পঞ্চগড়ে সূর্যের আলো আর তাপ নিয়ন্ত্রণ করা বিশেষ শেডের নিচে সারি সারি ফুটেছে রাজসিক সৌন্দর্যের ফুল টিউলিপ। ছড়াচ্ছে মুগ্ধতা। টিউলিপের বাগানে এসে কেউ ছুঁয়ে দেখছেন, কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ফুলের সঙ্গে সেলফি নিচ্ছেন। আবার কেউবা ভিডিও কলে দূরে থাকা স্বজনদের দেখাচ্ছেন টিউলিপের সৌন্দর্য। কেউ কেউ ফুল কিনে ফিরছেন বাড়িতে। সব মিলিয়ে টিউলিপের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ সবাই।
গত মঙ্গলবার বিকালে তেঁতুলিয়ার চোখজুড়ানো এই টিউলিপ বাগানে গিয়ে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে। মনোমুগ্ধকর এই ফুল চতুর্থবারের মতো তেঁতুলিয়ায় ফুটেছে শুনে নেমেছে দর্শনার্থীদের ঢল। দর্শনার্থীরা জনপ্রতি ৫০ টাকার টিকিট কেটে বাগানে ঢুকে উপভোগ করছেন এই ফুলের সৌন্দর্য।
এবার চতুর্থবারের মতো উপজেলার ক্ষুদ্র চাষিদের মাধ্যমে প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে খামার পর্যায়ে করা হয়েছে শীতের দেশের ফুল টিউলিপের চাষ। টিউলিপ উৎপাদনের এই উদ্যোগ নিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। প্রকল্পটিতে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। পর্যটনের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে টিউলিপ বাগান। সচ্ছলতা ফিরেছে নারী উদ্যোক্তাদের পরিবারে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীতপ্রধান দেশে টিউলিপ ফুল ভালো হয়। এই ফুল চাষের ক্ষেত্রে দিনের বেলা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহনশীল ধরা হয়। এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা হলে ফুল যথাযথভাবে না-ও ফুটতে পারে। স্বাভাবিকভাবে রোপণের ১৮ থেকে ২০ দিনের মধ্যে কলি আসতে শুরু করে। ২৫ থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত ফুল স্থায়ী হয়।
ইএসডিও ও নারী উদ্যোক্তারা জানান, নারী উদ্যোক্তাদের সহযোগিতায় টিউলিপ চাষে এগিয়ে এসেছে ইএসডিও। তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের দর্জিপাড়া গ্রামে এবার ১৩ জন নারী উদ্যোক্তা এক একর জমিতে চতুর্থবারের মতো এই ফুল চাষ করেছেন। এ বছর সানি রাজকুমার, পিংক আর্ডোর, প্যারেড, অক্সফোর্ড, কমলা ভ্যাব বরলশ, ফেরডেক্স, অ্যাপেলডুম, ব্লাশিং এলিট ও মেস্টিক ভ্যান ইউজক নামের ৯ প্রজাতির ফুল চাষ হয়েছে। সম্প্রতি ইএসডিওর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মুহম্মদ শহীদ উজ জামান এবং ইএসডিওর পরিচালক (প্রশাসন) ড. সেলিমা আখতার ফিতা কেটে টিউলিপ বাগানে পর্যটকদের প্রবেশ উন্মুক্ত করেন।
নারী উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে নানা রঙের টিউলিপে ভরে উঠেছে বাগান। বাগান ঘিরে গড়ে উঠেছে ইকোট্যুরিজম। চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি রোপণ করা হয়েছিল। মাত্র ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে চারা গজিয়ে কয়েক সারিতে ফুল ছড়িয়ে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। আগামী দুই মাস এই ফুল তার রাজসিক সৌন্দর্য ও সৌরভ ছড়াবে। ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসছেন হাজারো পর্যটক।
সরেজমিনে দেখা যায়, পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে টিউলিপ বাগান দেখতে এসেছেন। কেউ ফুল ছুঁয়ে দেখছেন, কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ফুলের সঙ্গে সেলফি নিচ্ছেন। কেউ ১৫০ টাকা দিয়ে ফুল কিনছেন।
রাজশাহী থেকে টিউলিপ বাগান দেখতে আসা শিক্ষার্থী আসিফুজ্জামান আসিফ বলেন, ‘শুনেছি টিউলিপ নেদারল্যান্ডসে হয়। এবার ইউটিউবেও দেখলাম তেঁতুলিয়ায় ফুটেছে। তাই দেখতে এলাম। বাগান দেখে মন ভরে গেছে। অনেক ছবি তুললাম। দেশের মাটিতে বিদেশি ফুল দেখে সত্যিই ভালো লেগেছে।’
ঠাকুরগাঁও থেকে আসা স্কুলশিক্ষক তামান্না আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জীবনে প্রথম টিউলিপ ফুল দেখলাম। দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আমাকে যদি কেউ বলে তোমার প্রিয় ফুল কী, এখন থেকে বলবো টিউলিপ।’
ঢাকা থেকে আসা আইনজীবী আব্দুল মজিদ বলেন, ‘অনেকবার তেঁতুলিয়ায় এসেছি তবে টিউলিপ বাগানের কথা এর আগে শুনিনি। এবার শুনে দেখতে এসেছি। সত্যিই অনেক সুন্দর বাগান। চোখ জুড়িয়ে গেলো।’
