেলেন মোঘল। সন্তানের সামনে বাবার এমন বুকভাঙা আর্তনাদ নাড়া দেয় প্রতিবেশিদের।

মোঘল বলেন, ‘নিজে না খাইয়া কষ্টের ট্যাকা দিয়া পোলাপাইনের জন্য ঘর করছিলাম। কপালে না থাকলে কী করুম।’

আগ্রাসী হয়ে ওঠা এই নদের গ্রাসে আবারও ভাঙনের মুখে অনেকের ভিটামাটি

‘চারবার বাড়ি ভাঙছে। শ্যাষে শ্বশুরের দেওয়া ভিটায় ঘর করেছিলাম। সেটাও হারাইলাম। অহন সব লইয়া রংপুরের পীরগঞ্জের দিকে যাইতাছি। ওইহানে ভায়রা একটা জায়গার ব্যবস্থা করতে চাইছে।’ কষ্টের টাকায় তোলা নতুন ঘরের খুঁটি খুলতে খুলতে নিজের ভাগ্য বিড়ম্বনার কথা জানান এই দিনমজুর।

মোঘলের ভাঙনকবলিত ভিটার কিছুটা দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্রের কিনারে আরও কয়েকটি ঘর। মাঝখানে অন্তত পাঁচ-সাতটি পরিবার ঘর ভেঙে বিছানাপত্র রেখে খোলা আকাশের নিচে রয়েছে। অনেকের ভিটার অর্ধেক চলে গেছে নদের গর্ভে। নদের কিনারে এখনও ঘরের খুঁটির গর্ত আর মেঝের দাগ, কেটে নেওয়া গাছের গোড়া। এর পাশে রান্না ঘরে বসবাস করছেন আনোয়ারা-মূসা মিয়া দম্পতি। ভাঙনে স্থানান্তরিত হতে হতে তারাও ক্লান্ত।

আনোয়ারা বলেন, ‘এত কুলায় না বাড়ি ভাঙা। মাইনষের জায়গায় আছিলাম। সব ভাইঙ্গা চুইড়া গেলো। এখন কই যামু জানি না। মাইনষে হাত না দিলে ঘর সরাইতেও পারতাম না।’

‘আমরা তো ট্যাহা চাই না। ভাঙনটা ঠ্যাকায় দিলে এহানে ওহানে কাম কইরা খাইতে পারি। পোলাপান লইয়া অহন কই যামু জানি না।’ এভাবেই নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানান আনোয়ারা।

আনোয়ারা যখন এভাবে বলছিলেন তখন নদের কিনারে বসে ঘোলা পানিতে নিজেদের ভবিষ্যত খুঁজছিলেন আরেক ভাঙনকবলিত দিনমজুর সোনাউল্লাহ। চোখেমুখে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালোছায়া।

শুধু আনোয়ারা কিংবা মোঘল হোসেন নন, আগ্রাসী ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ভিটামাটি আর আবাদি জমি হারিয়েছেন একই গ্রামের ইউনুস, মালেক, তালেব ও লালমিয়াসহ ইউনিয়নের কয়েকশ পরিবার। এখনও ভাঙন হুমকিতে চরম সংকটে আছে বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের শতাধিক পরিবার, ঐতিহ্যবাহী মোল্লাহাট বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা। কয়েক কিলোমিটার ধরে চলমান ভাঙনে বিলীন হচ্ছে শত শত হেক্টর আবাদি জমি, বাড়ছে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা। 

খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই ইউনিয়নের তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন চলমান। একের পর এক পরিবার বাস্তুহারা হতে থাকলেও প্রকল্প না থাকার ‘অজুহাতে’ ভাঙন প্রতিরোধে কোনও উদ্যোগ নেয়নি পাউবো কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতেই কেঁদে ফেলেন মোঘল

গত শুক্রবার বিকালে বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনকবলিত এলাকাঘুরে দেখা গেছে, ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে অর্ধশতাধিক পরিবার, আবাদি জমি ও গাছপালা। অনেকের বাড়ির গাছপালা নদের পানিতে পড়ে আছে। 

মোল্লারহাট বাজারের দক্ষিণ প্রান্তের একটি অংশে পাউবোর প্রতিরক্ষা কাজের জিওব্যাগ ধসে গেছে ব্রহ্মপুত্রের স্রোতের তোড়ে। হুমকিতে বাজারের বিভিন্ন স্থাপনাসহ আশপাশের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি।

ভাঙনের তীব্রতার কথা স্বীকার করে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমি শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আপাতত মোল্লারহাট বাজার প্রতিরক্ষায় পাঁচ হাজার জিওব্যাগ ফেলার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কাজও শুরু হয়েছে।’ তবে এই মুহূর্তে স্থানীয়দের বসতভিটা রক্ষায় কোনও কাজ শুরু হচ্ছে না বলে জানান পাউবোর এই কর্মকর্তা।

/এএম/
সম্পর্কিত
অসময়ে ভাঙছে ব্রহ্মপুত্রের পাড়, দুশ্চিন্তায় স্থানীয়রা
নদ থেকে অবৈধভাবে তোলা বালুতে পৌরসভার চত্বর তৈরি করছেন প্যানেল মেয়র
অসময়ে পদ্মার ভাঙনে আতঙ্কে এলাকাবাসী
সর্বশেষ খবর
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক