X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২
মৌলভীবাজারে ডলার-পাউন্ড কেনাবেচা

দোকান মোবাইল ও টাইলসের, আড়ালে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসা

সাইফুল ইসলাম, মৌলভীবাজার
০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০১আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০১

প্রবাসী-অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলায় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আড়ালে চলছে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসা। তাদের সঙ্গে ডলার-পাউন্ড কেনাবেচায় সক্রিয় হয়েছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। এতে বড় অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। গোপনে এই ব্যবসা চললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদাসীন বলে অভিযোগ প্রবাসীদের।

জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, মৌলভীবাজার জেলার আড়াই লক্ষাধিক মানুষ ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। 

জেলার একাধিক ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজারে সৈয়দ মানি এক্সচেঞ্জ নামে একটি মাত্র বৈদেশিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু জেলা শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে অন্তত শতাধিক অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। লাইসেন্সবিহীন ব্যবসায়ীরা দায়িত্বশীলদের ম্যানেজ করে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে মিলে ডলার-পাউন্ড কেনাবেচায় সক্রিয় রয়েছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদেশ থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা কম দামে প্রবাসীদের কাছ থেকে কিনে নেয় তারা। যখন দাম বেড়ে যায় তখন বেশি দামে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার বৃহৎ একটি অংশ কালো টাকা হিসেবে আড়ালে রয়ে যায়। এই চক্রের সঙ্গে ঢাকার হুন্ডি ব্যবসায়ীদের যোগসাজশ রয়েছে।

জেলার একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরজুড়ে দেশে আসা-যাওয়া করেন মৌলভীবাজারের প্রবাসীরা। সঙ্গে নিয়ে আসেন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। প্রবাসীদের এসব মুদ্রা টাকার বিনিময়ে কেনার জন্য শহরের বেরিরপাড় এলাকার রয়েল ম্যানশন মার্কেটে গড়ে উঠেছে একাধিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। শহরের সৈয়দ মানি এক্সচেঞ্জ ছাড়া বাকি সবগুলো অবৈধ। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে ডলার-পাউন্ড কেনাবেচা হয়।

সরকার অনুমোদিত সৈয়দ মানি এক্সচেঞ্জের মালিক সৈয়দ ফয়ছল আহমদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিয়ে নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবসা করছি। কিন্তু জেলায় অবৈধভাবে লাইসেন্স ও অনুমোদন ছাড়াই ব্যবসা করছে অনেকে। তারা কীভাবে ব্যবসা করছে, সে সম্পর্কে ভালো জানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

পুলিশ জানায়, ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর মৌলভীবাজার মডেল থানায় ৯ জনকে আসামি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা হয়েছিল। ওই মামলায় শহরের গোবিন্দ্র শ্রী এলাকার জমির মিয়াকে আসামি করা হয়। পরে জামিনে মুক্তি পান। এখনও মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ায় চার্জশিট দেওয়া হয়নি। 

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমির মিয়া ও তার সহযোগীরা এখন হুন্ডি ব্যবসায় সক্রিয় হয়েছেন। শহরের প্রভাবশালী একটি মহলের ছত্রছায়ায় হুন্ডি ব্যবসা করছেন তারা।

তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে জমির মিয়া বলেছেন, ‘আমি প্রবাসে থাকি। সম্প্রতি দেশে ফিরেছি। এসব ব্যবসায় জড়িত নই। একসময় বেরিরপাড় এলাকার মার্কেটে আমার দোকান ছিল। তখন ষড়যন্ত্র করে আমার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করা হয়েছিল। তবে আমি এই ব্যবসা করি না।’

বেরিরপাড় এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এস এ ট্রাভেলসের নামে প্রতিষ্ঠানের প্রোপ্রাইটর আব্দুল হান্নান অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ ও হুন্ডি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন অনেকে। বিপুল পরিমাণ ডলার-পাউন্ড কিনে দেশ-বিদেশে পাচার করছেন। এতে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। এ ব্যাপারে জানতে এস এ ট্রাভেলসের প্রোপ্রাইটর আব্দুল হান্নানের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি। প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। 