দিনাজপুর থেকে আসা রাজিউদ্দিন চৌধুরী ডাবলু বলেন, ‘এবার তেঁতুলিয়ায় ভ্রমণে আসা নতুন একটি মাত্রা যোগ হয়েছে। সেটি হলো টিউলিপ বাগান। এর আগে যখনই এসেছি চা বাগান, নদী থেকে পাথর উত্তোলন এগুলো দেখেছি। এবার টিউলিপ বাগান দেখে খুব ভালো লাগলো আমার। তবে টিউলিপ বাগানে প্রবেশমূল্য যে ৫০ টাকা করা হয়েছে, সেটা আরেকটু কমালে সাধারণ মানুষের জন্য ভালো হতো।’
টিউলিপচাষি ও উদ্যোক্তা সুমি আক্তার এবং মুর্শিদা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, পিকেএসএফ ও ইএসডিওর সহযোগিতায় এবার আমরা ১৩ জন নারী উদ্যোক্তা নয় প্রজাতির টিউলিপ চাষ করেছি। ফুল ফোটার পর থেকে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ভিড় করছেন। নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপের একেকটি বাল্ব আনতে এবার ৮০ টাকা করে খরচ হয়েছে। বর্তমানে বাগান থেকেই একেকটি ফুলের স্টিক ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া একেকটি টবসহ ফুল ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মুর্শিদা খাতুন বলেন, ‘প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০টি ফুল বিক্রি হচ্ছে। গত তিন মৌসুম শেষে প্রত্যেক উদ্যোক্তা ৪০-৫০ হাজার টাকা করে পেয়েছি। এবারও আশা করছি লাভবান হবো। লাভের টাকা দিয়ে আমাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে। আমি স্বাবলম্বী হয়েছি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারছি।’
ইএসডিওর প্রকল্প ব্যবস্থাপক কল্যাণ মোহন্ত বলেন, ‘পিকেএসএফ ও ইএসডিওর সহযোগিতায় ২০২২ সালে তেঁতুলিয়ায় প্রথমবার পাইলট প্রকল্প হিসেবে আট নারী উদ্যোক্তার মাধ্যমে ৪০ শতাংশ জমিতে ছয় প্রজাতির ৪০ হাজার টিউলিপ চাষ করা হয়েছিল। তৃতীয় ও চতুর্থবার ইএসডিওর নিজস্ব অর্থায়নে চাষ করা হয়। এবার এক একর জমিতে ৯টি প্রজাতির ফুল চাষ হয়েছে। ১৩ জন নারী উদ্যোক্তা চাষ করেছেন। নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপের একেকটি বাল্ব আনতে এবার ৮০ টাকা খরচ হয়েছে। গত তিন মৌসুমে আমরা নানাভাবে বাল্ব সংরক্ষণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু সফল হইনি। গাছ হলেও ফুল হচ্ছে না। সরকারিভাবে কোয়ারেন্টাইন ফি ও ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলে টিউলিপ চাষের পরিমাণ বাড়বে। তেঁতুলিয়াসহ আশপাশের এলাকা ভরে যাবে।’
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফজলে রাব্বী বলেন, ‘টিউলিপ বাগান পর্যটনের ক্ষেত্রে তেঁতুলিয়াকে সমৃদ্ধ করেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও দারুণ ভূমিকা রাখছে এই বাগান।’
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে টিউলিপ বাগান দেখতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘ইউটিউবে দেখেছি তেঁতুলিয়ার টিউলিপ বাগান। এখন বাস্তবে দেখলাম। খুবই সুন্দর। পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করছে। পর্যটনকে এগিয়ে নিতে উদ্যোক্তাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।’
ইএসডিওর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, ‘এবার চতুর্থবারের মতো তেঁতুলিয়ায় নারী উদ্যোক্তারা টিউলিপ চাষ করেছেন। গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার পাশাপাশি তেঁতুলিয়াকে ইকোট্যুরিজমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রকল্পটি লাভের মুখ না দেখলেও পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। তারা মুগ্ধ হচ্ছেন, এটাই আমাদের স্বার্থকতা।’
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টিউলিপ বাগান, চা বাগান আর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঘিরে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য করতোয়া নদী সংলগ্ন এলাকায় দেশের সবচেয়ে উঁচু ওয়াচ টাওয়ার, ইকো পার্ক নির্মাণে আর্কিটেকচার ডিজাইন ও প্রজেক্ট প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পর্যটন মোটেল নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান আছে। পর্যটকদের জন্য একটি ট্যুর গাইড অ্যাপস তৈরি করছি আমরা। ইতোমধ্যে মহাসড়কের পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। সবকিছু তৈরি হয়ে গেলে পর্যটকদের নতুন গন্তব্য হবে পঞ্চগড়।’