জেলার একাধিক প্রবাসী জানিয়েছেন, শহরের সায়েক এন্টারপ্রাইজ, সেন্টু এন্টারপ্রাইজ, হেকিম আহমদ, আনোয়ার এন্টার প্রাইজ, বেরিরপাড় এলাকার রয়েল ম্যানশনের ইউনিক টাইলস, শাহ মোস্তফা টেলিকম, তরফদার এন্টারপ্রাইজ, রুমন এন্টারপ্রাইজ, মদিনা ট্রেডার্স, ফারিয়া ইলেকট্রনিক্স, কোরেশি ট্রেডার্স, জিসান এন্টারপ্রাইজ, এফ ইলেকট্রনিক্সসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান অন্য ব্যবসার আড়ালে মানি এক্সচেঞ্জ করছেন।

এর মধ্যে সরেজমিনে রয়েল ম্যানশনের ইউনিক টাইলস, ফারিয়া ইলেকট্রনিক্স, শাহ মোস্তফা টেলিকমে গিয়ে দেখা গেছে, টাইলস, মোবাইলের চার্জার ও দোকানের আড়ালে চলছে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসা। এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি তারা।

স্থানীয় প্রবাসী আরিফুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন ও মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, বেরিরপাড় এলাকার মানি এক্সচেঞ্জ দোকানগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রা ভাঙাতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। রিকশা অথবা গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে টেনেহিঁচড়ে তাদের দোকানে নিয়ে যান প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। তারা ব্যাংকের চেয়ে কম দামে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে পরে বেশি দামে বিক্রি করেন। 

ব্যাংকে না গিয়ে কেন অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ দোকানে যাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানিয়েছেন, বেরিরপাড় এলাকার সোনালী ব্যাংকের বৈদেশিক শাখায় ডলার-পাউন্ড এক্সচেঞ্জ করা যায় না। ফলে বাধ্য হয়ে লাইসেন্সবিহীন এসব প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। এ সুযোগে গ্রাহকদের হয়রানি করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের মৌলভীবাজার প্রধান শাখার এজিএম কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমাদের শাখায় ডলার-পাউন্ড এক্সচেঞ্জ করা যায় না, এই কথা সঠিক নয়। অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে সরকার তৎপর আছে। এছাড়া বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানো ও মুদ্রা ভাঙানোর বিষয়ে নানাভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছি আমরা। পাশাপাশি যারা অবৈধভাবে ডলার-পাউন্ড ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলে আসছি আমরা।’

লাইসেন্সবিহীন অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন কী পদক্ষেপ নিচ্ছে জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম বলেন, ‘অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জেলা পুলিশ সুপার মো. মনজুর রহমান বলেন, ‘এসব অবৈধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জেলা পুলিশের তদারকি আছে। ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অভিযোগ ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা পেলে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ এবং হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে অভিযান চালাবো আমরা।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে বৈধ ২৩৪টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান আছে। অবৈধ মানি চেঞ্জারের সঙ্গে যে কোনও প্রকার লেনদেন, দোকান ভাড়া চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার জন্য ভবন মালিক এবং সর্বসাধারণকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

/এএম/ 
সম্পর্কিত
রাঙামাটিতে পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ
রূপগঞ্জে সাংবাদিককে ইট দিয়ে থেঁতলে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা
‘ধর্ষণের শিকার’ সপ্তম শ্রেণির সেই ছাত্রীর লাশ উদ্ধার
সর্বশেষ খবর
বাজেটে ভর্তুকি দিলেও এলএনজি আমদানিতে ঘাটতি ১১ হাজার কোটি টাকা
বাজেটে ভর্তুকি দিলেও এলএনজি আমদানিতে ঘাটতি ১১ হাজার কোটি টাকা
হজ কার ওপর ফরজ এবং এর কী ফজিলত
হজ কার ওপর ফরজ এবং এর কী ফজিলত
পাকিস্তানি ড্রোন হামলা প্রতিহতের দাবি ভারতীয় সেনাবাহিনীর
পাকিস্তানি ড্রোন হামলা প্রতিহতের দাবি ভারতীয় সেনাবাহিনীর
জাল এক লাখ টাকা ২০ হাজারে বিক্রি
জাল এক লাখ টাকা ২০ হাজারে বিক্রি
সর্বাধিক পঠিত
‘সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের শাস্তি দিতে না পারলে আমি চলে যাবো’
‘সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের শাস্তি দিতে না পারলে আমি চলে যাবো’
দেশ ছেড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ
দেশ ছেড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
নৌ পুলিশের অভিযানে ২৭৬ জন গ্রেফতার, ১০ মরদেহ উদ্ধার
নৌ পুলিশের অভিযানে ২৭৬ জন গ্রেফতার, ১০ মরদেহ উদ্ধার
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